কাশ্মীরের ঘটনা মনে করিয়ে দেয় হারানো হায়দারাবাদের কথা

ওলিউর রহমান ।। 

সম্প্রতি ভারত সরকার কর্তৃক সে দেশের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে কাশ্মীরের সাংবিধানিক বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করা হয়েছে। ৫ আগস্ট সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের মাধ্যমে স্বাধীনতা বঞ্চিত নির্যাতিত কাশ্মীরিদের যে কাগুজে মর্যাদা এতদিন বলবৎ ছিল কেবল তাই বিলুপ্ত করা হয়েছে নতুবা ভারত স্বাধীন হওয়ার সত্তর বছরে কাশ্মীরের উপর আক্রমণ ও সেনা-অভিযান তো অব্যাহতই ছিল। ভারি অস্ত্র দিয়ে অতিরিক্ত সেনা পাঠিয়ে ৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে ১৪ বার সেনা-অভিযান চালানোর সংবাদ খবরে প্রকাশিত হলেও ৬০ লাখ কাশ্মীরি বাসিন্দার বিপরিতে মোতায়েনকৃত ৭ লাখ ভারতীয় সেনা  প্রতিমুহূর্তেই অসহায় মানুষদের উপর যে কী নিপীড়ন করে তার খবর তো কেবল খোদা জানেন।

৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে চূড়ান্তভাবে কাশ্মীরকে ভারতের একটি সাধারণ রাজ্যে পরিণত করার খবর দখলদার ভারত কর্তৃক হায়দারাবাদ দখলের আরেকটি নির্মম ট্যাজেডির কথা মনে করিয়ে দেয়।

দুশো বছর রক্ত চুষে যুলুম করে খাওয়া বেনিয়া ইংরেজদের থেকে ৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় ব্রিটিশ অবিভক্ত ভারতের ৫০০ টি স্বায়ত্তশাসিত ভারতের সাথে যোগ দেয়। পাকিস্তানের সাথে যায় কিছু। জুনাগড়,কাশ্মীর,হায়দারাবাদ স্বাধীন থাকতে চায়। কৌশলে, ধোঁকা দিয়ে এবং অন্যান্য উপায় অবলম্বন করে কাশ্মীর আর জুনাগড়কে থামানো গেলেও কয়েকশো বছরের স্বাধীন হায়দারাবাদ ভারতের পরাধীনতা মনে নেয়নি।

হায়দারাবাদ প্রধানকে বলা হতো নিজাম-উল-মুলক। হায়দারাবাদেরর ছিলো কয়েকশো বছরের স্বাধীনতার সমৃদ্ধ ইতিহাস। তাদের নিজস্ব মুদ্রা ছিল। পৃথক সংস্কৃতি ছিল। হায়দারাবাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল আলাদা। ২ লাখ ১৪ হাজার বর্গ কিলোমিটারের হায়দারাবাদের জনসংখ্যা ছিল দেড় কোটির মতো।

কিছুকাল মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত থাকলেও সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তদানীং নিজাম কামরুদ্দীন আবার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ শাসনামলে হায়দারাবাদের নিজাম ইংরেজদের আনুগত্য গ্রহণ করে নেয়। তবে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হায়দারাবাদের ৭ম নিজাম উসমান আলী ভারতের সাথে হায়দারাবাদেরও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

অনেক চেষ্টা-তদবিরেরর পরেও যখন হায়দারাবাদ ভারতের বশ্যতা স্বীকার করল না তখন ভারত প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ঘোষণা করলেন, ‘হায়দারাবাদ স্বাধীন হলো ঠিক, তবে আমরা যখন প্রয়োজন মনে করব হায়দারাবাদের বিরুদ্ধে সেনা-অভিযান পরিচালনা করব’।

এক পর্যায়ে হায়দারাবাদ দখলের ব্যাপারে ভারত বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যার অংশ হিসেবে হায়দারাবাদে কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকদের সক্রিয় করা হয়। হায়দ্রাবাদের রাজনীতিকে কলুষিত করা হয়। শিক্ষাঙ্গন, সাংস্কৃতিক জগৎ, বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভারত সরকারের অনুগত লোক তৈরি করা হয়। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অনুগত দালাল সৃষ্টি করা হয়। এমনকি সেনা-প্রধান আলি আহমদ সৈয়দ আল ইদরিসকেও নানা প্রলোভন দেখিয়ে ভারতের অনুগত বানানো হয়। হিন্দু মৌলবাদীদের দিয়ে নানা রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উস্কে দেয়া হয়। কংগ্রেসের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু মহাসভা, আরএসএস ও আর্য সমাজ এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

হায়দারাবাদের বিখ্যাত চার মিনার মসজিদ

বাহির থেকে নানামুখি ষড়যন্ত্র করে হায়দারাবাদের অভ্যন্তরীর পরিস্থিতি যখন আক্রমণের উপযোগী করে তোলা হয় এরকম পরিস্থিতিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার প্যাটেল হায়দারাবাদকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেন।

১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮। রাজধানী তেলেঙ্গুনায় কম্যুনিস্ট বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে ‘অপারেশন পোলো’ নামে হায়দারাবাদে সামরিক অভিযান ঘোষণা করা হয়।

ভারতের বিখ্যাত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৫ ব্যাটালিয়ন পদাতিক সৈন্য এবং একটি আর্মার্ড স্কোয়াড্রন (ট্যাংক) নিয়ে হায়দারাবাদ আক্রমণ শুরু হয়।

সেনা-প্রধান সৈয়দ আলি আহমদ আল ইদরিস থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদাধীকারী অনেকেই যেহেতু আগে থেকেই ভারত সরকারের সাথে যুদ্ধ শরীক না হওয়ার চুক্তিবদ্ধ ছিল তাই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তেমন বাঁধার মুখোমুখি হতে হয়নি।

আল ইদরিস দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অরক্ষিত রেখেছিল। সেনাবাহিনীকে করে রেখেছিল অপ্রস্তুত অবস্থায়। সেনাপ্রধানের সহায়তায় ভারত সরকার হায়দারাবাদে তার বিপুল সেনাশক্তি, পদাতিক বাহিনী ও বিমান বাহিনীসহকারে শুরু করলো সামরিকভাবে আক্রমণ। প্রথমে ট্যাংক বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। এরপর বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করে বিভিন্ন বিমানবন্দর ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে আর্য সমাজ ও অন্যান্য হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলো হায়দ্রাবাদে প্রায় দুই লাখ মুসলিমদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালায়

মাদরাসা, মসজিদসহ মুসলমানদের অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়া হয়।

পাঁচ দিন ধরে চলা যুদ্ধে হায়দারাবাদ সেনাবাহিনী পরাজিত হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর নিজাম উসমান আলী খান রেডিওতে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন। দখলদার ভারত ২ লাখ মানুষের গণহত্যার বিনিময়ে আরও একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড নিজের দখলে নেয় এবং কর্নাটক,অন্ধ ও মহারাষ্ট্র এই তিনটি প্রদেশে হায়দারাবাদকে বিভক্ত করে দেয়।

২ লাখ মানুষের গণহত্যার ওই ঘটনার ব্যাপারে ভারত সরকার কখনোই কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ফলে খুব অল্পসংখ্যক ভারতীয়ই ওই গণহত্যার কথা জানে। সমালোচকরা দাবি করেন, ভারতের প্রতিটি সরকারই ওই ঘটনার তথ্য গোপন করে রেখেছে।

হায়দারাবাদের কথা বললে বিখ্যাত উর্দু কবি দাগের কয়েকটি পঙক্তি মনে পড়ে খুব।

 দিল্লি সে চলে দাগ, করো সায়র ডেকান কি,

গওহর কি হুয়ি কদর,সমুন্দর সে নিকাল কে।

হায়দারাবাদ রাহে তা বা কেয়ামত কায়েম,

এহি আয় দাগ, মুসলমান কি এক বস্তি হ্যায়।’

পূর্ববর্তি সংবাদবাসের ভাড়া বেশি তাই ট্রাকে করেই যাচ্ছেন তারা
পরবর্তি সংবাদপাকিস্তানকে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করতে অনুরোধ করল ভারত