রাসূলের মহববত ও ভালোবাসা ঈমানের অপরিহার্য অংশ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক ।।

আল্লাহর বান্দাদের উপর আল্লাহর নবী খাতামুন্নাবিয়ীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক হক রয়েছে। সবচেয়ে বড় হক হল তাঁর প্রতি অন্তর থেকে ঈমান আনা এবং পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি এমনকি নিজ প্রাণের চেয়েও অধিক তাঁর প্রতি মহববত রাখা। তাঁর যথাযথ সম্মান করা এবং অনুসরণ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল দ্বীনী আকীদাকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি সত্যিকারের মহববত আর যথাযথ তা‘জীম ও সম্মান হচ্ছে ঈমানের জন্য অপরিহার্য।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু শিক্ষার নিছক অনুসরণ ঈমানদারীর জন্য যথেষ্ট নয়। পশ্চিমা দুনিয়াও তাদের পার্থিব স্বার্থে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক শিক্ষা অনুসরণ করে থাকে। এমন অনুসরণ কখনো যথেষ্ট নয়। বরং তাঁর শর্তহীন আনুগত্য মেনে নেওয়া, তাঁর আদব-ইহতিরাম এবং মহববত ও ভালোবাসা হচ্ছে ফরয এবং ঈমানের অপরিহার্য অংশ। এটা ছাড়া ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। এ প্রসঙ্গে মনে রাখার মতো একটি সংক্ষিপ্ত কথা এই যে, আল্লাহকে ভালোবাসার মানদন্ড আল্লাহ নিজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বানিয়েছেন। কেউ যদি আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে চায় তবে এর একমাত্র পথ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহববত রাখা এবং তাঁর আনুগত্য অবলম্বন করা। এ মানদন্ডে উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

মুমিনের হৃদয়ে নবী-মহববত কী পরিমাণ থাকা উচিত-এ প্রশ্নের উত্তর খোদ কুরআন মজীদে এসেছে-

النَّبِيُّ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ

অর্থাৎ নবীর সঙ্গে ঈমানদারের প্রাণেরও অধিক সম্পর্ক। তিনি তাদের সত্তা থেকেও তাদের কাছে অগ্রগণ্য। (সূরা আহযাব : ৬)

মুমিনের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে মুমিনের যে সম্পর্ক তার প্রকৃতিই ভিন্ন, মাহাত্ম্যই আলাদা। এই সম্পর্কের সঙ্গে পার্থিব কোনো সম্পর্কের কোনো তুলনাই হতে পারে না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানদারের জন্য তার পিতামাতার চেয়েও অধিক মেহেরবান আর তার নিজের চেয়েও অধিক কল্যাণকামী। উম্মতের ঈমানী ও রূহানী অস্তিত্ব নবীর রূহানিয়াতেরই অবদান। যে মমতা ও প্রতিপালন নবীর পক্ষ থেকে উম্মত লাভ করেছে এর কোনো নমুনা গোটা সৃষ্টি-জগতের মধ্যেও পাওয়া যাবে না। পিতামাতা এর দৃষ্টান্ত হতে পারেন না। পিতার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে দান করেছেন দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন আর নবীর মাধ্যমে হাসিল হয় চিরস্থায়ী ‘হায়াত’। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের এরূপ সহানুভূতি ও কল্যাণকামিতার সঙ্গে প্রতিপালন করে থাকেন যে সহানুভূতি ও কল্যাণকামিতা আমাদের নিজ সত্তার পক্ষেও সম্ভব নয়। স্ত্রী-সন্তান এমনকি পিতামাতাও অজ্ঞতা বা অসচেতনতার কারণে কখনো আমাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে, ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে, কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে সর্বদা ওই পথই দেখিয়ে থাকেন, যে পথে রয়েছে তাদের প্রকৃত সফলতা। মানুষ নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করে, নির্বুদ্ধিতার কারণে নিজের ক্ষতি সাধন করে, কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে ওই নির্দেশই দান করেন যাতে বাস্তবিকই তার কল্যাণ রয়েছে। এজন্য উম্মতের উপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হক্ব প্রতিষ্ঠিত যে, তাঁকে নিজের পিতামাতা, স্ত্রীসন্তান এবং প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবাসবে। নিজের মতামতের উপর তাঁর মতামতকে এবং নিজের সিদ্ধান্তের উপর তাঁর সিদ্ধান্তকে অগ্রগণ্যতা দেবে। আর তাঁর আদেশকে শিরোধার্য করবে।

আমাদের জান-মাল সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরূপ অধিকার রয়েছে, যা পৃথিবীতে আর কারো নেই। শাহ আব্দুল কাদের দেহলভী রহ.-এর ভাষায়- ‘নবী আল্লাহর নায়েব। ব্যক্তির জান-মালের উপর তার নিজেরও অতখানি কর্তৃত্ব নেই যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রয়েছে। নিজেকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা বৈধ নয়, কিন্তু নবী যদি আদেশ দেন তবে তা ফরয হয়ে যায়।’

উল্লেখিত আয়াতে কারীমার মর্মবাণী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে এভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা ও সন্তানের চেয়ে, সকল মানুষের চেয়ে, এমনকি তাঁর প্রাণের চেয়েও অধিক প্রিয় না হই। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৬৩২; সহীহ মুসলিম ১/৪৯

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তা‘জীম

বড়কে সম্মান করা একটি স্বতঃসিদ্ধ এবং সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। ইসলামও বড়দের সম্মান করার এবং আলিমদের শ্রদ্ধা করতে গুরুত্বের সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছে। তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যাঁকে আল্লাহ সৃষ্টিকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মাকাম দান করেছেন দুনিয়াতে এবং আখিরাতে, আর যাঁকে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামসহ সকল বনী আদমের সাইয়েদ ও সরতাজ বানিয়েছেন, রাববুল আলামীনের পর জগৎবাসীর উপর যাঁর অনুগ্রহই সর্বাধিক, স্বয়ং রাববুল আলামীন যাঁকে রাহমাতুল্লিল আলামীন ও খাতামুন নাবিয়ীন উপাধীতে ভূষিত করেছেন তাঁর তা‘জীম ও সম্মান যে গোটা মানবজাতির জন্য ফরয ও অপরিহার্য হবে তা তো বলাই বাহুল্য।

এখানে যে কথা বলতে চাই তা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সম্মান ও তা‘জীমের বিষয়কে আল্লাহ তাআলা শুধু বড়দের সম্মান করার সাধারণ আদেশের মধ্যেই ছেড়ে দেননি; বরং তাঁর তা‘জীম-সম্মানের বিষয়ে বিশেষ বিশেষ বিধান নাযিল করেছেন। তাঁর আদব-ইহতেরাম আল্লাহ এমন অপরিহার্য করেছেন যে, এটা ছাড়া কারো ঈমান তাঁর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। এমন সকল কথা-কাজ, আচার-আচরণ আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন এবং লা‘নত ও অভিশাপের কারণ সাব্যস্ত করেছেন যা নবীকে কষ্ট দেয়। আদব-ইহতিরামের যে বিষয়গুলোতে মানুষ কখনো অসচেতন হতে পারে সেগুলো সম্পর্কে কুরআনী আয়াতে স্পষ্ট নির্দেশ দান করেছেন আর তা পালনে যত্নবান হতে আদেশ করেছেন। আর সাবধান করে দিয়েছেন, এর অন্যথা হলে আশঙ্কা রয়েছে যে, সকল আমল বিনষ্ট হবে।’ -সূরা আ‘রাফ ১৫৭; সূরা ফাত্হ ৯; সূরা হুজুরাত ১-৫; সূরা নূর ৬৩; সূরা আহযাব ৫৩, ৫৬-৫৮; সূরা তাওবা ৬১; সূরা বাক্বারা ১০৪; সূরা নিসা ৪৭

মহববত এবং তা‘জীমের বিষয়টি শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহববত ও তা‘জীমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁর সঙ্গে যাদের বিশেষ সম্পর্ক আর যে জিনিসগুলো তাঁর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত তাদের সঙ্গেও মুমিনের ভালোবাসার সম্পর্ক হওয়া জরুরি। প্রেম-ভালোবাসার ধর্ম হচ্ছে প্রিয়জনের যা কিছু প্রিয় তার সঙ্গেও ভালোবাসা হবে। তাহলে নবীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সকল কিছুর সঙ্গে মহববতের সম্পর্ক কায়েম হওয়া নবী- মহববতের স্বাভাবিক দাবি, আর শরীয়তও এর তাকীদ করেছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামের তা‘জীম

যে কোনো মানুষের নামই তার স্বত্তার পরিচয় বহন করে থাকে। সে নাম ধরেই তাকে স্মরণ করা হয় আবার সে নামেই সে পরিচিতি লাভ করে। এ জন্য কারো নাম তার সত্তা থেকে ভিন্ন কিছু নয়। নামের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন মূলত ব্যক্তির প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন। অনুরূপভাবে কারো নামের প্রতি বিরূপভাব ও অবজ্ঞা প্রকাশ মূলত ব্যক্তিরই প্রতি বিরূপ ও অবজ্ঞার শামিল।

শরীয়ত যে কোনো বস্ত্ত বা ব্যক্তির নাম সম্পর্কে বহু আহকাম প্রদান করেছে। এ সম্পর্কে কুরআনে হাকীমের একাধিক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। আর হাদীসের কিতাবসমূহে তো এ সম্পর্কে এক বড় ও স্বতন্ত্র অধ্যায়ই বিদ্যমান রয়েছে। নাম সম্পর্কিত শরয়ী আহকামসমূহের মধ্যে একটি হলো এই যে, কোনো নামেরই বিকৃতি ঘটানো যাবে না এবং তা নিয়ে বিদ্রূপও করা যাবে না। তবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামের ব্যাপারটি সাধারণ এ হুকুম থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও বহু ঊর্ধ্বে। কেননা, তাঁর নামের বিষয়টি হলো সরাসরি দ্বীন ও ঈমানের বিষয় এবং ইসলামের শিআর ও নিদর্শন। এ নামের তা‘জীম করেছেন স্বয়ং আল্লাহ রাববুল আলামীন, তাঁর ফেরেশতাগণ এবং তিনি নিজেই এ নামের তা‘জীমের নির্দেশ প্রদান করেছেন।

আর এর চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে যে, আল্লাহ তাআলা কালেমায়ে তাওহীদ, কালেমায়ে শাহাদাত, যা ঈমানের কালেমা ও শিআরে ইসলাম, তাতে নিজের নামের সঙ্গে রাসূলের নাম যুক্ত করেছেন। আযানে ও নামাযের তাশাহহুদে প্রিয়তমের নামও শামিল করেছেন। সূরা ‘আলাম নাশরাহ’-এর আয়াতের

وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ

‘আর আমি আপনার আলোচনা সমুচ্চ করেছি’ এই ইলাহী ইকরামের কথা বলা হয়েছে। আমরা কি কখনো ভেবেছি, প্রতিদিন পাঁচবার কত লক্ষ মসজিদের মিনারে মিনারে ধ্বনিত হয় ‘আল্লাহু আকবার’। আর তারই সঙ্গে ধ্বনিত হয় ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’র সুমধুর ধ্বনি। কিংবা এভাবেও কি ভেবেছি যে, যে নামের কালেমা পাঠ করে মানুষ ঈমানদার হয় আর যে নামের কালেমা অস্বীকার করে ঈমান হারায় তার মাহাত্ম্য কতখানি। এ নামের সঙ্গে সামান্যতম বেআদবী কত বড় অপরাধ। বলাবাহুল্য, এটা এমন কোনো অস্পষ্ট বিষয় নয় যা বোঝানোর প্রয়োজন হতে পারে।

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মোবারকের তা‘জীমের আরেকটি দৃষ্টান্ত এই যে, তাঁর নাম উচ্চারিত হলে দরূদ পাঠের আদেশ করেছেন এবং জিব্রীলের আ. যবানীতে এই বদদুআ করিয়েছেন যে, ‘যার সামনে হাবীবে পাকের আলোচনা হয়, অথচ সে দরূদ পড়ে না তার বিনাশ হোক।’

এরপর বদদুআর উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানে আমীন বলিয়েছেন। -সহীহ ইবনে খুযাইমা, সহীহ ইবনে হিববান, দেখুন আলকাওলুল বাদী পৃ. ২৯২-২৯৮

আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদের কোথাও তাঁর হাবীবকে নাম ধরে সম্বোধন করেননি। অন্য বান্দাদের আদেশ করেছেন, তারা যেভাবে নিজেদের মধ্যে একে অপরকে নাম ধরে কিংবা পারিবারিক, বংশীয় বিভিন্ন সম্পর্কের ভিত্তিতে সম্বোধন করে থাকে।’ সেভাবে যেন রাসূলকে সম্বোধন না করে।-সূরা নূর : ৬৩

আর এটা বাস্তব যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা সম্পর্কে তিনিই সবচেয়ে বেশি অবগত, যিনি তাঁর স্রষ্টা এবং যিনি তাঁকে এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছেন। রাসূলের উম্মতী যতই তাঁর মাহাত্ম্য বয়ান করুক শেষে অক্ষমতা স্বীকার করে বলতে হয়-

دامن نگہ تنگ وگل حسن تو بسيار

گلچيں تو از تنگئى دامن گلہ دارد

ভাবনার আস্তীন খাটো কিন্তু সৌন্দর্যের ফুল অনেক, কিংবা বলতে হবে-

بعد از خدا بزرگ توئى قصہ مختصر

খোদার পরেই তোমার মকাম।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’টি নাম

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেকগুলো গুণবাচক নাম রয়েছে। তবে তাঁর ব্যক্তি নাম দু’টি। ‘মুহাম্মাদ’ ও ‘আহমদ’। উভয় নামের মূল ধাতু এক, ‘হামদ’। এটি প্রশংসা, সম্মান, শোকর ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ করে।

এ বিষয়গুলোর প্রকৃত হক্বদার হলেন আল্লাহ তাআলা। সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য। যে সব গুণ  বা বৈশিষ্ট্যের উপর কারো প্রশংসা করা হয় তা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই প্রশংসা। কেননা, আল্লাহই তাঁকে নিজ অনুগ্রহে সে কাজের তাওফীক দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলার ‘আসমায়ে হুসনা’র মধ্যে একটি হচ্ছে ‘হামীদ’। এরও মূল ধাতু  ‘হামদ’। অর্থাৎ যে সত্তা চির প্রশংসিত, যিনি সকল প্রশংসার প্রকৃত অধিকারী, যেখানে যারই প্রশংসা করা হোক তা তাঁরই প্রশংসা।

আল্লাহ তাআলা তাঁর পাক নাম ‘হামীদ’ থেকে নির্গত দুই নাম ‘মুহাম্মাদ’ ও ‘আহমদ’কে তার হাবীবের নাম বানিয়েছেন। ‘মুহাম্মাদ’ অর্থ ‘অতি প্রশংসিত’। আর ‘আহমদ’ শব্দের অর্থ দু’টি-এক অর্থ অনুযায়ী তা ‘মুহাম্মাদ’-এর সমার্থক অর্থাৎ অতি প্রশংসিত। আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে ‘সর্বাধিক প্রশংসাকারী’।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম ‘মুহাম্মাদ’ কেন? এজন্য যে, তিনি আল্লাহর কাছে প্রশংসিত, ফেরেশতাদের মাঝে প্রশংসিত, পৃথিবীবাসীর নিকটে প্রশংসিত, যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে তাদের কাছে প্রশংসিত, এমনকি যারা ঈমান আনেনি তাদের কাছেও তিনি তাঁর গুণ ও মাহাত্ম্যের, চরিত্র ও মহানুভবতার কারণে প্রশংসিত। সৃষ্টির মধ্যে যাঁর প্রশংসা সবচেয়ে বেশি করা হয়েছে আর জগৎ-সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত যাঁর প্রশংসা অব্যাহত রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে তিনি হলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর নাম ‘মুহাম্মাদ’ তিনি প্রশংসিত। আর প্রশংসা, হামদের সঙ্গেই তাঁর চিরন্তন সম্পর্ক। ময়দানে হাশরে যে স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি শাফায়াত করবেন সে স্থানের নাম ‘মাকামে মাহমূদ’। সেদিন ‘লিওয়ায়ে হামদ’- প্রশংসার ঝান্ডা তাঁর মুবারক হস্তেই উড্ডীন থাকবে।

তিনি মুহাম্মাদ, কুল মাখলুক তাঁর প্রশংসাকারী। তিনি আহমদ, স্রষ্টার প্রশংসায় সবার চেয়ে অগ্রগামী। মরুভূমির বালুকারাশি আর আসমানের মেঘমালা যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত তার চেয়েও অধিক বিস্তৃত করেছেন তিনি রাববুল আলামীনের হামদ ও ছানা। (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মানিত নামসমূহের ব্যাখ্যা ও মর্ম জানার জন্য দেখুন ‘রহমাতুল লিল আলামীন’ মাওলানা মুহাম্মাদ সুলায়মান মানসুরপুরী, খ. ৩ পৃ. ১৪-১৫, ১৭৮-১৯৮)

এ নামের সঙ্গে উম্মতের প্রীতি ও ভালোবাসা

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে আরব ভূখন্ডে কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে কারো নাম ‘আহমদ’ রাখা হয়নি। মুহাম্মাদ নামটিও তাঁর আগমনের আগে প্রসিদ্ধ ছিল না। তাঁর আবির্ভাবের নিকটবর্তী সময়ে তাঁর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তিতে কেউ কেউ তাদের সন্তানের নাম ‘মুহাম্মাদ’ রেখেছিল। এদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে পাঁচ-সাত জন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর লোকেরা আদরের সন্তানের নাম মুহাম্মাদ বা আহমদ রাখা সৌভাগ্যের বিষয় মনে করেছে। মুহাম্মাদ নামের অনেক মানুষের নাম-ধাম, কীর্তি ও অবদান ইতিহাসের পাতায় এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। উম্মতের যে শ্রেণী ইলমে দ্বীনকে ধারণ করেছেন ও বর্ণনা করেছেন তাদের জীবন ও কর্মের ইতিহাস সংরক্ষণ করার জন্য মুসলিমগণ এমন এক ‘শাস্ত্র’ উদ্ভাবন করেছেন, যা কমবেশি চল্লিশটি শাখায় বিস্তৃত। এ শাস্ত্রের নাম ‘ইলমু আসমাইর রিজাল’। এ শাস্ত্রের অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ হচ্ছে, ‘তাকরীবুত তাহযীব’। এতে সাহাবী যুগ থেকে হিজরী তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালের হাজারো মনীষীদের মধ্য থেকে একটি সংক্ষিপ্ত জামাতের আলোচনা স্থান পেয়েছে। এতে ‘মুহাম্মাদ’ নামের সাতশ’রও অধিক আর ‘আহমদ’ নামের শতাধিক ব্যক্তির আলোচনা এসেছে। এরা সবাই ছিলেন কুরআন-সুন্নাহর আলিম। তাঁদের অনেকেই হলেন সাহাবী, তাবেয়ী এবং উম্মাহর বিশিষ্ট ইমাম।

ইমাম বুখারী রহ. (১৯৪-২৫৬ হিজরী)-এর ‘আততারীখুল কাবীর’ হচ্ছে ইলমু আসমাইর রিজালের মাঝারি মাপের গ্রন্থ, তাতে ‘মুহাম্মাদ’ নামের আটশত একাত্তর জন ব্যক্তির আলোচনা রয়েছে। ইমাম বুখারী রহ. এ কিতাবের ভূমিকায় লেখেন, ‘এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের নাম আমি বিন্যস্ত করেছি বর্ণানুক্রমিকভাবে। তবে নিয়মের ব্যতিক্রম করে ‘মুহাম্মাদ’ নামের ব্যক্তিদের আমি সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছি। কেননা, এ নাম আমাদের নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম।’

وإنما بدئ بمحمد من حروف ا، ب، ت ، ث، لحال النبي صلى الله عليه وسلم، لأن اسمه محمد صلى الله عليه وسلم، فإذا فرغ من المحمدين ابتدئ في الألف ثم الباء.

এটা শুধু ইমাম বুখারী রহ.-এরই নীতি নয়, আরো অনেক গ্রন্থকার তাঁদের গ্রন্থ বর্ণানুক্রমিক বিন্যস্ত করার পরও ‘মুহাম্মাদ’ ও ‘আহমদ’ এই দুই নামের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করেছেন এবং এ দুই নামকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন।

হিজরী অষ্টম শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুয়াররিখ (জীবনীকার) আব্দুল কাদের কুরাশী (৭৭৫ হি.) ‘আলজাওয়াহিরুল মুযীআ’তে লেখেন, ‘সমরকন্দের শহর ‘জাকরদীযাহ’তে একটি কবরস্থান আছে যার নাম ‘তুরবাতুল মুহাম্মাদীন’। অর্থাৎ ‘মুহাম্মাদ নামীয় উলামা-ফুকাহার কবরস্থান’। এখানে এমন চারশ উলামা-ফুকাহা সমাহিত আছেন যাঁদের প্রত্যেকের নাম মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ।’ অর্থাৎ তাঁর নামও মুহাম্মাদ, পিতার নামও মুহাম্মাদ।

হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ইমাম আবুল হাসান আলমারগিনানী (৫৯৩ হি.) যাঁর রচিত গ্রন্থ ‘আলহিদায়া’ সুবিখ্যাত ও সর্বজনসমাদৃত, ইন্তেকালের পর তাঁকে সমাহিত করার জন্য ওই কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু কবরস্থানের দায়িত্বশীলরা বিনয়ের সঙ্গে বলে দেন যে, ‘হযরতের নাম তো মুহাম্মাদ নয়।’ পরে নিকটবর্তী একস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

মোটকথা, এ নামের সঙ্গে মুসলমানের হৃদয়ের সম্পর্ক সাহাবী-যুগ থেকে আর তা কিয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে ইনশাআল্লাহ। অনেক ভাগ্যবান পিতা রয়েছেন যারা তাদের সকল

সন্তানের নাম ‘মুহাম্মাদ’ রেখেছেন। এরপর পার্থক্যের জন্য নামের সঙ্গে আওয়াল (প্রথম) ছানী (দ্বিতীয়) যোগ করেছেন।

পাক-ভারত-বাংলা অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম থেকে বরকত হাসিলের দু’টি পন্থা প্রচলিত আছে। সন্তানের নাম মুহাম্মাদ রাখা কিংবা অন্য নাম রাখা হলেও নামের শুরুতে ‘মুহাম্মাদ’ শিরোধার্য করা। আমাদের এ অঞ্চলে দ্বিতীয় পদ্ধতিই অধিক প্রচলিত।

পূর্ববর্তি সংবাদ‘তোর কারণে আমাদের ফাঁসি হয়েছে’ বলে সিরাজকে মারধর
পরবর্তি সংবাদএকদিন পর ছাড়া পেলেন কলরব শিল্পী বদরুজ্জামান