চামড়া সিন্ডিকেট: আবারো বিনীত কয়েকটি বিবেচনা

শরীফ মুহাম্মদ ।।

চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটের ঘটনা সামনে আসার পর এখন অনেকেই অনেক প্রস্তাব রাখছেন। কেউ কেউ বলছেন, মাদ্রাসাগুলোর ভবিষ্যতে ঈদের দিনে চামড়া কালেকশন বাদ দেওয়া উচিত। আর্থিক কারণেও বলছেন, আত্মমর্যাদা এবং ঈদের দিনে ছাত্রদের বাড়তি কষ্টের কারণেও বলছেন। মূলত তারা এসব বলছেন, চামড়ার মূল্য না পাওয়া এবং চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের শিকার হয়ে কষ্ট পাওয়ার কারণে। তাদের আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা।

কিন্তু এখানে অন্য একটি বিষয় সবার বিবেচনা করা দরকার। আজকের চামড়ার বাজার নিয়ে ষড়যন্ত্রকারী দুশমনরা ষড়যন্ত্র করার কারণে এই অঙ্গন যদি ছেড়ে দেওয়া হয়, কাল তো রমজান মাসে যাকাতের টাকা মাদ্রাসায় না দিয়ে অন্য কোথাও দেওয়ানোর নতুন ষড়যন্ত্র উৎপাদন করা হতে পারে। এরপর মাদ্রাসা গুলোতে যারা ভালোবেসে সাধারন দান করেন, সেখানেও বাগড়া দেওয়া শুরু হতে পারে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কয়টি জায়গা থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেবেন? ষড়যন্ত্র শুরু হলেই যদি অঙ্গন ত্যাগ করা শুরু হয়, তাহলে কওমি মাদ্রাসা সাধারণ জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা এবং ধর্মপ্রাণ দ্বীনদারদের স্বতঃস্ফূর্ত আর্থিক সম্পর্ক থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে কোন পথে হাঁটবে? মাদ্রাসাগুলোর সাধারণ এবং বোর্ডিং-এর গোরাবা ফান্ডের অর্থ কোত্থেকে সংগ্রহ করবে? এভাবে পিছিয়ে আসতে থাকলে পেছনের দেয়ালে এসে পিঠ লাগানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। (এটা বাহ্যিক বিবেচনা থেকে বলা হয়েছে।)

সুতরাং আমার প্রস্তাব হলো, সীমিত, ভদ্রোচিত ও কার্যকর আয়োজনের মধ্য দিয়ে কোরবানির চামড়া কালেকশন বজায় রাখা দরকার। গরিব ছাত্রদের জন্য সমাজের ভেতর থেকে আসা আয় ও সহযোগিতার প্রচলিত কোনো অঙ্গন ছোটখাটো ধাক্কায় ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।

দ্বিতীয় আরেকটি ব্যাপার হলো, চামড়ার সিন্ডিকেট ভাঙার আওয়াজ উপরে উঠার পর থেকে অনেকেই বেফাকুল মাদারিস অথবা হাইয়াতুল উলয়ার নেতৃত্বে ট্যানারি প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। বেফাক আর হাইয়া তাদের রুটিন কাজ করতেই তো হিমশিম খাচ্ছে। এ দুটোই মূলত শিক্ষাবোর্ড। শিক্ষা সিলেবাস, মাদ্রাসাগুলোর সমন্বয়, পরীক্ষা আয়োজন- এ সব কাজ ঠিকঠাক মতো করতেই তাদের অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। প্রায় সব কিছু সবার চোখের সামনেই তো। এই অবস্থায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগে ট্যানারি প্রতিষ্ঠার নতুন দাবি তোলা কতটা যুক্তিযুক্ত, ভেবে দেখতে পারেন।

আমার বরং মনে হয়, চামড়ার মূল্যের এই সংকট থেকে বাঁচতে হলে ট্যানারি প্রতিষ্ঠা নয়, বরং ঢাকা থেকে নিয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগে চামড়া লবণ দিয়ে রক্ষা করার জন্য অস্থায়ী আড়ত প্রতিষ্ঠা করা দরকার। কোনো এলাকায় বড় মাদ্রাসার মাঠের একপাশেও হতে পারে। দেশব্যাপি এটা সংখ্যায় অনেকও হতে পারে। তুলনামূলক সহজসাধ্য প্রোগ্রাম এবং বাস্তবানুগ। প্রাথমিকভাবে কাঁচা চামড়া টিকিয়ে রাখার পর এক-দুই-তিন মাসের মধ্যে ভালো মূল্যের বিনিময়ে দেশের ট্যানারিতে দেওয়া যাবে কিংবা দেশের বাইরেও রপ্তানি করা যাবে। প্রাথমিকভাবে এটাই সহজ।

দেশের বাইরে রপ্তানির কথা উঠলে অনেকেই আবার ভারতের চামড়া শিল্পের বাজারটা লাভবান হওয়ার কথা বলেন। এক্ষেত্রে চামড়া বিক্রির জন্য ভারত, চীন কিংবা অন্য কোনো দেশের বাজার বেছে নেওয়া যেতে পারে। মূল উদ্দেশ্য থাকবে চামড়ার যথাযথ মূল্য পাওয়া, অন্য কিছু নয়। আর যদি দেশের ট্যানারিওয়ালারাই বার্গেনিংয়ে ভালো অফার নিয়ে আসে তাহলে তাদেরকেও দেওয়া যাবে, কোনো সমস্যা নেই। এখানে মূল বিষয় থাকবে সামর্থ্য, নিজস্ব সম্পদ রক্ষা, সম্পদের যথাযথ মূল্য পাওয়া, একদম প্রফেশনাল আয়োজন ও দৃষ্টিভঙ্গি। গরিবের হক রক্ষার জন্য এমন ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

তাছাড়া কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে ব্যক্তিগত ব্যবহার বিষয়ে অনেক প্রস্তাব এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চামড়া ভালো করে প্রসেস করে খাওয়া যায়, পাটির মতো ঘরের কাজে ব্যবহার করা যায়, শোপিস হিসেবে কাজে লাগানো যায় -এমন আরও বহু প্রস্তাবের প্রতিটি সম্ভাব্যতা নিয়েই কাজ করা যেতে পারে। সুবিধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

চামড়ার বাজার নিয়ে যে ঘৃণ্য সিন্ডিকেটের দৃশ্য এবার দেখা গেল, যেকোনো মূল্যে এখান থেকে বের হওয়া দরকার। চামড়া কেন্দ্রিক শিল্প রক্ষার দাবি ও চেতনা, এটা ঠিক আছে। কিন্তু এর জন্য এই পণ্যের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নিয়ন্ত্রক পর্যায়ের মানুষদের বাস্তববাদী ও আন্তরিক হতে হবে। তা না হলে এক মুখে শিল্পের কথা বলা, আরেক মুখে গরিবের হক মেরে ১০০ টাকা/দেড়শ টাকায় চামড়া কেনার ব্যবস্থা করা, দুঃখে কষ্টে মানুষকে চামড়া মাটিতে পুতে ফেলতে বাধ্য করা এটা ঠেকানো যাবে না। এতে শিল্পও টিকবে না, গরিবের হকও টিকবে না। আগে গরীবের হক, পরে বড়লোকের শিল্প।

লেখকের ফেইসবুক  পোস্ট থেকে নেওয়া

পূর্ববর্তি সংবাদযমুনায় বিয়ের নৌকা ডুবে ২ জন নিহত, নিখোঁজ ৬
পরবর্তি সংবাদমিয়ানমারে বন্যা-ভূমিধস: নিহত বেড়ে ৬৫