প্রত্যাবাসন: রোহিঙ্গা সংকটের নতুন মোড়!

ওয়ারিস রব্বানী ।।

২ বছর আগের ঘটনা। এই ২৫ আগস্ট। বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় মিয়ানমারের আরাকান থেকে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ঢল নামে‌। ঐদিন থেকে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুর জনস্রোত আসতেই থাকে। কয়েক মাস ব্যাপী চলতে থাকে রোহিঙ্গাদের আগমন ধারা। সরকারের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়। বেসরকারি পর্যায়ে দেশী-বিদেশী বহু সাহায্য যায় কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। হত্যা-নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি ও সাহায্যদানের নজিরবিহীন দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তখন।

আগেও রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ী বসতি গেড়েছিলেন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের জনস্রোত রোহিঙ্গা শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যাটা অনেক বাড়িয়ে তোলে। সরকারি হিসেবে এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ প্রায়। এক পর্যায়ে মিয়ানমারের রাখাইন অথবা আরাকান নামক রাজ্যের বাসিন্দাদেরকে আবার মিয়ানমারে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নানারকম কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হতে থাকে‌। প্রথম দিকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত না হলেও পরবর্তীতে যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে বিশেষ ব্যবস্থার অধীনে ফিরিয়ে নিতে তারা সম্মত হয়। এখান থেকেই মূলত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুর জন্ম।

এই প্রত্যাবাসন ইস্যুটি যতই জোরালো হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা রকম সংকট, অনিরাপত্তা, অনিশ্চয়তা ও ভীতির বিষয়গুলো রোহিঙ্গাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার জন্য তারা নানান দাবি-দাওয়া পেশ করতে শুরু করেছে। গত কয়েকদিন আগে প্রত্যাবাসনের জন্য আয়োজিত সাক্ষাৎকার পর্বে সেজন্যই একজন রোহিঙ্গাও উপস্থিত হননি। এটা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশি-বিদেশি মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিজেদের ভূমিতে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি এভাবে অনিশ্চিত হয়ে গেলে কিংবা থেমে গেলে এতে যে নতুন আরেকটি সংকট তৈরি হতে পারে- সব পক্ষের কথায় এ দুশ্চিন্তার বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

এরই মধ্যে গত ২৫ আগস্ট ঘটে গেছে অন্য ঘটনা। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে উখিয়ায় বড় একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেই সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বেশ কিছু শর্তের কথা উল্লেখ করেন। এসব শর্ত না মানলে তারা মিয়ানমারে ফেরত যাবে না এবং বাংলাদেশের ভেতরে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলেও বক্তব্য দেন। সমাবেশটির সচিত্র খবর সব গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। এতে দেখা যায়, লোকসমাগম ও আয়োজনের পরিধি ছিল ব্যাপক ও বিশাল। ওই সমাবেশে তাদের পেশ করা পাঁচটি দাবির মধ্যে রয়েছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নেওয়া, সেখানে তাদের নিরাপত্তা থাকা ও অবাধে চলাচলের স্বাধীনতা দেওয়া, হারানো ভিটেমাটি ফেরত পাওয়া এবং দেশ ত্যাগের সময় তাদের উপর যেসব নির্যাতন করা হয়েছে তার বিচার করা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এসব দাবি যৌক্তিক ও যথাযথ হলেও তাদের ভাষার উত্তাপ ও শোডাউনের ব্যাপকতা বাংলাদেশের ভেতরে অনেক মহলকেই চিন্তিত করে তুলেছে।

সরকারের নীতিনির্ধারক মহল তাদের এই বিশাল সমাবেশ ও প্রত্যাবাসনের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া দাবি-দাওয়াকে ভালো চোখে দেখেননি বলে গণমাধ্যমে এসেছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে লেখালেখিও হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে সাধারণভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল শ্রেণীটিও শিগগির তাদের মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার পক্ষে নানা রকম মতামত ও যুক্তি পেশ করছেন। অবশ্য এ পরিস্থিতির মধ্যেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে অনেকে কথা বলছেন। কিন্তু ব্যাপকভাবে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের এই অনীহা ও শর্তযুক্ত দাবি দাওয়ায় ক্ষোভ ও বিরক্তিই প্রকাশ পাচ্ছে বেশি।

বছর খানেক ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে বিভিন্ন সময় তাদের  সংঘাতের কথা আলোচনায় উঠছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে নিজেদের মধ্যে হত্যা ও খুনের ঘটনা ঘটেছে, সে সবের আলোচনাও হচ্ছে। মাদক ব্যবসা, নারী পাচারসহ তাদের বিভিন্ন রকম অপরাধ ও আচরণগত সমস্যা নিয়ে কক্সবাজারে স্থানীয়ভাবে এবং দেশব্যাপী এক ধরণের বিরক্তিবাচক মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছে‌।

অনেকেই এখন বলছেন, রোহিঙ্গা সংকটের এটি আরেকটি পর্ব। প্রত্যাবাসন ইস্যু সামনে আসার পর যা শুরু হলো।

কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করছেন,  রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পেছন থেকে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, মিয়ানমারে অনিরাপত্তার বিষয়টি রোহিঙ্গাদেরকে এতটাই ভাবিয়ে তুলেছে যে তারা এ ইস্যুতে অস্থির ও ভীত হয়ে উঠছে। এজন্য ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া সামনে না নিয়েই বাংলাদেশে আন্দোলনের ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছে ও সমাবেশ করছে। এটা আসলে তাদের জীবন বাঁচানোর একটা মরিয়া প্রয়াস। বাস্তবে ঘটনার আড়ালে যাই থাকুক, বিরক্তি  ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথাই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে বেশি।

রোহিঙ্গা নেতা মুহিব্বুল্লাহর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সামনে অভিযোগ দায়েরকারী সাক্ষাতপ্রার্থীদের সাথে তাকেও দেখা গেছে। রোহিঙ্গা শিবিরে আগত বিভিন্ন বিদেশি এনজিও কর্মকর্তাদের পাশেও তার ছবি পাওয়া গেছে। এসব ছবি একসঙ্গে করে অনেকেই দাবি করছেন, উখিয়ায় ২৫  আগস্টের সমাবেশের মূল ব্যক্তি এই মহিবুল্লার পেছনে বিদেশি বড় শক্তিগুলোর ইন্ধন রয়েছে। যাদের টার্গেট হলো, রোহিঙ্গারা যেন মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি না হয় এই মিশন চালু রাখা। এই অংকটা আসলে কতটা বাস্তব সিদ্ধান্ত টেনে কথা বলা মুশকিল। কিন্তু এখানেও এ সত্যটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রোগ্রাম থমকে দেওয়া কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়। না রোহিঙ্গাদের জন্য, না বাংলাদেশের জন্য। প্রত্যাবাসন বিরোধিতায় তাদের অনড় অবস্থান দেখে অনেকে তাই নানারকম সন্দেহ পোষণ করছেন, ব্যক্তও করছেন।

আরেকটি ব্যাপার হলো, মিয়ানমারের পক্ষ থেকেও প্রত্যাবাসনের জন্য নানা রকম শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্য থেকে প্রথম পর্যায়ে তারা মাত্র কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চায়। বিভিন্ন পর্যায়ে কূটনৈতিক আলাপ আলোচনার সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই সংখ্যাটার কাছাকাছিও তারা মানতে রাজি হননি এমন খবর বের হয়েছে। এটার জন্য বিভিন্ন মধ্যস্থতা ও যাচাই-বাছাইয়ের শর্ত তাদের পক্ষ থেকেও লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে বলে অনুমান করা যাচ্ছে, সেটি হলো, আগে প্রত্যাবাসন শুরু হোক। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মিয়ানমারে ফিরে যেতে শুরু করুক। যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে কয়েক হাজার করে করে হলেও যেতে থাকুক। এরপর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে এ পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা গেলে একসময় হয়ত শরণার্থী রোহিঙ্গাদের বড় সংখ্যাটাকেই রাখাইনে ফেরত পাঠানো যাবে।

বিশ্ব রাজনীতির নানা জটিলতা, আঞ্চলিক পর্যায়ে দেশভিত্তিক বন্ধু-শত্রুর যোগ-বিয়োগ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রায় সবাইকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে এবং সেখানে তাদের নিরাপদ আবাস তৈরি করতে কতটা সক্ষম হবে এটা আসলেই একটি জটিল প্রশ্ন। তবুও অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, অন্যতম সমাধান হচ্ছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারেই ফিরে যাওয়া। এক্ষেত্রে তাদের আগ্রহও থাকতে হবে। আবার আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী শক্তি ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বের বিষয়গুলো নিয়েও পূর্ণ সজাগ ও উদ্যোগী ভূমিকা বজায় রাখতে হবে।

মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি ভাই হিসেবে, মানুষ হিসেবে আমাদের ভালোবাসা থাকবে। আমাদের ভালোবাসা থাকা উচিত। তার সাথেসাথে ভূমি, নাগরিকত্ব, দেশ, আবাস, জীবন ও ধর্ম নিয়ে চলাচলের যে বাস্তবতা- সেটিও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সামনে রাখতে হবে। বাংলাদেশে তাদের শরণার্থী জীবন তাদের জন্য আসলে ভালো কোনো সমাধান নয়। একইসঙ্গে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া- এই শরণার্থীদের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্বস্তি ও শান্তি অর্জনের কোনো উপায় হতে পারে না। এটা বাস্তব ও কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই সত্য। কারণ তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথাযথ না হলে আবার তো নির্যাতিত অবস্থায় বাংলাদেশের সীমান্ত ভেদ করে কক্সবাজার অভিমুখে রোহিঙ্গা জনস্রোত তৈরি হতে পারে। তাই পাঠিয়ে দেওয়ার আগে তাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব ইস্যুটি নিয়েও আমাদের দেশের সরকারি পর্যায়ে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো দরকার।

মার খেয়ে নির্যাতিত হয়ে হত্যার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাংলাদেশে এসেছেন। এটা ছিল তাদের ভিটেমাটি ত্যাগের প্রথম সংকট। প্রত্যাবাসনের সময়ে তাদের দ্বিতীয় সঙ্কট শুরু হলো। প্রত্যাবাসনের ডাকে তারা সাড়া দেবেন কিনা, সাড়া দিলে নাগরিক মর্যাদা নিয়ে ফিরে যেতে পারবেন কিনা, ফিরে যেতে পারলে সেখানে স্বস্তির সঙ্গে, নিরাপত্তা সঙ্গে বসবাস করতে পারবেন কিনা,  ফিরে যাওয়া শুরু করলে কয়েক হাজার করে করে এই সাড়ে ১১ লাখ মানুষ শেষ পর্যন্ত নিজেদের ভিটায় পৌঁছাতে পারবেন কিনা-এ প্রশ্নগুলো প্রত্যাবাসনের সময় জোরালো হয়ে উঠেছে।  এবং এই প্রশ্নগুলো শুধু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যই জরুরি নয়,  যেই দেশে তারা আশ্রয় নিয়েছে সেই দেশের জন্যও জরুরি এবং যারা এখানে মধ্যস্থতা করছেন তাদের জন্যও জরুরি।

আমরা চাই ও দোয়া করি, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া, হিজরত করে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী-মুহাজিরদের দ্বিতীয় সংকটটাও কেটে যাক। তারা একদিন দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, এখন আবার একটি স্বস্তিদায়ক প্রত্যাবাসনের পথ তাদের সামনে খুলে যাক। এজন্য শুধু তাদের বক্তব্য ও দাবি দাওয়া যথেষ্ট নয়, যেই দেশে তারা আছেন, যারা এটার মধ্যস্থতা করছেন- সকলের আন্তরিক উদ্যোগের প্রতি দৃষ্টিআকর্ষণও তাদের একটি বড় দায়িত্ব। এ দায়িত্বে খামখেয়ালি করা হলে রাখাইনে ফিরে গিয়ে রোহিঙ্গারা বিপন্ন হবেন আর এখন আমরা তাদেরকে পাঠিয়ে দিয়ে স্বস্তি অনুভব করলেও কয়েকদিন পর আবার সঙ্কট নতুন রূপে বাংলাদেশের সামনে ফিরে আসবে।

রোহিঙ্গা মুসলিমদের সামনে প্রত্যাবাসনের যে ইস্যু এসেছে, তা সুখকর হয়ে উঠুক, সমাধানমূলক হয়ে উঠুক।

পূর্ববর্তি সংবাদদুই মেয়রের গাফিলতির কারণে ডেঙ্গুতে এত মানুষের মৃত্যু: হাইকোর্ট
পরবর্তি সংবাদহজ্বের পর: হজ্ব-পরবর্তী জীবনের আলোক-প্রদীপ