রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন : ব্যর্থতা ও করণীয় নিয়ে যা বললেন দুই বিশিষ্ট আলেম

ওলিউর রহমান ।।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অমানবিক নিপীড়ন ও জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে রাখাইনের রোহিঙ্গারা। কোনোরকম বেঁচে থাকার আশায় শত শত বছরের ঐতিহ্য পূর্ব-পুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে শরনার্থী হয় তারা। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ নিজেদের সামর্থ্যানুযায়ী আরাকান থেকে হিজরত করে আসা মুহাজির ভাইদের সহযোগিতা করেছেন। ২০১৭ সালে নতুন করে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয় চাইলে বর্তমান সরকার প্রথমদদিকে অনাগ্রহ দেখালেও পরে তাদের গ্রহণ করে নেয়।

তবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কিছু মিডিয়ায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি বারবার উপস্থাপিত হয় নেতিবাচকভাবে। অসহায় বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে বিচ্ছিন্ন দুয়েকটা অন্যায়, অপরাধের দায় পুরো জাতির উপর চাপিয়ে রোহিঙ্গাদেরকে জাতিগতভাবে অসভ্য বর্বর দেখানোর চেষ্টা করা হয়।

মানবিকতার জায়গা থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও বাংলাদেশের মতো একটা স্বল্পোন্নত দেশের জন্য প্রায় আট লাখের মতো ‘অতিরিক্ত’ মানুষের দীর্ঘমেয়াদি দায়িত্ব নেওয়া স্বাভাবিক কথা নয়। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের স্বাধীন-স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য হলেও নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। তাই বাংলাদেশ সরকার কূটনীতিকভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের চেষ্টা করতে চেয়েছে। তবে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক বা বিভিন্ন কনফারেন্সে বাংলাদেশের মিত্র দেশেগুলোর দায়িত্বশীলরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে নানাপ্রকার আশ্বাসবাণী শোনালেও কার্যকর কিছুই কেউ করেনি। তাই সরকার কর্তৃক দ্বিতীয়বারের মতো প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করায় একজন রোহিঙ্গাও ফেরত যায়নি।

দ্বিতীয়বারের মতো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল না হওয়ার কারণ ও রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের করণীয় প্রসঙ্গে কথা বলা হয় জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়ার মুজাদ্দিস মাওলানা মামুনুল হক ও জামিআ কুরআনিয়া লালবাগ মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইনের সঙ্গে।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল না হওয়া প্রসঙ্গে মাওলানা মামুনুল হক বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের পর থেকেই তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনেরর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ছিল। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন কেবল বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের বিষয় নয়। এর সাথে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিক নানা সমীকরণ জড়িত। দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোকেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আন্তরিক মনে হয়নি। বাংলাদেশ সরকারেরও কূটনীতিকভাবে আরও জোরালো ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল।

প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত দায় কার- জানতে চাইলে মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, প্রত্যাবাসনে ব্যর্থতার দায় নিয়ে বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে যে বিপরিতমুখি বক্তব্য শোনা যাচ্ছে তা খুবই হাস্যকর। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের দায় থাকতে যাবে কেন? রোহিঙ্গারা কি আসলে বাংলাদেশের নাগরিক? তারা কি বাংলাদেশে খুব স্বাচ্ছন্দে আছে? রোহিঙ্গারা তো নিরাপত্তার সাথে দেশেই ফেরত যেতে চায় তবে মিয়ানমার সরকার যে রোহিঙ্গাদেরকে নিজেদের দেশে ফিরতেও  ‘নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না’ জাতীয় নানাপ্রকার শর্তারোপ করেছে এটা তো প্রহসন। মিয়ানমার চায় অল্প কিছু রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত গিয়ে ‘জেলখানার’ মতো আবদ্ধ জীবন যাপন করুক। হ্যাঁ এখানে বাংলাদেশের দায় যদি থেকে থাকে সে দায় হলো বাংলাদেশ কূটনীতিকভাবে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

রোহিঙ্গাদেরকে নিরাপদে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সরকারের করণীয় কী জানতে চাইলে লালবাগ মাদরাসার এ মুহাদ্দিস বলেন, সরকারের উচিত কূটনীতিকভাবে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করা। এক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোর সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন বা বৃদ্ধি করা। মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব সংগঠন রয়েছে সেগুলোতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের যে সঙ্কট সেটা নিয়ে আলোচনা করা। বিভিন্ন রাষ্ট্রের নানা পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের মৌখিক আশ্বাসের উপর নির্ভর করে বসে থাকা উচিত হবে না।

এর সাথে যুক্ত করে এ বিষয়ে মাওলানা মামুনুল হক বলেন, রোহিঙ্গারাও নিজেদের অধিকার আদায়ে এবং প্রত্যাবাসনের জন্য কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশ সরকারের সেটাকে সমর্থন করা উচিত। নিজেদের স্বার্থেই করা উচিত।

স্বদেশ ত্যাগের দুইবছর পূর্তি উপলক্ষে রোহিঙ্গারা যে সমাবেশ করেছে এটাকে কীভাবে দেখা উচিত- প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা মামুনুল হক বলেন, এটাকে অবশ্যই ইতিবাচকভাবে দেখা উচিত। বাংলাদেশ সরকার যখন কূটনীতিকভাবে নিরাপত্তার সাথে তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে পারছে না তখন নিজেদের দাবি-দাওয়াগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রচার করার তো এছাড়া কোনো উপায় নাই। অবশ্য দেশের কিছু মিডিয়া বরং এ ব্যাপারে নির্যাতিতের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের সমাবেশটিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখাতে চেয়েছে।

রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে জানতে চাইলে মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, সেখানে মিডিয়ার লোকদের প্রবেশের ব্যাপারে খুবই নজরদারি করা হয়। তারা কতটা সুখে আছে কতটা দুখে আছে তা জানা যায় না। তবে এটা ঠিক যে তারা সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাই বাংলাদেশ সরকার যে মানবিকতার জায়গা থেকে তাদের আশ্রয় দিয়েছে সে জায়গা থেকেই তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারেও সরকারের কার্যকর ও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

পূর্ববর্তি সংবাদপ্রত্যাবাসন বিরোধী প্রচারণা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ
পরবর্তি সংবাদমুসলমানদের মতপার্থক্যের সুযোগ নিচ্ছে তৃতীয় পক্ষ : শেখ হাসিনা