জেনে নিন আশারায়ে যিলহজ্বের কিছু আমল

মুহাম্মদ দানিশ  ।।

যিলহজ্বের প্রথম দশককে পরিভাষায় ‘আশরায়ে যিলহজ্ব’ বলে। এই দশ দিন হচ্ছে বছরের সর্বোত্তম দশ দিন। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে এই দশকের রজনীগুলোর শপথ করে বলেছেন, (তরজমা) ভোর বেলার কসম আর কসম দশ রাত্রির।-সূরা ফজর : ১-২ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. ও মুজাহিদ রাহ.সহ অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও মুফাসসিরের মতে এখানে দশ রাত্রি দ্বারা আশরায়ে যিলহজ্বই উদ্দেশ্য।

এই দশ দিনের যে কোনো আমল চাই নফল নামায-রোযা হোক বা যিকির-তাহাজ্জুদ, তা আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয় ও অতি পছন্দনীয়। তাই যে কোনো নফল ইবাদত যেমন নামায-রোযা, যিকির-তাহাজ্জুদ, দান-খয়রাত ইত্যাদি এই দশ দিনে করা হলে তার ফযীলত ও মর্যাাদা বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যাবে। তাই এই ক’দিন সাধ্যমতো নফল ইবাদতের প্রতিও মনোযোগী হওয়া উচিত। এছাড়া বিভিন্ন হাদীসে এই দশ দিনের বিশেষ কিছু আমলের কথাও বলা হয়েছে। যেমন-

ক) যিলহজ্বের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করার আগ পর্যন্ত- স্বীয় নখ ও চুল না কাটা। এটি মুস্তাহাব।হযরত উম্মে সালমা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা যদি যিলহজ্বের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ যদি কুরবানী করার ইচ্ছা করে থাকে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৯৭৭; মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৯

আল্লাহ তাআলা এই দিনগুলোতে হজ্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমান্বিত একটি ইবাদত মুসলমানের উপর ফরয করেছেন। সামর্থ্যবান ‘আশিকে রব’ এই দিনে ইহরামের শুভ্র লেবাস পরিধান করে যখন বাইতুল্লাহ অভিমুখী হয় তখন তার উপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপিত হয়। তন্মধ্যে চুল ও নখ কাটতে না পারাও একটি। কিন্তু বাইতুল্লাহর যিয়ারতের সৌভাগ্য যারা অর্জন করতে পারেনি, পারেনি কাবার কালো গিলাফের ছায়ার কাছে যেতে, পৃথিবীর দূর-দূরান্তে- ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব ‘অভাগা’ মুমিনদের প্রতিও আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানীকে আকৃষ্ট করতে আদেশ করা হয়েছে যে, তোমরা ‘ভাগ্যবান’ হাজ্বীদের সাদৃশ্য অবলম্বন কর। তোমরাও নখ-চুল কেটো না। আল্লাহর রহমতের বারিধারা তোমাদেরও স্নাত করে তুলতে পারে।

ইসলাহী খুতবাত ২/১২৪-১২৫

খ) আশরায়ে যিলহজ্বের দ্বিতীয় বিশেষ আমলটি হল, ঈদুল আযহার দিন ব্যতীত প্রথম নয় দিন রোযা রাখা। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনগুলোতে রোযা রাখতেন।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪৩৭; মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৭, হাদীস : ২৫৯২০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ২৪১৬; মাআরিফুস সুনান ৫/৪১-৪৪

অন্য দুটি যয়ীফ বর্ণনায় এসেছে যে, এই দিনগুলোর একেকটি রোযায় রয়েছে এক বছরের রোযার সমান ছওয়াব।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৫৮; বায়হাকী-শুআবুল ঈমান ৩/৩৫৬ হাদীস : ৩৭৫৮; তারগীব হাদীস : ১৭৩১; আত তা’রীফ ৫/৫১৫-৫১৭ হাদীস : ৮৩৫ গ)

এই নয়দিনের রোযার মধ্যে নবম তারিখ বা আরাফার দিনের রোযা সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ। অতএব পুরো নয়টি রোযা রাখতে না পারলে এই একটি রোযা থেকে কারো বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। সহীহ হাদীসে হযরত আবু কাতাদা রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আরাফার দিন অর্থাৎ নবম তারিখের রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মিটিয়ে দেবেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৬২; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৪৯

তবে মনে রাখা উচিত, অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে হাজীদের জন্য এই দিনে আরাফার ময়দানে ওকূফ ও মুজাহাদার শক্তি অর্জনের নিমিত্তে রোযা না রাখা উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন হজ্বের মধ্যে এই দিনের রোযা রাখতেন না।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১২৩, ১১২৪; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৭৫০-৭৫১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪১৯; মাআরিফুস সুনান ৫/৪৩০-৪৩১

যিকর ও তাকবীর প্রসঙ্গ

আশরায়ে যিলহজ্বের পরবর্তী তিন দিন অর্থাৎ এগার, বার ও তের তারিখকে পরিভাষায় ‘আইয়ামে তাশরীক’ বলে। আশরায়ে যিলহজ্বের দশ দিন ও আইয়ামে তাশরীকের তিনদিন সর্বমোট যিলহজ্বের এই প্রথম তের দিনের একটি আমল রয়েছে। তা হচ্ছে বেশি বেশি আল্লাহর যিকির ও তাকবীর পাঠ। আল্লাহ তাআলার যিকির এবং তাওহীদের চেতনায় সর্বদা উজ্জীবিত থাকা এবং শিরকের পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত তাওহীদের শিক্ষায় উদ্ভাসিত ঈমানী যিন্দেগী গঠনের লক্ষ্যে সম্ভব সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করা প্রত্যেক মুমিনের সার্বক্ষণিক কর্তব্য। কারণ দ্বীন-ধর্ম ও আমল আখলাক সবকিছুর মূল হল, নির্ভেজাল তাওহীদ।

আল্লাহর একত্ব ও মহত্বের উপর সকল মুমিনের বিশ্বাস হতে হবে সুদৃঢ় ও মজবুত। এই বিশ্বাসে খুঁত থাকলে পর্বতসম আমলেরও কোনো মূল্য নেই। তাইতো মুমিনের দিলে তাওহীদের শিক্ষাকে আরো মজবুত আরো শাণিত করতেই এই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকির করতে বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাসের সবটুকু মিশিয়ে মুমিন বলবে আল্লাহু আকবার, ওয়াহদাকা লা-শারীকা লাকা।

আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন- (তরজমা) তোমরা কয়েকটি নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহকে (বেশি বেশি) স্মরণ কর।-সূরা বাকারা : ২০৩ অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন- (তরজমা) ‘যাতে তারা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে।’-সূরা হজ্ব : ২৮ এই আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলির দ্বারা প্রায় সকলের মতে আশরায়ে যিলহজ্ব ও আইয়ামে তাশরীকের এই তেরটি দিনই উদ্দেশ্য। বিশেষ করে এই দিনগুলোতে আল্লাহর যিকিরের প্রতি আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ সম্পর্কে আল্লামা খাত্তাবী রাহ. বলেন, জাহেলী যুগের লোকেরা যুগ যুগ ধরে তাদের কথিত প্রভুদের নামে পশু-প্রাণী উৎসর্গ করত। এর প্রতি উত্তরে মুমিনদের প্রতি আদেশ করা হয়েছে তারা যেন আল্লাহর যিকির ও তাকবীরের মাধ্যমে তাওহীদ ও আনুগত্যের ঘোষণা দান করে। আল্লাহই একমাত্র ইলাহ। তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি ছাড়া কারো নামে প্রাণী উৎসর্গ করা যাবে না। কারণ তা সুস্পষ্ট শিরক।-ফাতহুল বারী ২/৫৩৫ সাহাবায়ে কেরাম এই দিনগুলোতে সর্বদা আল্লাহু আকবারের ধ্বনি তুলতেন।

হযরত ইবনে উমর রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বাজারে গিয়ে তাকবীরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীরের সুর তুলত। ইবনে ওমর রা. পথে-ঘাটে, হাঁটা-বসায়, বাজারে-ঘরে এবং নামাযের পরে শুধুই তাকবীর বলতে থাকতেন। মিনার দিনগুলোতো তার তাকবীরের সাথে সমস্বরে মানুষের তাকবীরে মিনার পুরো অঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠত। মহিলারাও (নিচু স্বরে) তাকবীর বলতে থাকতেন।-বুখারী-ফাতহুল বারী ২/৫৩০-৫৩৬ সার্বক্ষণিক যিকির ও তাকবীরের আমল ছাড়াও এই তের দিনের প্রায় প্রতিটি ইবাদত ও আমলের সাথে যিকির ও তাকবীরকে এমনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যেন সব আমল-ইবাদতের মূল কথা হল যিকরুল্লাহ, তাকবীর ও তাওহীদ। বাস্তবেও তাই। এজন্য সকল ইবাদতের পরতে পরতে রয়েছে তাওহীদে খালেসের উপস্থিতি। তবে যে কোনো ধরনের যিকির এই সময়গুলোর সার্বক্ষণিক ওযীফা হলেও ক্ষেত্র বিশেষে এর ধরন ও নিয়ম রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন।

যেমন- ১। হাজীরা হজ্বের ইহরাম বাঁধার সময় হতে সার্বক্ষণিক জপবেন তালবিয়া ধ্বনি-লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারীকা লাকা লাব্বাইক …।

২। আশরায়ে যিলহজ্বের শুরু হতে বেশি বেশি যিকিরের যে আদেশ কুরআনে এসেছে। এ ব্যাপারে হযরত ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর নিকট আমলের দিক থেকে আশরায়ে যিলহজ্ব হতে শ্রেষ্ঠ ও অধিক প্রিয় কোনো দিন নেই। অতএব তোমরা এতে তাহলীল, তাকবীর, তাহমীদ ও তাসবীহ বেশি বেশি করো।-মুসনাদে আহমদ ২/৭৫ হাদীস : ৫৪৪৬; তাবারানী মুজামে কাবীর, হাদীস : ১১১১৬

তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল ও তাকবীর এক সাথে আদায় করতে বলা যায়-সুবহানাল্লাহ, ওয়াল হামদুলিল্লাহ, ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’ এই দিনগুলোতে এ ওযীফা বেশি বেশি জপা যায়।

৩। কুরবানীর পশু জবাইয়ের সময়ও বলতে হবে : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার।

৪। হাজীরা জামরায় কংকর নিক্ষেপের সময় দরাজ কণ্ঠে বলবেন : আল্লাহু আকবার।

৫। এই দিনগুলোর মধ্যে আরেকটি অবশ্য করণীয় আমল হল, তাকবীরে তাশরীকের আমল।  প্রত্যেক মুসল্লীর জন্য যিলহজ্বের নয় তারিখের ফজর হতে তের তারিখের আসর পর্যন্ত- প্রত্যেক ফরয নামায আদায় করে সালাম ফিরানোর সাথে সাথে উচ্চস্বরে একবার তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব।-সূরা বাকারা : ২০৩; মুসতাদরাকে হাকেম ১/২৯৯হাদীস : ১১৫২-১১৫৭; ইবনে আবী শায়বা ৪/১৯৫ হাদীস : ৫৬৭৭, ৫৬৭৮, ৫৬৯২

এই তাকবীর সংক্রান্ত যে কয়েকটি গাফলতি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তন্মধ্যে একটি হল মহিলাদের এই আমলের প্রতি যত্নবান না হওয়া। হয়তোবা এর কারণ এও হতে পারে যে, তাদের এই তাকবীরের কথা স্মরণ থাকে না। তা স্বাভাবিকও বটে। কারণ পুরুষরা মসজিদে জামাতে নামায আদায় করে বিধায় খেয়াল না থাকলেও অন্যের দেখাদেখি এই আমল করতে পারে। কিন্তু মহিলাদের তো এই সুযোগ নেই। তাই মহিলাদের উচিত ঘরের যে স্থানে তারা নামায আদায় করে সেখানে পাঁচ দিনের জন্য একটি কাগজ লিখে ঝুলিয়ে রাখা। যাতে জায়নামাযে এলেই তা নজরে পড়ে।

দ্বিতীয় যে গাফলতিটি নজরে পড়ে তা এই যে, ঈদুল আযহার ঈদগাহে যাওয়ার পথে ও পাঁচ দিনের ফরজ নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক আদায় করলেও অনেক পুরুষ তা পড়ে থাকেন মনে মনে বা খুব নিচু স্বরে। অথচ পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরামের এই তাকবীর ধ্বনিতে পুরো আশপাশ কেঁপে উঠত। আর এই তাকবীর উচ্চ স্বরে বলার একটি হিকমত তো এও যে, এর দ্বারা ইসলামের তাওহীদের ঘোষণা প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে দেওয়া হবে। গুনগুন শব্দে এর বহিঃপ্রকাশ কি সম্ভব?-ইসলাহী খুতবাত ২/১২৬-১২৯ পরিশেষে আসুন নির্ভেজাল তাওহীদ, দৃঢ় আক্বীদা ও আল্লাহর মহত্ত্বের উপর অটুট বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে গড়ে তুলি একটি আদর্শ সমাজ, যা হবে শিরকের পঙ্কিলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত তাওহীদের সমাজ। পুণ্যময় তেরটি দিনের এটিই মৌলিক বাণী। তাকবীরে তাশরীকের এটিই মহান শিক্ষা।

 

পূর্ববর্তি সংবাদএবার জনসংখ্যা বাড়াতে তিন সন্তান নীতি চালু করবে চীন
পরবর্তি সংবাদডেঙ্গুর ওষুধ আনতে গড়িমসি, হেলালুদ্দীন আহমদকে হাইকোর্টে তলব