আলেম এবং ইংরেজি শিক্ষিত দ্বীনদার: সংঘাত-ভালোবাসার গল্প

মুহাম্মদ আদম আলী ।।

এক।

জীবন এখন খুব কঠিন। বাঁচার জন্য যেমন, মরার জন্যও। মরে গেলে যদি সব শেষ হয়ে যেত, তাহলে মরা কঠিন হতো না। অবশ্য সবার নিকট মরার পর কি হবে, এ নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা নেই। তাদের এই নিশ্চিন্ত ভাবই দুনিয়ায় বাঁচার দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে। এটি মানুষকে বেপরোয়া করে তুলেছে। কেউ বেপরোয়া হয়ে গেলে তার লাজ-লজ্জা কিছু থাকে না। আর একবার সেটি হারালে আর ফিরেও আসে না। আধুনিক শিক্ষিতরা এই কাতারে এগিয়ে।

শিক্ষা আর কুশিক্ষায় পার্থক্য আছে। বিদ্বান হয়েও মানুষ এখন দুশ্চরিত্রের। চরিত্রের বুলি আওরিয়েছে ঠিকই, কিন্তু চরিত্রবান কাউকে দেখেনি, শেখেওনি। সেক্যুলার শিক্ষায় এটিই স্বাভাবিক পরিণতি। বাড়ির প্রহরীরাই তার বন্দীদশা ডেকে আনে। সমীকরণ খুব সহজ। সেক্যুলার শিক্ষা মানে আধুনিক বা প্রগতিবাদী শিক্ষা। সেখানে স্বভাবতই ধর্ম নেই। তারা নাস্তিক্যবাদ শিক্ষা দেয় না। তবে কিছু বাকিও রাখে না। ধর্মহীন শিক্ষা অধর্মের দিকে নিয়ে যায়। অধর্মে সবই সম্ভব। তখন চরিত্র হারানো খুবই নগণ্য ব্যাপার।

জীবন যখন পড়ন্ত বিকাল, তখন অনেকে ধর্ম-কর্মের দিকে ঝুঁকে। আর্মির কর্ণেল বা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল অথবা বিসিএস ক্যাডারে সর্বোচ্চ শিখরে ওঠা সেক্রেটারি এলাকার মসজিদ কমিটিতে ঢোকার আপ্রাণ চেষ্টা কের। সারাজীবন হুযুরদের ঘৃণা করে হুযুরদেরই পাল্লায় পড়ে। এ দশা বিদিশা হয়ে ওঠে—না মিশতে পারে, না তাদের মেনে নিতে পারে। ফলে সেক্রেটারি-ভাব আর যায় না। মাঝখান থেকে থুতনিতে কিছু দাড়ি ওঠে এবং কোট-টাইয়ের সঙ্গে মাথায় কোনোমতে একটা টুপি তেরসা হয়ে ক্ষণিকের জন্য জায়গা খুঁজে পায়! তাদের আর হুযুরদের ভালোবাসা হয় না।

আমরা এখন মূল টপিকে এসেছি। হুযুরদের ভালোবাসাই আলোচনা বিষয়। আলোচনাটা কঠিন। আমি প্রবন্ধ লিখছি, না গল্প লিখছি—ঠিক জানি না। আমাকে লেখতে বলা হয়েছে—লিখে যাচ্ছি। অবশ্য হুকুমে কলম চলে না। যিনি চালান, তার প্রিয়রা কেউ বললে তিনি ফেরান না। কলম চলতে থাকে। একজন প্রিয় মানুষ এ বিষয়ে কলম ধরতে বলেছেন। ধরেছি। লেখা শেষ না হলে বলা যাচ্ছে না এটি কি হয়েছে। তবে উপকারী কিছু লেখার তাওফীক চাই।

কঠিন আলোচনার শুরুতে এতক্ষণ ভূমিকা লিখেছি। এটিকে ভূমিকা না বলে ‘ভাব’-ও বলা যায়। মূলত এরকম ভাব এখন প্রায় সবাই নেন। এর মধ্যে আলেমরাও আছেন। এই হলো এক সমস্যা। ভাব দেখলে স্বভাব আর মনে ধরে না। তারা এখন অনেক দলে বিভক্ত। ভালো-মন্দ, আসল-নকল, খাঁটি-ভ- ইত্যাদি। সুতরাং যাদের নিয়ে আলোচনা, তাদের ঠিক কোন দলকে নিয়ে এগুবো? এর সহজ সমাধান দিয়েছেন এ যুগের একজন নন-আলেম; প্রফেসর হযরত হামীদুর রহমান সাহেব। তাকে নন-আলেম বলা হলো প্রচলিত অর্থে। বাস্তবতা ভিন্ন। সেটি নিয়েও আলোচনা হবে। তিনি একটা ঘটনা বলেন।

একবার এক বড় ব্যবসায়ী হযরতের কাছে এলেন। তার ছেলেকে মাদরাসায় পড়াবেন। ভালো মাদরাসা খুঁজে পাচ্ছেন না। যেখানেই যান, সেখানেই হুযুরদের এই দোষ, সেই দোষ। কাউকেই মনে ধরে না। প্রফেসর নিজে কিছু বললেন না। তাকে নিয়ে গেলেন বাইতুল মুকাররম মসজিদের খতীব মাওলানা উবায়দুল হক রহ.-এর কাছে। সেখানে গিয়েও ব্যবসায়ী ভদ্রলোক হুযুরদের নানা দোষের চর্চা করতে লাগলেন। তখন খথীব সাহেব একটা কথা বললেন। তিনি বলেলেন, ‘আমরা হুযুররা ড্রেনের পানি। আসল পানি পাইতে গেলে এই ড্রেনের ভেতর দিয়েই যেতে হবে।’ এই কথাটাই জায়গায় জায়গায় প্রফেসর সাহেব বর্ণনা করেন। তিনি আরও বলেন, খাঁটি আলেম পাইতে চাইলে সবধরনের আলেমদের সম্মান করা চাই। কারণ রিসালতের আসল দৌলত তাদের কাছেই রয়েছে। অন্য কোনোখানে বা অন্য কারও কাছে সেই দৌলত আশা করা বৃথা।

দুই।

আমরা আমরাই। নন-আলেম। আমাদের বিদ্ধা-বুদ্ধি আছে। তবু উলামায়ে কেরাম আমাদের মূর্খ বলেন। দ্বীনের জ্ঞান না থাকাতে এই উপাধি জুটেছে। আমরা অবশ্য উপাধিটাকে খুব সাদরে গ্রহণ করেছি, এমন নয়। কারণ, আমিও কিছু…এ ভাবটা আমাদের সহজে যায় না। পুরোপুরি যাওয়ার দরকার আছে বলেও মনে হয় না। তাতে নিজের যোগ্যতা নিয়ে মানুষ সন্দীহান হয়ে উঠে। তখন আর কিছু করতে ইচ্ছে করে না, পারেও না। বরং যেটুকু আছে, সেটুকু দিয়ে সহজেই দ্বীনের জ্ঞান অর্জনে কাজে লাগানো যায়। সত্যিকার মূর্খদের এ ক্ষমতা নেই। এজন্য উলামায়ে কেরামের মধ্যে যারা সচেতন, তারা আমাদের সহজে মূর্খ বলেন না। একটু রয়ে-সয়ে কথা বলেন। এতে তাদের অনেক কষ্ট হয় ঠিকই, তবু আমরা দূরে সটকে পড়ি না। দীর্ঘদিন ধরে মেধা চর্চার যে অভ্যাস রয়েছে, সেটিকে দ্বীন-চর্চায় কাজে লাগানোর সুযোগ হয়। আমরা ভালো না হলেও ভালো হওয়ার স্বপ্ন দেখি।

দ্বীন চর্চায় প্রথম কাজ দ্বীনের দিকে আগ্রহী হওয়া। তারপর আলেমদের কাছে যাওয়া, তাদের সঙ্গে থাকা এবং এ অবস্থা আমরণ বজায় রাখা। যারা রাসূল সা.-এর রেখে যাওয়া সম্পদের উত্তরাধীকারী, তাদের কাছে না গেলে সে সম্পদের কিছুই জুটে না। রাসূল সা.-এর সম্পদই দ্বীন—কুরআন-হাদীসের জ্ঞান। নিজে নিজে স্টাডি করে ‘শিখেছি’ বলে মনে হয়, কিন্তু এটি সেই ‘আমিও কিছু’-এর মতোই। দুনিয়ার জ্ঞান অর্জন করে কিছু মনে করার সুযোগ থাকলেও ইংরেজি শিক্ষিতদের জন্য দ্বীনী-জ্ঞানে সেটি বলার সুযোগ নেই। আপনি সেক্যুলার শিক্ষা যে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শিখেছিলেন, এখানে সেটি না করে একই দাবি করা আরেক মূর্খতা। আমরা অনেকেই এমন করি। আর তখনই আমরা সত্যিকার মূর্খ হয়ে উঠি। এই মূর্খতা বাস্তবিক মূর্খদের থেকেও নিম্ন মানের। এরা মূলত আলেমদের ভালোবাসতে পারেন না—সেই আলেম যত বড়ই হন না কেন।

লেখক: প্রফেসর হজরত হামীদুর রহমানের খলিফা, সাবেক কমান্ডার নৌবাহিনী, সাহিত্যিক

পূর্ববর্তি সংবাদভারতে মুসলমানরা কারও দয়ায় বসবাস করে না: ওয়াইসি
পরবর্তি সংবাদআন্দোলন স্থগিত, তবে দাবি বাস্তবায়নের আগে ক্লাসে ফিরবে না বুয়েট শিক্ষার্থীরা