নবীজীর হিযরত: আমাদের জন্য ত্যাগ ও কুরবানীর সবক

আব্দুল্লাহ আলমামুন আশরাফী।।

আজ ২৭ সফর। পথসঙ্গী আবু বকরকে (রা:) নিয়ে এদিনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত শুরু করেন।   সাওর পর্বতে তিন দিন আত্মগোপনে থেকে আবার যাত্রা শুরু করে ১২ রবিউল আওয়াল কুবায় পৌঁছেন। সেখানে ১৪ দিন অবস্থান করে এক আনন্দমুখর দিনে মদীনায় প্রবেশ করেন। (ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ)

মাটি আর মানুষ-এই দুই মিলেই পৃথিবী। এর বাইরে যা কিছু আছে, যত কিছুই নজরে পড়ে সবই তার শোভাবর্ধক, প্রয়োজনীয় সামগ্রী। তাই মাটি ও মানুষের সম্পর্ক এক আত্মীক সম্পর্ক। সকল দেশে, সকল যুগে এর প্রভাব দেদীপ্যমান। এর বিকাশ প্রতীয়মান। মাতৃভূমির প্রতি নিখাঁদ আকর্ষণ, বাপ-দাদার ভিটে মাটির প্রতি অম্লান মায়া কার না আছে? প্রবাসে যে জন কাঁদেনা মায়ের দেশের টানে, শত ব্যস্ততার মাঝেও যে প্রবাসীর মন আমোদিত, আহলাদিত ও আন্দোলিত হয়না মাতৃভূমির স্মরণে, সে তো পাষাণ। দয়া মায়াহীন সীমার।

মানুষ বিপদ-আপদে ধন-সম্পদ বিসর্জন দেয়। সহায় সম্বলের বিনিময়ে জীবন ঠেকাতে চায়। এটা মানুষের স্বভাব। এটা তার প্রকৃতি।কিন্তু ঐ সম্পদের মাঝেও মাটির মর্যাদা তার কাছে আলাদা।তাই মানুষ যথাসম্ভব নিজেকে ধরে রাখতে চায় এই মাটিতে। যখন তার সামনে মাটি বিক্রি ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা, তখন সে মাটি বেচে। তবে এ কঠিন সিদ্ধান্ত তাকে জ্বালা দেয়, তাড়া করে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। সে মুষড়ে পড়ে এক অব্যক্ত যন্ত্রনায়। তাই তো প্রবীনরা বলেছেন, “মাটি ছাড়তে যার বুক কাঁপে না, সে বড়ই হতভাগা”। মাটি থেকে মানুষের সৃষ্টি- এটাই হয়তো এই ভালবাসার নেপথ্যে কাজ করে। মাটির সাথে যে মানুষের এ গভীর ভালবাসা, নিঃসীম প্রেম সে মাটিকেও মানুষ বিসর্জন দেয়।

মানবজাতির ইতিহাস হাতড়ালে দেখা যায়, মানুষ সাধারণত দুটি কারণে মাটি ছাড়ে। আপন ভিটে মাটিও পরিত্যাগ করে। এক. জীবন বাঁচানোর তাকিদে। আপন নিবাসে যখন জীবনের নিশ্চয়তা হারিয়ে যায়। দুই: আপন নিবাসে আরেকটু সুখে কাটাবার স্বপ্নে। সাময়িক প্রবাসের উদ্দেশ্যে। কাজকর্মের সন্ধানে। এ দুটি কারণে মানুষকে ভিটে মাটি বিসর্জন দিতে দেখা যায় প্রতিনিয়ত। মানবজীবনের দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের এ এক অখন্ড চিত্র। কিন্তু আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে পৃথিবী প্রত্যক্ষ করলো ভিটে মাটি বিসর্জনের আরেকটি কারণ। বড় কঠিন, খুনে খুনে লাল আরেকটি কারণে শিহরিত হয় সেদিনকার পৃথিবী। পৃথিবী দেখলো, নীলাভ আকাশ দেখলো, উন্মুক্ত বাতাস আর অগনিত সৃষ্টি দেখলো, একদল মানুষ অমানবিক নির্যাতনে অতীষ্ঠ হয়ে, আঘাতের পর আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছেন। আপন মাতৃভূমি, পরিবার-পরিজন ছেড়ে অজানার পথে হারিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা হারিয়ে যাচ্ছেন। অথচ প্রাণের ভয়েও নয়, জীবিকার সন্ধানেও নয়। হারিয়ে যাচ্ছেন একটি সত্যকে পৃথিবীর সকল কিছুর উর্ধ্বে তুলে ধরার দৃপ্ত শপথে। তাঁরা কাঁদছেন; এক মহাসত্যের কান্না। নয়নের সকল পানিই তারা উৎসর্গ করছেন তাঁর জন্য-যিনি মানবতার অহংকার, যিনি দুজাহানের সরদার, যিনি রাহমাতুল্লিল আলামিন, যিনি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

নবীজী তাঁর জন্মভূমি মক্কায় আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তাওহীদের আওয়াজ তুললেন। কিছু মানুষ তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন। তবে একটা বড় অংশ তাঁর বিরোধিতায় আকন্ঠ ডুবে গেল। তাঁর সঙ্গীদের উপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করল। কারণ, তাঁদের অপরাধ মস্তবড়। তাঁরা পাথরের মূর্তিকে প্রভু মানেননা। তাঁরা হাতের তৈরি মূর্তির সামনে মাথানত করেননা। তিনশ ষাটের বদলে এক আল্লাহর কথা বলেন। তাঁরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। তাঁরা নারীর অধিকারের কথা বলেন। তাঁরা মানবতার জয়গান গেয়ে যান। অন্যদেরকেও তাওহীদ ও মানবতার পথে আহ্বান জানান। তাঁদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। তীব্র থেকে তীব্রতরে রূপ নেয়। অবশেষে তাঁরা আল্লাহর নির্দেশে মাতৃভূমি ছেড়ে দূর-দিগন্তে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন। প্রথমে একদল হাবাশায়(বর্তমান ইথিওপিয়ায়) পাড়ি জমান। পরবর্তীতে নবীজীর নির্দেশে ইসলামের পতাকাকে সবকিছুর উর্ধ্বে তুলে ধরার দৃপ্ত প্রয়াসে মাতৃভূমির সকল ভালবাসা বিসর্জন দিয়ে “সোনার মদীনায়” গমন করেন। এটাকেই পরিভাষায় “হিজরত” বলে এবং এখান থেকেই হিজরী সালের সূচনা।

আমাদের বিশ্বাস, নবীজীর কঠিন ত্যাগ আর সাহাবীদের সীমাহীন কুরবানীর সাক্ষীরুপেই বছর গণনার এ ধারার প্রবর্তন করা হয়েছে। পৃথিবীতে যতদিন সত্য টিকে থাকবে, বাতিলও ছায়ার মত ধাওয়া করে চলবে।এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই সত্যকে সমুন্নত রাখতে হলে দিতে হবে প্রতিনিয়ত কুরবানী,বিসর্জনের পর বিসর্জন। পরীক্ষার পর পরীক্ষা।

পূর্ববর্তি সংবাদভারতের সাথে চুক্তিতে দেশের স্বার্থবিরোধী কিছু নেই: জিএম কাদের
পরবর্তি সংবাদতাস খেলছেন আর ইয়াবা সেবন করছেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা