মাসউদ ভাইয়ের চলে যাওয়া: মনের গহীনে বড় ধাক্কা

শরীফ মুহাম্মদ ।।

তখন সফরে ছিলাম। ছিলাম সৈয়দপুর শহরের মাঝামাঝি। যাচ্ছি লালমনিরহাট। সকাল ৯ টার পর পর হবে। হঠাৎ ফোন এলো। ফোনের অপর প্রান্তে আমাদের বড় ভাই ও মাদরাসাতুস সুফ্ফা ঢাকা’র প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু তাহের রাহমানী। তিনি জানালেন, একটু আগে মাসউদ ভাইয়ের ইন্তেকাল হয়ে গেছে কুষ্টিয়ার বাসায়। কুষ্টিয়ায় বসবাসরত বিশিষ্ট মেধাবী আলেম-লেখক মাওলানা মাসউদুর রহমান ভাই চলেই গেলেন। গাড়ি তখন চলছে, আমরাও ছুটে চলছি। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো, হঠাৎ যেন চারপাশ থমকে গেছে।

সেদিন ছিল ১৭ আগস্ট। ঈদুল আযহার পরের পঞ্চম দিন। আরো দুই সপ্তাহ আগে মাসউদ ভাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রথমে ২/১ দিন ছিলেন কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে। তারপর সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে বড় একটি হাসপাতালে। ঈদের আগে আগে এনজিওগ্রাম করা হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী এক সপ্তাহ পর তার ওপেন হার্ট সার্জারি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব আমি জানতাম। মাসউদ ভাইয়ের অসুস্থতা এবং অসুস্থতার একটা কঠিন অবস্থা সম্পর্কে মানসিক অবগতি ও প্রস্তুতি ছিল। হার্টের মারাত্মক সমস্যার মধ্যেও কতজনকে চিকিৎসা কিংবা অপারেশনের পর সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক চলতে-ফিরতে দেখেছি। মাসউদ ভাইয়ের ক্ষেত্রেও খুব স্বাভাবিকভাবে এরকম প্রত্যাশা ও অনুভূতি মনের মধ্যে কাজ করছিল। কিন্তু তার ইন্তেকালের খবর শুনে থমকে গেলাম।

শুধু থমকে যাইনি, চমকেও গেলাম। বুকের ভেতরে বড় রকম ধাক্কা লাগলো। দলবদ্ধ সফরে ছিলাম। প্রফেসর ড. আফম খালিদ হোসেন, মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী, মাওলানা যাইনুল আবিদীনসহ আমরা ছিলাম একই গাড়িতে। সফর কেন্দ্রিক নিজস্ব নিমগ্নতা ছিল, অন্যদের সঙ্গগ্রহণ ও সঙ্গদানের ব্যাপার ছিল, চলার পথে সৌজন্য রক্ষা ও পাওয়ার সাধারণ বাধ্যবাধকতা ও রেওয়াজ ছিল। কিন্তু বুকের মধ্যে হাহাকারের আগুন জ্বলছিল। মাঝে গাড়ির চালকের কাছে একবার জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, লালমনিরহাট থেকে বাসে কুষ্টিয়া যেতে ৬/৭ ঘণ্টা লেগে যাবে। আসরের পর কুষ্টিয়ায় জানাযার নামাজে শরিক হওয়ার চিন্তা থেমে গেল।

দুই.

মাওলানা মাসউদ ভাই বয়সে আমার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। আমাদের পরিচয়ের শুরুটাতে নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন আমাদের শুধুই বড় ভাই। আমরা নিচের ক্লাসের ছাত্র, তিনি এবং তার জামাতের অন্য ছাত্র ভাইয়েরা আমাদের চেয়ে বড়। সম্মান, সমীহ এবং দূরত্ব ছিল আমাদের মধ্যে। কিন্তু ছাত্র জমানার শেষ দিক থেকে পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে ছোট ভাই-বড় ভাই সম্পর্কের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব।  অনেক দিনের এই বন্ধুত্ব। সেই ৮৮/৮৯ সন থেকেই।

মাসউদ ভাই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। মাদরাসায়ে নুরিয়া আশ্রাফাবাদ কামরাঙ্গীরচরে সেই জমজমাট যুগে তিনি সম্ভবত প্রায় পরীক্ষাতেই নম্বরে আওয়াল (ফার্স্ট) হতেন। মাসউদ ভাই বক্তব্য দিতেন চমৎকার ভাষায়। যাদের সুন্দর ভাষা ও হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনা ছাত্র জমানা থেকেই আমাকে প্রভাবিত করেছে, মাসউদ ভাই তাদের একজন।  মাসউদ ভাইয়ের গলায় ছিল হামদ- নাত গাওয়ার মতো মিষ্টতা ও অভ্যস্ততা। ছাত্রদের সম্মিলিত কোনো এক মজলিসে তার গাওয়া একটি নাশিদ থেকেই প্রথম তাকে চিনেছি। মানে চেনাজানা শুরু হয়েছে। সুরের সঙ্গে দরাজ গলা মিলিয়ে তিনি এই নাশিদটি প্রায়ই গাইতেন। ‘চীন ও আরব আমাদের, বাংলাদেশ আমাদের, আমরা তো ভাই মুসলমান সারা জাহান আমাদের।’আল্লামা ইকবালের বিখ্যাত কবিতার অনুবাদ। সম্ভবত পাবনা থেকেই শিখে এসেছিলেন।

কখনো কখনো এই নাশিদের উর্দু রূপ, কখনো আরবি রূপ আলাদাভাবে গাইতেন। কখনো একসঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে বাংলা উর্দু আরবি রূপের নাশিদটি একসঙ্গে গাইতেন।  মাদরাসায়ে নূরিয়ার বহু অনুষ্ঠানে মাসউদ ভাইয়ের মুখে এই নাশিদটি তন্ময় হয়ে শুনেছি।

আমরা যখন মিজানুস সরফ পড়ি,  মাসউদ ভাইয়েরা সম্ভবত তখন কাফিয়া পড়েন। বেশ কয়েক জামাতের ব্যবধান। কিন্তু মাদরাসার দেয়ালিকা ‘আল আশরাফ’ আমাদেরকে ধীরে ধীরে পরিচিত করে তোলে। বড় জামাতের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও মাসউদ ভাইদের কাছাকাছি যাওয়া এবং বসার সুযোগ ঘটে যায়‌। দেয়ালিকার সম্পাদক হিসেবে সব রকম ডিজাইনের কাজগুলো করতেন বশির মেসবাহ ভাই। লেখা বাছাই ও অন্যান্য কিছু কাজে তার পাশে থাকতেন এই পাবনার মাসউদ ভাই, ঝালকাঠির আব্দুস সালাম ভাই, আব্দুল জলিল ভাইসহ এরকম আরো কয়েকজন।

বয়স ও ক্লাসের দূরত্ব থাকার পরও দেয়ালিকায় লেখা দেওয়ার জন্য এই মানুষগুলোর কাছে আমাদের যেতেই হতো। এর মধ্যেই মাসউদ ভাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা ও আলোচনাটা হতো বেশি। আমার ছাত্র জমানার শেষদিকে সম্পর্কের এই অবস্থাটাই একটা গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। দাওরা ফারেগের আগে-পরে দু’বার পাবনায় মাসউদ ভাইদের বাসায় গিয়েছিলাম। একবার দাখিল পরীক্ষার প্রস্তুতির নামে ও নিয়তে পাবনায় গিয়ে পড়ে থাকি দু সপ্তাহের মতো। প্রস্তুতি ও পরীক্ষা কোনোটাতেই আমার আগ্রহ টিকে থাকেনি, নুরপুর থেকে বের হয়ে পাবনা শহর, চাপা মসজিদ, অ্যাডওয়ার্ড কলেজ, শালগাড়িয়া, জামিয়া আশরাফিয়া ও পাবনার বিখ্যাত মানসিক হাসপাতাল ঘুরাঘুরি করে ময়মনসিংহে ফিরে যাই।

তিন.

মাসউদ ভাইয়ের প্রসঙ্গ এলে নুরিয়া মাদরাসার দলবদ্ধ জীবনের কথা চলে আসেই। সম্ভবত মাদরাসায় নুরিয়ায় আমাদের অনেকের যাওয়াটা হয়েছিল একই বছর। সেটা হচ্ছে ১৯৮১ সনে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. বটগাছ মার্কায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরের বছর। অর্থাৎ ১৯৮২ সন। আমরা প্রায় ৪/৫ বছর হযরত হাফেজ্জী হুজুরকে পেয়েছি। দেখতে পেয়েছি, সামনে বসেছি, কথা শুনেছি। হাফেজ্জী হুজুরের প্রিয় মেধাবী ও বুজুর্গ ছাত্রদের একঝাঁক মানুষ ছিলেন আমাদের উস্তায। হযরত মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ.,হযরত মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ সন্দীপি রহ., হযরত মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান খুলনাবি রহ.,হযরত মাওলানা আব্দুল হক- ময়মনসিংহ হুজুর, হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল-বরিশালি হুজুর, হযরত মাওলানা আজিমউদ্দিন-বাঁশবাড়িয়া হুজুর, হযরত মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ-আদিব হুজুর, হযরত মাওলানা শফিকুল্লাহ মাহবুবুর রহমান সাহেব, হযরত মাওলানা বশির আহমদ-কলাখালী হুজুর-এইসব মহান ব্যক্তিত্বদের প্রত্যক্ষ তরবিয়ত আমাদের জীবনের ওপর বিরাট প্রভাব রেখেছে।

ওই সময় মাদরাসায়ে নুরিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক লেখাপড়ার পাশাপাশি দেয়ালিকায় লেখালেখি, বছরে কয়েকটি উপলক্ষে ছাত্রদের প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো।  বক্তৃতা- আবৃত্তি- নাশিদ -তেলাওয়াত ইত্যাদির অনুষ্ঠান হতো। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় একটি ছাত্র পাঠাগারও প্রতিষ্ঠা করা হয়। এসব আয়োজনে বিভিন্ন ক্লাসের উৎসাহী-আগ্রহী ছাত্ররা পরস্পরের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেত। ছাত্রদের মধ্যেও আবার আলাদা আলাদা ভাবে সাহিত্য-বক্তৃতা এসব নিয়ে নিজস্ব পরিমণ্ডলে চর্চা হতো। কখনো আসরের পর, কখনো এশার পর, কখনো বৃহস্পতিবার এশার পরের লম্বা সময়, কখনো জুমার দিন সকালবেলায়। ছোট্ট ছোট্ট গ্রুপে নানারকম মজলিস বসতো ছাত্রদের।

মনে পড়ে, সাহিত্যের একটি বিশেষ মজলিস বসতো জুমার দিন। সকাল ৮/৯ টার দিকে। যার যার লেখা পাঠ করা হতো। কিছু অনুপ্রেরণামূলক কথাবার্তাও হতো। সেখানে বড় ভাইদের মধ্যে থাকতেন মাওলানা আবু তাহের রাহমানি, মাওলানা নাসিম আরাফাত, মাওলানা মাসউদুর রহমান, মাওলানা আব্দুস সালাম, মাওলানা আব্দুল জলিল, কখনো কখনো ডক্টর মাওলানা গোলাম মাওলা। আর আমাদের বয়সীদের মধ্যে মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী, মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল রহ., মাওলানা আব্দুল জব্বার, মাওলানা আশরাফুল ইসলাম (বাইতুস সালাম মাদরাসার সাবেক গাজীপুরী হুজুর), মাওলানা আইয়ুব আলী এবং আমি। আমার যতটুকু মনে পড়ে, ওইসব মজলিসে বয়সে সবচেয়ে ছোট ছিলাম সম্ভবত আমি এবং আশরাফ।

আজ  মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল নেই, মাওলানা মাসউদুর রহমান ভাইও নেই। ওই মজলিসগুলির অন্য দু-চার জনের সঙ্গে অবশ্যই যোগাযোগ আছে, অনেকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও নেই। কিন্তু বয়সে বেশ বড় হওয়া সত্ত্বেও মাসউদ ভাইয়ের সঙ্গে আগাগোড়া একটা যোগাযোগ ছিল আমার, যদিও ছাত্র জমানার পর ঢাকায় তিনি খুব কমই থেকেছেন।

চার.

মাসউদ ভাই ছাত্র খুব ভাল ছিলেন, আগেই বলেছি। এর সঙ্গে লিখতেনও ভালো‌‌। হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর, গোটা গোটা। কথা বলতেন গুছিয়ে, প্রমিত বাংলায়। পরিচয় হওয়ার আগ পর্যন্ত, কিংবা দূর থেকে দেখলে তাকে খুব গম্ভীর মনে হতো। মনে হতো, লোকটার সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলার সুযোগ নেই। ব্যাপারটা আসলেও এরকমই ছিল। কিছুটা চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। ছিলেন প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ব সচেতন ও আত্মমর্যাবান, ছাত্রকাল থেকেই। কিন্তু পরিচিত হয়ে যাওয়া কিংবা বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়ার পর মাসউদ ভাই ছিলেন খুব আন্তরিক মানুষ। কথাবার্তা, মতবিনিময়, পরামর্শ এবং নানারকম সহযোগিতামূলক কাজকর্ম ও উদ্যোগ নিয়ে একসঙ্গে চলার সময় মাসউদ ভাইকে অত্যন্ত শুভাকাঙ্ক্ষী, আন্তরিক ও আলাপী মানুষ হিসেবেই আমরা পেয়েছি। উস্তাযদের মধ্যে ছাত্রদের এই গ্রুপটির প্রতি বিশেষ স্নেহদৃষ্টি ছিল মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ-আদীব হুজুর ও মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল বরিশালি হুজুরের। অন্য কয়েকজন উস্তাযও সাহিত্য প্রয়াসের নামে ‘পাগল’  ছাত্রদের এ দলটিকে দেখেশুনে রাখতেন।

আমরা যখন জালালাইন পড়ি, তখন মাদরাসা থেকে আবার ছাত্রদের উদ্যোগে ‘রহমত’ সাময়িকী হিসেবে বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ‘রহমত’-এর মূল সূচনা ছিল আরও আগে। মাঝে বন্ধ ছিল, আমাদের সময় আবার শুরু হয়েছিল। তখন এর যৌথ সম্পাদক ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল-বরিশালি হুজুর ও মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ-আদীব হুজুর। ছাত্রদের মধ্যে এর বড় উদ্যোগে ছিলেন মাসউদ ভাই। তার সঙ্গে বশির মেসবাহ ভাই। আরো কেউ কেউ ছিলেন। আমিও ছিলাম সারির নিচের দিকে। লেখা তৈরি, প্রেস ও বিজ্ঞাপনের জন্য একটু-আধটু ছোটাছুটি এবং ‘রহমত’ বের হওয়ার পর আবেগ কম্পিত বুকে ‘রহমত’ নিয়ে ঘুরাঘুরি। এভাবে বেশ কয়েকটি সংখ্যা বের হয়েছিল। সেই নব্বইয়ের আগেই।

দাওরা ফারেগ হওয়ার পর মাসউদ ভাই কিছুদিন মাদরাসাতুল মাদীনায় আদীব হুজুরের অধীনে শিক্ষানবিশ শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর কিছুদিন পাবনায় ছিলেন,নিজের বাড়িতে। কোনো একটি মাদরাসায় পড়িয়েছেন আর সঙ্গে টুকটাক ব্যবসাও করেছেন। কিছুদিন ঢাকার উত্তরায় বন্ধু ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভীর প্রতিষ্ঠিত ‘মা’হাদে’ শিক্ষকতা করেছেন। তখন মাসউদ ভাইয়ের করা ‘সুয়ারুম মিন হায়াতি তাবেঈন’- এর প্রথম খণ্ডের তরজমা প্রকাশ হয় ‘আলোর মিছিল’ নামে। আমার যতটুকু মনে পড়ে, আগে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ-নিবন্ধ বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হলেও এটি ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রথম বই। আমাদেরও তখন দু-একটি বই বের হয়েছে। ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভীরও দু-একটি বই বের হয়েছে। খুব আনন্দ ও আবেগে আমাদের সময় কেটেছে তখন।

শুরুর দিকে মাসউদ ভাই বিভিন্ন লেখায় তার নাম লিখতেন, মাসউদুর রহমান বিশ্বাস। তাদের বংশীয় উপাধি ছিল বিশ্বাস। সম্ভবত তার আব্বার নাম আফসারউদ্দিন বিশ্বাস। ইঞ্জিনিয়ার আফসারউদ্দিন বিশ্বাস। দ্বীনদার শতায়ু এই পিতা সেদিন তার সন্তানের জানাজায় হাজির ছিলেন। পুরো পরিবারে একা মাসউদ ভাই-ই আলেম ছিলেন, মাদরাসায় পড়েছেন। তিনি ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়।

পাঁচ.

মাসউদ ভাইয়ের বাড়ি পাবনায়। ওই সময় কুষ্টিয়ার দাদাপুর কমলাপুরে মাদরাসায়ে নুরিয়ার ছাত্র মাওলানা রফিক ভাইয়ের বাড়ির পাশে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে যোগ দেন আমাদের উস্তায মাওলানা বশির আহমদ-কলাখালী হুজুর। সেখানে আগে থেকে মাদরাসায়ে নুরিয়ায় আমাদের একজন বড়ভাই ছিলেন শুরু থেকেই। তিনি ময়মনসিংহ-ত্রিশালের মাওলানা জুনায়েদ আহমদ ভাই।  মাওলানা মাসউদ ভাইসহ নুরিয়ার আরো কয়েক জন মেধাবী ছাত্র সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর থেকেই মাসউদ ভাইয়ের জীবন কুষ্টিয়ায় ঠিকানা গাড়ে। কুষ্টিয়ায় তিনি বিয়ে করেন। তার জীবন যাপন কুষ্টিয়ার সঙ্গেই জড়িয়ে যায়। এমনিতেও পাবনা আর কুষ্টিয়ার মধ্যে দূরত্বটা  বেশি নয়। সেতু হওয়ার পর সেটা আরও কমে গেছে।

মাঝে তিনি বেশ কয়েক বছর ছিলেন সৌদি আরব । সেখান থেকে দেশে আসার পর প্রধানত মসজিদের ইমাম-খতিবের দায়িত্ব পালন, সঙ্গে লেখালেখি ও সম্পাদনা-এই ছিল তার মূল কাজ। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে শুধুমাত্র মাসউদ ভাইয়ের দাওয়াতে কুষ্টিয়ায় গিয়েছি। জীবনে প্রথমবারের মতো। পরে ২০১৩ সনে আবার কুষ্টিয়া গিয়েছি ইতিহাস ও সাংবাদিকতার অন্য কাজে। উঠেছিলাম মাওলানা শিহাবউদ্দিন ভাইয়ের বাসায়। তখনও মাসউদ ভাইয়ের সঙ্গে লম্বা সময় কেটেছে। মাঝে আরেকবার আরেকটি প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে এক দৌড় কুষ্টিয়ায় যেতে হয়েছিল। পথে গাড়ি থামিয়ে মাসউদ ভাই ও শিহাব ভাইয়ের সঙ্গে বসে সদলবলে চা খেয়েছি।

ঢাকায় এলে বেশিরভাগ সময় মাসউদ ভাই ফোন দিতেন। আমার বাসায় এসেছেন কম, অনেক সময় দেখা হয়েছে পল্টনে। কিন্তু গত ৮/১০ বছরে বিভিন্ন সময় ফোনে লম্বা সময় ধরে কথা হয়েছে।

গত কয়েক বছর আগে যখন তিনি তারবিয়াতুস সালিক-এর অনুবাদ খণ্ড খণ্ড করে করতে শুরু করলেন তখনই একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা অথবা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে সহযোগী হতে চাইলেন। ‘রাহনুমা প্রকাশনী’র জন্ম এভাবেই। রাহনুমা প্রকাশনীর মাহমুদুল ইসলাম মাসউদ ভাইয়ের খুব স্নেহধন্য ছাত্র, বাড়িও পাবনায়। মাহমুদও আগে থেকে টুকটাক প্রকাশনী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু কোনো নামধাম বা বড় প্রস্তুতি ছিল না তার। মাসউদ ভাইয়ের প্রেরণাতেই সে পুরোদস্তুর নেমে যায় প্রকাশনার ময়দানে।

‘রাহনুমা’ থেকে প্রথমদিকে মাসুদ ভাইয়ের তারবিয়াতুস সালিক এর খণ্ডগুলো বের হয়। এরপর মাসউদ ভাই ‘সুওয়ারুম মিন হায়াতি তাবেঈনে’র সবকটি খণ্ড অনুবাদ করেন। সেগুলোও বের হয়‌। ‘সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা’ তরজমা করেন। সেগুলোও বের হয়। তারবিয়াতুস সালিক বইটি তরজমার আগে থেকেই মাসউদ ভাই সিরাজগঞ্জে বসবাসরত হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর খলিফা হযরত মাস্টার আব্দুর রশিদ সাহেব রহ.-এর বাইয়াত ছিলেন। তার নির্দেশনা ও পরামর্শ নিয়েই ‘তারবিয়াতুস সালিক’ তরজমা করেন মাসউদ ভাই। পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করেই ‘রাহনুমা প্রকাশনী’র কাজ শুরু হয়।

রাহনুমা প্রকাশনী থেকে ফিলহাল সিরিজসহ আমার কয়েকটি বই বের হওয়ার ক্ষেত্রেও মাসউদ ভাইয়ের উদ্যোগটা ছিল বড়। তার নিজের লেখালেখি, সম্পাদনা, রাহনুমার অন্যান্য কাজ, আমার লেখালেখি, টুকটাক নানান কাজকর্ম নিয়ে মাসউদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রায়ই কথা হতো। কিন্তু আশ্চর্য ও আক্ষেপের ব্যাপার হলো, তার ইন্তেকালের আগে প্রায় বছর খানেক সময় তার সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। তিনি হাসপাতালে থাকাকালে দুবার ফোন দিয়েছি। দুবারই কথা হয়েছে তার মেয়ে-আমাদের ভাতিজি আনিকার সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা হয়নি, ব্যতিব্যস্ত হয়ে কথা বলার দরকারও মনে আসেনি। এটা কীভাবে হলো আর কীভাবে তিনি চলে গেলেন, এ বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাইলে আমি বেশিক্ষণ ভাবতে পারি না।

ছয়.

মাসউদ ভাইয়ের লেখার হাত অনেক পরিপক্ক ও শিল্পমণ্ডিত। ধীরে ধীরে ভেবে-ভেবে লিখতেন। সম্পাদনাও করতেন মন দিয়ে। হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ.-এর একটি গম্ভীর ও উচ্চমার্গীয় গ্রন্থ হলো, তারবিয়াতুস সালিক। বিষয়বস্তু ও অভিব্যক্তির দিক থেকে অনেক মনোযোগ দাবি করে। যে কেউ এ বইটির তরজমা পড়লে অবাক হয়ে যাবেন বিষয়ের ওপর এতটা মসৃণ, সহজবোধ্য ও মূলানুগ তরজমা তিনি কীভাবে করলেন! এর আগে গ্রন্থটির কোনো তরজমা বাংলা ভাষায় ছিল না। গ্রন্থটির মূল বিষয়: আধ্যাত্মিক শায়েখের কাছে তার মুরিদ ও সম্পর্কিত লোকজনের পক্ষ থেকে আগত  বিভিন্ন আত্মিক ও চারিত্রিক ব্যাধি নিয়ে প্রশ্ন এবং তার মীমাংসামূলক উত্তর। জটিল ও অসাধারণ সব বিষয়। অসাধারণ সব মীমাংসা। একইসঙ্গে মাসউদ ভাইয়ের অসামান্য অনুবাদ। পাঠকমাত্রই পড়ে দেখতে পারেন।

মাসউদ ভাইয়ের বেশির ভাগ লেখাই অনূদিত গ্রন্থ, এটা ঠিক। কিন্তু আপনি তার অনূদিত ‘সুওয়ারুম মিন হায়াত তাবেয়ীন’ পড়ে দেখুন।  ড. আব্দুর রহমান রাফাত পাশার আরবি এ গ্রন্থটি একইসঙ্গে জীবনী ও সাহিত্য।  আরব বিশ্বের বহু জায়গায় মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্য সম্ভবত এ গ্রন্থটি।  মাসউদ ভাইয়ের করা বাংলা তরজমাটি পড়ুন। এখানেও আপনি জীবন ও সাহিত্যের সমন্বিত শিল্পের সৌন্দর্য পাবেন।  রুচির সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করা মানুষ ছিলেন মাসউদ ভাই‌। সৃজনশীল কাজে ভালোলাগা, তীক্ষ্ণতা, সূক্ষ্মতা ও রুচি ছিল তার বড় বিবেচনার বিষয়।

মাসউদ ভাই বক্তব্য দিতেন খুব সুন্দর।  না, কোনো জ্বালাময়ী বক্তব্য নয়,  বিষয়ভিত্তিক গুছিয়ে প্রমিত উচ্চারণে আকর্ষণীয় উপস্থাপন ছিল তার‌।  কুষ্টিয়ার মানুষের ভাষা ও উচ্চারণ এমনিতেই সুন্দর। তার ক্ষেত্রে সেটা ছিল লক্ষণীয় মাত্রায়। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বেশ কয়েক বছর কুষ্টিয়া থেকে এসে এসে মাসউদ ভাই জুমার নামায পড়াতেন ঢাকার আলুবাজার মসজিদে। জুমআর নামায পড়াতেন মানে, নামাজের আগে বয়ান ও খুতবাও পাঠ করতেন‌।  মাসউদ ভাই হাফেজ ছিলেন, তেলাওয়াতও তার সুন্দর ছিল। কিন্তু আমি বলছি তার বাংলা বক্তব্যের কথা। আমি তখন মতিঝিল মাদরাসা থেকে মাঝে মাঝে জুমার সময় যেতাম ওই মসজিদে, মাসউদ ভাই আসার সম্ভাবনা থাকলে। একদিন জুমার পর খতিব সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা বেশ কয়েকজনের মধ্যে একজন আলাদা করে মাসউদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার বাড়ি কি পশ্চিমবঙ্গের দিকে? নদিয়া -মুর্শিদাবাদের দিকে?’

মাসউদ ভাই উত্তর দিলেন, ‘আমার বাড়ি পাবনা, থাকি কুষ্টিয়ায়। আপনার এমন মনে হওয়ার কারণটা কী,জানতে পারি?’

আগত  ওই মুসল্লী উত্তর দিলেন, ‘আপনার ভাষা এবং উচ্চারণে আমার এমন মনে হয়েছে তো তাই জিজ্ঞেস করেছি।’

সাত.

আমার বয়স এখন ৪৮ চলছে ‌। মাসউদ ভাইয়ের বয়স হয়তো ৫১/৫২ হয়েছিল। উচ্চতায় মাসউদ ভাই কিছুটা বেটে- খাটো মানুষ ছিলেন।  আমিও তো সেরকমই। দেহের স্ফীতি একটু বেশি ছিল। বিশেষত জীবনের শেষ দিনগুলোতে‌‌। গায়ের রং শ্যামল বর্ণের। পোশাক-আশাক পরতেন খুব সাদামাটা ধরণের। যিনি মাসউদ ভাইকে চেনেন না, দূর থেকে বা কাছ থেকে চোখের দেখা দেখে তিনি মাসউদ ভাইকে চিনতে পারতেন না। শারীরিক অবয়ব, পোশাক-আশাক, চলাফেরায় দৃষ্টি আকর্ষণের মতো বিশেষ কোনো বিশেষত্ব তার ছিল বলে আমার মনে পড়ে না।  তবে কথা বলতে থাকলে তার আলাপ ও আচরণে বিশেষত্বপূর্ণ রুচির ছাপ মিলত। মাসউদ ভাইয়ের পুরা অবয়বে সবচেয়ে চোখে পড়তো তার দুটি চোখ। গভীর, তীক্ষ্ণ ও মায়াময়।  তার গাম্ভীর্য, অভিমান ও হাসিমুখ-সব ধরা পড়তো ওই দু’চোখে।

ডায়াবেটিস ছিল তার,  আরো কিছু টুকটাক অসুস্থতাও ছিল। কিন্তু তার হৃদরোগের কথা ওইভাবে আমি আগে শুনিনি।  ডায়াবেটিসের সঙ্গে নাকি লুকোছাপা থাকে অনেক অসুস্থতার বীজ। হয়তো হৃদরোগের ব্যাপারটা তার তেমনই ছিল।  তাকদীরের ফায়সালা ছিল।  আমরা দিন গুণছিলাম ও ভাবছিলাম, কবে ও কীভাবে তার অপারেশন হবে। আল্লাহ তাআলার ফায়সালা, তিনি চলে গেলেন।

১৭ আগস্ট সকালে তার ইন্তেকাল হলো। আসরের পর হলো জানাজার নামাজ। আর সন্ধ্যায় তাকে দাফন করা হলো। তিনি শুয়ে আছেন কুষ্টিয়ার পৌর গোরস্তানে।

আমাদের সময়ে ঢাকার বাইরে থাকা এক শক্তিমান লেখক-আলেম ছিলেন মাসউদ ভাই। আওয়াজ ছিল না, হইচই ছিল না।  অথচ লেখালেখির বাইরেও তিনি নির্লিপ্ত কোনো মানুষ ছিলেন না। কত কথা হতো, কতো ভাবনা বিনিময় হতো! বুকভরা পেরেশানি দেশ,সমাজ ও উম্মাহ নিয়ে তার ছিল। তার অনেক বিষন্নতার কথা জানি, যেগুলো ব্যক্তিগত ছিল না। আত্মমর্যাদার সঙ্গে শব্দহীন দুঃখযাপন করতেন।

যদি আপনার একটু সময় হয়, আমাদের কিশোর-যুবককালের এক নায়ক,  আমাদের বড়ভাই ও বন্ধু মাওলানা মাসউদ ভাইয়ের জন্য একটু দোয়া করবেন।  যদি আরেকটু সময় হয়, তাহলে রাহনুমা প্রকাশনী থেকে সংগ্রহ করে তার বইগুলোর পাতা উল্টেপাল্টে দেখবেন।

পূর্ববর্তি সংবাদউত্তরায় শুরু হচ্ছে ধারাবাহিক আঞ্চলিক কিতাবমেলা
পরবর্তি সংবাদঅবশেষে প্রত্যার্পন বিল প্রত্যাহার করল হংকং সরকার