হাফীদ মানযুর ।।
এ দেশের অন্যতম মুরব্বি আলেম। ময়মনসিংহের উলামায়ে কেরামের মুরব্বি বলা হয় তাঁকে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের শ্রদ্ধেয় ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলূম, (তালতলা মাদরাসা), ময়মনসিংহ-এর মুহতামিম। তিনি মাওলানা আব্দুর রাহমান হাফিজ্জী।
৭ অক্টোবর-২০১৯ বাদ যোহর। তালতলা মাদরাসায় গিয়েছিলাম। জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলূম দেশের প্রসিদ্ধ একটি মাদরাসা। বিস্তৃত জায়গা নিয়ে সুদৃশ্য আঙ্গিনা। জামিয়ার দফতরে হযরতের সঙ্গে সাক্ষাত। নম্র স্বাভাবের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। অত্যন্ত বিনয়ী একজন মানুষ। তিনি বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের বড় বড় বেশ ক’জন আলেমের সোহবত লাভ করেছেন বিভিন্ন সময়। বিশেষত ছাত্র যামানায়। তাঁদের শিষ্যত্ব লাভে ধন্য হয়েছেন। উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ হাফেজুল হাদীস হযরত মাওলানা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী (রহ.)-এর কাছে পড়েছেন তাফসীর । পড়েছেন ইদ্রীস কান্ধলভী (রহ.)-এর কাছেও। হাদীসের দরস নিয়েছেন প্রসিদ্ধ শায়খুল হাদীস হযরতুল আল্লামা রসুল খান (রহ.) থেকে। তাঁর সঙ্গে সেদিন কথা উঠিয়েছিলাম তাঁর ঘনিষ্ঠতম উস্তায হাফেজুল হাদীস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী (রহ.)-এর সান্নিধ্যের স্মৃতি নিয়ে। প্রিয় উস্তাযের কথা বলতেই নড়েচড়ে উঠলেন তিনি।
স্মিত হাসলেন। কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, তিনি আমার মুশফিক তরীন (অত্যন্ত অনুগ্রহশীল) উস্তায ছিলেন।’
তিনি বলে চলেছেন আবেগ ও ভালোবাসার ভাষায়-‘ ১৯৬৮ সনের কথা। জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া, লালবাগ, ঢাকা থেকে দাওরায়ে হাদীস শেষ করি। পরে তদানিন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের জামিয়া আশরাফিয়া লাহোরে দ্বিতীয়বার দাওরায়ে হাদীস পড়ি। সে সময় পাকিস্তানে দুইজন মনীষীর তাফসীর পড়ানোর সুনাম ছিল। আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী সাহেব এবং আল্লামা গোলামুল্লাহ খান সাহেব। তাঁরা শবে বরাতের পর থেকে দেড় মাসব্যাপী তাফাসীর কোর্স করাতেন। পরামর্শক্রমে আমি হযরত দরখাস্তী সাহেবের তাফসীর কোর্সে ভর্তি হয়ে যাই।’
প্রিয় উস্তাযের স্মৃতিচারণে প্রবীণ মণীষী বুযুর্গ আবদুর রহমান হাফেজ্জী যেন ডুব দিলেন। তিনি বলছেন- ‘যতটুকু মনে পড়ে, হজরতকে তখনই আমি প্রথম দেখি। আমার সৌভাগ্য, আমি যেখানেই পড়েছি উস্তাযগণের অত্যন্ত শফকত পেয়েছি। হজরত দরখাস্তী সাহেবের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। মাত্র দেড় মাসের কোর্স করেছি। তাঁর দীর্ঘ সোহবত নেওয়ার সুযোগ হয়নি। এর মাঝেই হযরত আমাকে আপন করে নেন। আমার প্রতি তাঁর শফকত ছিল সীমাহীন। তিনি এমনিতেও ছাত্রদের খুব স্নেহ করতেন। তবে আমার বেলায় স্নেহের মাত্রাটা ছিল ঢের বেশি। সেই শফকতের কথা মনে হলে এখনও আপ্লুত হয়ে যাই।’
তিনি বললেন, ‘আমার ভাষায় আমি বলি, ‘তাঁর সঙ্গে আমার বেলা হিজাব সম্পর্ক ছিল।’কীভাবে মহব্বত হলো সে ব্যাখ্যা দিতে পারবো না। আল্লাহর বিশেষ রহমতে আমার প্রতি হজরতের নেক নজর পড়ে। তাঁর মধুর স্মৃতিগুলো এখনো যেন চোখের সামনে ঝলমল করছে। হজরতের কাছে কোনো হাদিয়া এলে প্রথমে আমাকে হাতভরে দিতেন। পরে অন্যদের মাঝে বিতরণ করতেন।’
‘পড়ালেখা শেষ করে আমি দেশে ফিরে এসে মাদরাসায় শিক্ষকতায় যোগ দিই। ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তখন আমি ময়মনসিংহ শহরের পশ্চিমে খাগডহর জামিয়া আশরাফিয়ায় শিক্ষকতা করি। যুদ্ধের কারণে মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ময়মনসিংহ শহরে তখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা তাবলীগ জামাতের একটি কাফেলা অবস্থান করছিল। তাদের বয়ানে তাশকীল হয়ে আমি প্রথমে তিন দিনের জন্য তাবলীগে বের হই। পরে অবশ্য সেই যাওয়াতেই ষোল মাস পশ্চিম পাকিস্তানে সময় লাগাই। যুদ্ধ যখন কঠিন রূপ ধারণ করে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙ্গালীদের নিরাপত্তা কমে যায়। আমার সাথেও হুমকিমূলক একটি ঘটনা ঘটে। ভয় ও সতর্কতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত তাবলীগের সকল বাঙ্গালী সাথীকে রায়বেন্ড মারকাযে এনে রাখা হয়। আমাদেরকে বাইরে পাঠানো হতো না। আমরা মারকাযে থেকেই আমল করতাম। ’
যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে তাবলীগে সময় দেওয়ার সময় আবার হজরত আবদুল্লাহ দরখাস্তী রহ.-এর সঙ্গে সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়ে হাফেজ্জী বলেন, ‘কিন্তু এভাবে আর কত দিন ! অলস সময় কাটাতে আমার ভাল লাগছিল না। তখন আমি আবার হযরত দরখাস্তী সাহেবের সোহবতে যাই। তাঁর তাফসীরের দরসে অংশ নিই। অবশ্য তাবলীগের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান গিয়ে প্রথমেই একবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করে দোয়া নিয়ে এসেছিলাম। একসময় দেশে ফেরার সুযোগ হয়। দেশে ফেরার সময় হযরতের আচরণ আমাকে এখনো মোহিত করে রাখে। আমি এবং নেত্রকোণার মাওলানা মুসলিমুদ্দীন সাহেব হযরতের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাত করতে যাই। তিনি তখন পেশাওয়ার যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমাদের দেখে খুশি হয়ে বললেন, ‘হা ভাই, হামভি পেশাওয়ার যারাহা হোঁ। আল্লাহ তাআলানে তোমকো সাথী করকে ভেজ দিয়া।”(আমিও পেশওয়ার পাচ্ছি, আল্লাহ তোমাদেরকে আমার সফরসঙ্গী করে পাঠিয়েছেন।)’
‘আমরা হজরতের সঙ্গে রওয়ানা হই। রহিমইয়ার জেলা থেকে ট্রেন যুগে পেশাওয়ারের উদ্দেশে সফর। আমরা যাব লাহোরে। অতিরিক্ত ভীড়ের কারণে হযরতের সঙ্গে এক কোচে উঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মুলতান স্টেশনে গিয়ে ট্রেন দাঁড়ালে আমরা তাঁর সঙ্গে মিলিত হই। তখন তিনি বলেন, “তোম কাহা গুম হো গায়ে’। এ সময় হজরতের সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গ সময় কাটে। অনেক কথাবার্তা হয়। তাঁর সোহবত পেয়ে উপকৃত হই। লাহোরে এসে আমাদের বিদায়ের পালা। হযরত এই ট্রেনে আরো সামনে যাবেন।’
হজরত আবদুল্লাহ দরখাস্তী সাহেবের সঙ্গে বিদায়ের আবেগঘন বর্ণনা দিয়ে বললেন- ‘গিয়েছিলাম পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে। এখন ফিরবো পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে। এ বিদায়টা আগের চেয়ে একটু ভিন্ন। বিচ্ছেদের কথা মনে হয়ে বুকটা ধুক ধুক করে উঠলো। হযরতের চেহারার দিকে তাকাই। দেখি বিদায়ের বেদনায় তিনিও কাতর। চোখের পানি ছলছল করছে। যেনো পিতা -পুত্রের বিদায়। অবশেষে আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলেন না। আমিও পারলাম না। এরপর বললেন, “আওর কুচ বাকি রাহ্ গিয়া?” (আরো কোনো কিছু কি বাকি রয়ে গেলো?) কিছু সময় চুপ রইলেন। অতঃপর ব্রিফকেছ খুলে তাঁর ব্যবহৃত একটি রুমাল আমার মাথায় বেঁধে দিলেন। এরপর বিদায় দিলেন।’
‘উসতাযে মুহতারামের স্নেহের মধুর স্মৃতিগুলি মনে হলে নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হয়, অনেক গর্বিত মনে হয়। দেশ ভিন্ন হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তান হয় বাংলাদেশ। দেশ ভিন্ন হওয়ায় যোগাযোগও একটু কঠিন হয়ে যায়। সব কিছুর পরও উসতাযে মুহতারামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। পত্রের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ হতো। তাঁর বরাবর আমি ‘বেলা হিজাব’ পত্র লেখতাম। তিনিও স্নেহের সম্বোধন করে উত্তর দিতেন।’
হযরত মাওলানা আবদুর রহমান হাফেজ্জী বলেন, ‘মাওলানা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী (রহ.) ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম- পাকিস্তান’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই সুবাদে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। আমার যতটুকু মনে পড়ে, হযরত যতবার বাংলাদেশ এসেছেন আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। ময়মনসিংহ এসে তিনি আমার বাসায়ও গিয়েছেন। বাসায় তাঁকে নাশতার সঙ্গে ‘দুধকদু’ নামের একটা বিশেষ খাবার দেওয়া হয়েছিল। দুধকদু হযরতের খুব পছন্দ হয়। ফিরে যাওয়ার সময় বলেন, “আবদুর রাহমান! তুমি থাকো, আবার ‘দুধকদু’ তৈরি করে আমার জন্য ঢাকায় নিয়ে এসো।”
‘এরপর আমি দুধকদু তৈরি করে ঢাকায় নিয়ে হযরতের সামনে পেশ করেছিলাম। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন।’
‘আমার বড় ছেলের জন্ম হলে হযরতকে ছেলে সন্তান হওয়ার সংবাদ দিই। তখন তিনি বলেন, নাম কী রেখেছো? আমি বলি ‘মুহাম্মাদ’। তখন তিনি মহব্বতের ভাষায় বলেন, আমার নাম ‘আব্দুল্লাহ’। তোমার সন্তানের নাম আমার নামেও রাখতে পারতে!’ আমি তখনই নিয়ত করি আল্লাহ আমাকে আরেকটি ছেলে সন্তান দিলে হযরতের নামে নাম রাখব। রেখেছিও। আলহামদুলিল্লাহ, হযরতকে সেই সংবাদ দেয়ারও সৌভাগ্য হয়েছে।’
তিনি শেষ বিদায়ের স্মৃতি উল্লেখ করে বলেন, ‘ইন্তেকালের আগে হজরত আবদুল্লাহ দরখাস্তী রহ. একবার বাংলাদেশ সফরে আসেন। তখন তাঁর স্মৃতিশক্তি কিছুটা লোপ পেয়ে গেছে। ঢাকা যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় অবস্থান করছিলেন। হজরতের ছাত্র ও প্রিয় ব্যক্তিরা তাঁর সোহবতে আসেন। আমিও যাই। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে বলেন, ‘এক হে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, আওর এক হে হাফেজ আব্দুর রাহমান। ’ আমরা সামনে গিয়ে মোসাফাহা করি। তখন হযরত হেসে দিয়ে আমার গালে হালকা করে মহব্বতের একটি থাপ্পর দিয়েছিলেন। হযরতের এই শফকতে নিজেকে অনেক সম্মানিত বোধ করেছিলাম।’
মাওলানা হাফেজ্জী বলেন, ‘মুরব্বিরা এখন আর নেই। কালের আবর্তণে মানুষ এখন আমাদেকে বড় মনে করে, মুরব্বি হিসেবে মূল্যায়ন করে। আমি মনে করি, আসাতিযায়ে কেরাম এবং মুরব্বিদের দোয়া আমাকে এপর্যায়ে এনেছে। মূলত তাদের মতো উস্তাযগণের শফকত এবং নেক দোয়াই আমার জীবনের বড় পুঁজি। আল্লাহ আমার সকল আসাতিযায়ে কেরাম এবং মুরব্বিগণকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন। আমীন।’
স্মৃতির এই মজলিসটি ছিল অত্যন্ত আবেগপূর্ণ। তন্ময় হয়ে তাঁর স্মৃতিচারণের কথাগুলো শুনছিলাম। উপমহাদেশ বিখ্যাত পাকিস্তানি আলেম মণীষী আল্লামা আবদুল্লাহ দরখাস্তী রহ.-এর স্মৃতিচারণ করছিলেন বাংলাদেশের সত্তরোর্ধ আরেক বরেণ্য বুযুর্গ আলেমেদ্বীন। উস্তায- শাগরিদের এই বরকতময় সম্পর্কের নুরানী স্নিগ্ধতা বুকে নিয়ে মজলিস থেকে ধীরে ধীরে উঠে এলাম।