হজ্বের সফরে প্রফেসর হযরতের সাথে কিছু মুহূর্ত

মুহাম্মদ আদম আলী ।।

(এক)

রোদে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আর না হাঁটি। রাস্তার পাশেই নামাযে দাঁড়িয়ে যাই। দুপুরে মাথার উপর সূর্যও হাঁটে। এত প্রখর এর তাপ! সহ্য হয় না। ছাতা এখনো কেন হয়নি। কষ্ট করে কষ্ট কেনার আশায় ছাতা কেনা হচ্ছে না। মানুষের পায়ের ভারে রাস্তায় খস খস শব্দ হয়। এ শব্দে ছন্দ আছে। মনে বড় মায়া লাগে। এ ছন্দে হাঁটব বলে কতই না স্বপ্ন ছিল! কষ্টের তোড়ে ছন্দ উবে যায়। মায়াও আর থাকে না। আমি বিভ্রান্ত পথিক হয়ে উঠি। তবু আমাকে হাঁটতে হয়। খোলা চত্ত্বর আমাকে টানে। যত না টান, তার চেয়ে বেশি পুলিশের হাঁক-ডাক। ইয়া হাজ্জি, তরিক! তরিকই টেনে নিয়ে যায় খোলা চত্ত্বরে।

চত্ত্বরে সাদা ময়দান। মরুভূমির মতো এখন বিরান। কেউ সাহস করে না দাঁড়ানোর। উচু দালানের ছায়ায় গুচ্ছ গুচ্ছ কাতারবন্দি মানুষ। চারিদিকে আজীব ব্যারিকেড। সেদিকে এগুতে দেয় না। একটু পরেই দেখি আমি একটা খাঁচায় ঢুকে পড়েছি। বাদশা ফাহদ গেইটের কাছে ব্যারিকেড দিয়ে প্রশস্ত খাঁচা বানানো হয়েছে। খাঁচা ঘিরে কড়া রোদে তেতানো পুলিশের নিষ্ঠুর পাহারা। এখানে একবার ঢুকলে আর বের হওয়ার উপায় থাকে না। অগত্যা সূর্যের প্রখর উত্তাপে যোহর পড়তে হয়। এত কষ্টের পরও কষ্ট অধরাই থাকে!

কষ্ট কিনে নষ্ট হৃদয়ে ঝড় তোলার কথা ছিল। এ ঝড়ে হৃদয়ের সব আবর্জনা দূর হয়ে যাবে। হয় না। আমরা কষ্টকে এখনো ভালোবাসতে শিখিনি। হাফেজ্জী হুযুর রহ. ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন। তিনি কষ্টকে ভালোবেসে ছিলেন। এ ভালোবাসা আমাদের কবে হবে?

প্রফেসর হযরতও কষ্টকে ভালোবাসেন। তার নুইয়ে পড়া দৃষ্টিতে সেই ভালোবাসা দেখা যায়। কতটুকু ভালোবাসলে কষ্টকে ভালোবাসা মূর্ত হয়ে ওঠে?

প্রফেসর হযরত ভালোবাসা নিয়ে একটা কবিতা বলেন। কার কবিতা মনে নেই। হাজীদের হাঁটার ছন্দের সাথে আমার সেই কবিতার ছন্দ মনে পড়ে: জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কয় হাসি মা তোমারে কত ভালোবাসি। কত ভালোবাস ধন, জননী শুধোয়। এ-ত বলি শিশু দু হাত বাড়ায়ে দেখায়। মা, তুমি আমারে ভালোবাস কতখানি? মা কহে, আমি তার মাপ নাহি জানি।

(দুই)

তাবুতে পা রাখার জায়গা নেই। ফোমের তোষক আর বালিশ দিয়ে পুরো তাবু ছেয়ে রেখেছে। মাথা গুনে বালিশ। তারপরেও কয়েকজন মাথা রাখার জায়গা পাচ্ছে না। এত ছোট তাবুতে এর আগে কখনো থাকিনি। মীনায় কেউ থাকতে আসে না। অবস্থান করতেই সবাই বলে। এজন্য কোনোরকম ব্যবস্থা হলেই চলে। সবাই মেনে নেয়। যারা মানতে পারে না, তারা খামাখাই গোত গোত করতে থাকে। তাকেও একটু পরে আর খুজে পাওয়া যায় না। কোনো বালিশের নিচেই তাকে আবিষ্কার করতে হয়।

যোহরের এখনো বাকি আছে। ঘুমাতে পারছি না। বাথরুমে যেতে হবে। মনে করতেই পা নড়ছে না। এখন পা ঠিক থাকলেও ফিরে আসার পর পা আর চলবে না। উঠি উঠি করছি। এসময় দেখি প্রফেসর হযরত মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সবার মধ্যখানে দাড়িয়েছেন। কিছু বলবেন মনে হয়। এখন তো তালীম হওয়ার কথা না।

প্রফেসর হযরতের জন্য ঢাকা থেকে একটা খাট আনা হয়েছে। সেটি হযরতকে জানানো হয়নি। মীনার তাবুতে খাট থাকে না। হযর‍তের মাটিতে বসতে-উঠতে কষ্ট হয়। তবু তিনি সেটিতে থাকতে চাচ্ছেন না। কারণ খাটটি দুজনের জায়গা দখল করেছে। এজন্য তিনি মাইকে ঘোষণা করলেন :

আমি হামীদুর রহমান, এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, বুয়েট বলছি, আমার মাশওয়ারা ছাড়া এই খাট আনা হয়েছে। এটি দুজনের জায়গা নিচ্ছে। আমি এটি ব্যবহার করতে চাই না। যতক্ষণ না আপনারা অনুমতি দিবেন।

কাফেলার সবাই তো তাকে কেন্দ্র করে এসেছে। তার অবস্থা জানেও। এটা জিজ্ঞেস করার দরকার ছিল না। আমরা তো আর বুযুর্গ না। বুযুর্গদের আমল ভিন্ন। সহজে কোনো সুবিধা নিতে চান না। আমরা সবাই জোরে আওয়াজ তুলে বললাম, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তারপর হযরত শান্ত হলেন। খাটে গিয়ে বসলেন। আহ! এমন শায়েখ কে কবে দেখেছে!

পূর্ববর্তি সংবাদঝড় থেমে গেছে, উকুফে আরাফার পর এবার মুযদালিফায় যাচ্ছেন হাজীরা
পরবর্তি সংবাদভারত বলছে বিক্ষোভে ছিল বিশ-ত্রিশ জন লোক, ভিডিও দেখাচ্ছে ভিন্ন চিত্র (ভিডিও)