মুহাম্মাদ আদম আলী ।।
২০০২ সাল। প্রফেসর হযরত হামীদুর রহমান সাহেব অফিসিয়ালি বেকার হয়ে গেলেন। বয়স বাষট্টি পেরিয়েছে। চাকুরীর সীমা শেষ। বুয়েটে ছাব্বিশ বছর শিক্ষকতা করে আইইউটিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেখান থেকে এখন অবসরে গিয়েছেন। কী করবেন এখন?
কিছু লোক খুব চালাক। সময়ের সদ্ব্যবহার করতে জানে। এরকম এক ভদ্রলোক সুযোগ বুঝে কোপ দিলেন। কোপটা জায়গা মতো গিয়ে লাগল। তিনি প্রফেসর হযরতকে কাজে লাগিয়ে দিলেন। প্রফেসর হযরত কোচিং হোমে শিক্ষকতা করবেন। বিষয়টা পুরোপুরিই বেমানান। এ কাজে তাকে রাজি করানো সহজ ব্যাপার নয়। চালাক লোকদের কাছে অনেক কঠিনই সহজ হয়ে যায়।
ওই ভদ্রলোক বসুন্ধরা মাদরাসার মুফতি আব্দুর রহমান রহ.-এর মুরীদ ছিলেন। তিনি গিয়ে মুফতি সাহেবকে ধরেছেন। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজের ছাত্রদের জন্য একটা কোচিং হোম খুলতে চান। সেখানে প্রফেসর হযরত শিক্ষক হিসেবে থাকলে অনেক ছাত্র হয়তো পড়তে আসবে। মুফতি সাহেব প্রফেসর হযরতকে সেই কোচিং হোমে পড়াতে বললেন। হুযুরের কথা শিরোধার্য করে প্রফেসর হরযত রাজি হয়েছেন। শর্ত একটাই থাকল, ছাত্রীদের পড়ানো যাবে না।
মুফতি সাহেব কোচিং হোমের একটা আধুনিক নাম ঠিক করতে বললেন। নাম ঠিক করা হলো ইউক্লিড প্লাস কোচিং হোম। কঠিন নাম। ইংলিশ মিডিয়াম ছাত্ররা পড়বে। শিক্ষকরা হুযুর হলেও তাদের ধাঁচেই নাম রাখা হলো। জায়গা ঠিক হলো ধানমন্ডীতে। একটা ফ্লাট ভাড়া নেওয়া হয়েছে। প্রফেসর হযরত ‘ও’ লেবেলের ছাত্রদের ফিজিক্স, ক্যমিস্ট্রি আর ম্যাথ পড়াবেন। যথারীতি ক্লাস শুরু হয়ে গেল।
আমাদের সমাজে বিচিত্র সব মানুষ বাস করে। খুব কাছের মানুষও মাঝে মাঝে খুব অচেনা লাগে। সেখানে ইংলিশ মিডয়াম ছাত্র-ছাত্রীদের চেনা আরও কঠিন। তাদের চলন-বলন, কায়া-ছায়া এদেশের নয়। বিদেশের। এসব স্কুলে ভর্তি হয়েই তারা আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান হয়ে ওঠে। সাদাসিধে চেহারায় কী যে লুকিয় থাকে!
তাদের চেহারায় লুকিয়ে থাকা জিনিসটা কয়েকদিনেই টের পাওয়া গেল। এক মাস যেতে না যেতেই কোচিং হোমে ছাত্র অর্ধেক কমে গেল। পরের মাসে শূন্য। মেয়েদের না পড়ালে ছেলেরাও এ কোচিং হোমে পড়বে না। সুতরাং ভদ্রলোক আহত সৈনিকের মতো দুহাত উপরে তুলে দিলেন। প্রফেসর হযরতের নিকট আত্মসমর্পণ করলেন। তিনি সেটি ছেড়ে অন্য কোনো কাজে লেগে গেলেন।
প্রফেসর হযরত ফ্লাটটি ছাড়লেন না। ভাড়া করার সময় চুক্তি করা হয়েছিল। কয়েকমাসের ভাড়াও অগ্রীম দিয়েছিলেন। সুতরাং প্রফেসর হযরত সেখানে শিশুদের জন্য মক্তব খুলে দিলেন। তার মেজো ছেলে মাওলানা মুস্তাফিজ সাহেবকে দায়িত্ব দিলেন। এভাবে সেই কোচিং হোম মক্তবে পরিণত হলো। সেই মক্তবের অনেক ছাত্র পরে হাফেজ-আলেমও হয়েছে।
এখনো সেই মক্তব টিকে আছে। জায়গা পাল্টিয়েছে। ঝিগাতলায়। ছাত্র সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। বড়দের কথায় নূর থাকে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেটি মেনে নিতে পারলে সেই নূর আলো ছড়ায়। নিজের মনে যেমন, চারিদিকেও তেমন। মুফতি সাহেবের তো কোচিং হোম সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। কাজ করতে বলেছেন। সেই কাজ তার-ই কাজ হয়ে উঠেছে! বুযুর্গদের কোনো কাজই বৃথা যায় না।