কায়েদ আল ওয়েসিবি ।।
বিগত ১৮ এপ্রিল ইয়ামেনের প্রধান বন্দর নগরী হুদায়দায় একটা কলেরা হাসপাতালের এক প্রান্তে সাত নাম্বার বেডের কাছে একটি চেয়ারে বসা ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি যেন একটি লোমহর্ষক চলচ্চিত্রের ঘটনাস্থলের মধ্যভাগে রয়েছি।
আমার ঘুমন্ত মাকে দেখে মনে ভীষণ ব্যথা অনুভব করছিলাম। কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তিনি এখানে এসেছেন। পাশের বেডের মহিলাটি ছটফট করছিল। যখন তাকে সরানো হল, বিছানার মধ্যখানে আমি একটি গর্ত দেখতে পেলাম। আমি ধারণা করলাম, সম্ভবত এখান দিয়ে ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু পরে জানতে পারলাম যে, ওয়ার্ডের প্রতিটি বিছানায় এমন একটি গর্ত রয়েছে। গর্তের নিচে একটি করে বালতি আছে যাকে হাসপাতালের স্টাফরা পালাক্রমে নিয়মিত পরিষ্কার করেন।
সবকিছু খুব দ্রুত ঘটছিল। সন্ধ্যায় যখন আমার মা আমাকে তার ডায়রিয়ার কথা জানানোর জন্য ফোন করলেন তখন আমি ছিলাম সানা নগরীতে। তিনি ঔষধ সেবনও করেছেন। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। পরের দিন সকালে আমার ভাইয়েরা আমাকে যথারীতি ফোন করলেন। বললেন, মায়ের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তাই তারা তাকে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।
হাসপাতাল কতৃপক্ষ কলেরা আক্রান্ত হওয়ায় তাকে গ্রহণ করলেন না। দ্রুত কলেরা হাসপাতাল ‘আস সাউরায়’ নিয়ে যেতে বললেন।
মাকে দেখার জন্যে ছুটলাম হুদায়দায়, সাউরা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে পাঁচ ছয় ঘন্টা লেগে গেল। যুদ্ধের কারণে সব রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে আছে। এখন যদি এয়ারপোর্ট ব্যবহার হত তাহলে হয়তো আধা ঘন্টায় যাওয়া যেত।
দুপুরে পৌঁছেই আমি সোজা হাসপাতালে চলে যাই।প্রথমে গার্ডরা আমাকে প্রবেশ করতে দিলেন না। কারণ, দর্শনার্থীদের তখন অনুমতি ছিল না। কিন্তু আমার অশ্রুসিক্ত আবেদন দেখে অবশেষে তারা আমাকে প্রবেশ করতে দিলেন। তারা প্রথমে আমার হাত ধোয়ালেন তারপর মহিলাওয়ার্ডে যেতে দিলেন।
ভেতরে আমি উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে আমার মায়ের মুখটা খুঁজতে থাকি। তাকে একবারে শেষ বেডে শোয়া দেখতে পাই। চেহারাটা কেমন কেমন মরা মরা হয়ে গেছে।
‘আমি বাথরুমে যাওয়ার সব ক্ষমতাটুকু হারিয়ে ফেলেছি। আমি একটি শিশুর মতো। আমি নিজেই নিজের দেখভাল করতে পারিনা।’ মা কথাগুলো বলছিলেন আর তার ঠোঁট দুটি কাঁপছিল।
ইতিপূর্বে আমি কলেরা সম্পর্কে শুধু এতটুকুই জানতাম যে তা হল একটি মারাত্মক ব্যাধি। ২০১৬ সালে যখন সর্বপ্রথম তা আমাদের শহরে প্রকাশ পেল তখন আমাদেরকে বলা হতো, আমরা যেন সতর্ক হই। ফল-ফলাদি ও শাক- সব্জি যথাসম্ভব ধুয়ে খাই। কিন্তু যেই যুদ্ধের কারণে মৌলিক মানবিক সেবা, জরুরি খাবার সরবরাহ ইত্যাদি সামাজিক অবকাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে, তখনই রোগ ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে। এবং আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
রোগীদেরকে প্রাথমিকভাবে হাসপাতাল থেকে পৃথক একটি তাঁবুতে রাখা হয়েছে। কিন্তু যখন রোগীদের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে তখন রোগীদেরকে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে স্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়েছে।
প্রথমে মা আমাকে হাসপাতালে তার সঙ্গে থাকতে দিতে চাননি। তিনি আশংকা করছিলেন যে আমিও বুঝি আবার এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। মরিয়ম নামক একজন গর্ভবতী মেয়েকে দেখালেন। সেই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিল মেয়েটি। পরিপূর্ণভাবে ঔষধ সেবন করতে পারছিল না। ফলে তার অবস্থা দিনদিন অবনত হতে থাকলো। আমি নার্সদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- একজন কলেরা রোগী এখানে কতদিন অবস্থান করে?
তারা বললেন- তিন থেকে দশ দিন। তবে বিষয়টি অনেকটা রোগীর নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সব ধরনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও আমি প্রতিদিন মায়ের সাথে থাকব। আমার বোন ও আমি ভাগ করে নিলাম যে, আমি সেখানে থাকবো সারা দিন আর সে থাকবে সারারাত। এই মারাত্মক রোগের সাথে এসকল মহিলাদের লড়ে যেতে দেখে খুবই ব্যাথা অনুভব হতো। এটা শুধু তাদেরকে শারীরিকভাবে ভেঙ্গে দিচ্ছিল না বরং মানসিকভাবেও তাদেরকে ভেঙ্গে দিচ্ছিল। তৃতীয় দিন খাওয়া ও ঔষধ সেবন ছেড়ে দেওয়ার পর আমার মায়ের অবস্থা আরো অবনতি ঘটলো।
রাতে তিনি ৯ মাসের গর্ভবতী মরিয়মকে দেখলেন যে তার শরীর অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। কখনো আবার শান্ত হয়ে যাচ্ছে। আমার বোন আমাকে বলেছিল যে আমার মা তখন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মনে হচ্ছিল যে, তিনি আশঙ্কা করছেন- এটাই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। মনে হচ্ছিল, আমার মায়ের নিয়তি মরিয়ম এর সাথে বাঁধা। আমি তার জন্য দোয়া করলাম। আমি অনুভব করছিলাম যে তার বেঁচে থাকার অর্থ হল আমার মায়ের বেঁচে থাকা। সন্ধ্যায় মরিয়ামের অবস্থার বেশ উন্নতি হল এবং সে নিজেনিজে বাহিরে যেতে সক্ষম হলো। তার পেট ছিল খুব বড় এবং সে দাঁড়াতে সক্ষম ছিল।
এটাই আমার জীবনের সর্বপ্রথম অলৌকিক ও অস্বাভাবিক ঘটনা। আমার মায়ের এতই আনন্দিত হয়েছিলেন যে তিনি আনন্দের আতিশয্যে কেঁদে ফেলেছিলেন। যাদের অবদানে ওই অস্বাভাবিক রোগ মুক্তির বিষয়টি ঘটেছে তারা হলেন হাসপাতালের স্টাফ, যারা কাজটি জটিল ও বিপদজনক হওয়া সত্ত্বেও আঞ্জাম দিয়েছেন পরম বিশ্বস্ততার সঙ্গে। ১২ ঘন্টা করে দুইভাগে ২৪ ঘন্টাই হাসপাতালের কার্যক্রম চলতে থাকে।
যে কয়েকদিন আমি হাসপাতাল এ ছিলাম তাতে আমার মনে হয়নি যে, কারো কাজ ধীর গতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। তারা প্রতিদিন পাঁচজন কলেরা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতেন। আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম, যখন ডাক্তাররা পরের দিন আমাদেরকে বললেন, আমার মা বাড়ি যাওয়ার উপযোগী।
যুদ্ধ আমাদেরকে শেষ করে দিয়েছে। মৃত্যুর সকল পথ আমাদের সামনে খোলা। কেবলমাত্র বেঁচে থাকার একটি সংকীর্ণ পথ বাকি। আমরা যে কষ্টে আক্রান্ত হয়েছি সে কষ্টে অন্য কেউ আক্রান্ত হোক তা আমরা চাই না। তবে আমরা আশা করি, যারা এই যুদ্ধের সূচনা করেছে তাদের ভাগ্যে তাই ঘটবে যা তারা ঘটাচ্ছে।
আল জাযিরা থেকে অনুবাদ: এনাম হাসান জুনাইদ