রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৪৮ ঘন্টা: আরব নিউজের প্রতিবেদন

শিহাব সুমন।।

১৮ তারিখ সন্ধ্যায় আমি আমার অফিস থেকে একটি কল পাই। আসছে ২০ জুন আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস উপলক্ষে আমাকে একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরির কাজে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেতে হবে।

আমি খুবই আনন্দিত বোধ করলাম কারণ আমি তো এরকম চ্যালেঞ্জপূর্ণ কাজ করতেই ভালবাসি।

অফিস থেকে আমাকে বলা হল- আমাকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতর আমাকে ৪৮ ঘণ্টা অবস্থান করতে হবে। একজন রিফিউজির মতই আমি সেখানে ৪৮ ঘন্টা থাকব। এ সময়টায় আমি রোহিঙ্গাদের জীবনকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পাব। তাদের ক্যাম্পে তাদের মত কিছু সময় অবস্থান করলে আমার সামনে অনেক কিছু স্পষ্ট হবে।

যাই হোক,  গোটা কর্মজীবনে আমার জন্যে এটি এক  আনন্দপূর্ণ কাজ। সাধারণত ক্যাম্পের ভিতরে  কাউকে অবস্থান করার অনুমতি দেয়া হয় না। আমি রাস্তা খুঁজতে শুরু করলাম। পরিচিতজনেরা বললেন, তারা আমাকে ক্যাম্পের ভিতরে অবস্থান করার সুযোগ বের করে দিতে অপারগ।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা বিভাগে কাজ করেন, ঘনিষ্ঠ এমন একজন বললেন, তিনি আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন। সুতরাং আমি পরের দিন সকালেই কক্সবাজারে পৌঁছে গেলাম এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পৌঁছলাম দুপুরের দিকে।

বর্ষাকাল শুরু হয়েছে কয়েকদিন আগে। কিন্তু গরমও ছিল প্রচন্ড। আমি খুবই ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত ছিলাম। ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেখতে পেলাম, সবাই তাদের নিজদের নিয়ে ব্যস্ত। কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ  লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ত্রাণ সাহায্যের জন্য। কয়েকজন মাকে দেখলাম, তারা বিভিন্ন মেডিকেল সেন্টারে তাদের শিশুদেরকে নিয়ে যাচ্ছেন।  এখানে ওখানে স্কুল থেকে ফিরছে অনেক বালক-বালিকা।

আমি ক্যাম্পের আরও ভিতরে গেলাম। আমি একটা বাসা খুঁজছিলাম, যারা আমাকে দুপুরে খাওয়াবে। কিন্তু সবাই বললেন, তাদের খাবার শেষ হয়ে গেছে।

সবশেষে গেলাম লোকমান হাকিমের বাড়ি। তারা আমাকে দুপুরের খাবারে তাদের মেহমান হিসাবে গ্রহণ করলেন। তাদের কাছে কোনো তরকারি ছিল না। কয়েকটা পেঁয়াজ আর মরিচ দিয়ে খুব স্বাদ করে খেলাম। তারা আমাকে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছে।

ভাবলাম, প্রতিদিন  দুপুরে  আমি কি খাই আর আজ কী খেলাম! কিন্তু ক্যাম্পের লোকজন তো প্রতিদিনই এই খাবার খাচ্ছেন।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন উৎসুক জনতা জমা হয়ে গেল। তারা দেখতে চাচ্ছিল, কে এই হঠাৎ আগত মেহমান?

যদিও এখন ত্রাণ সাহায্য বিতরণ আগের তুলনায় খুবই সুবিন্যাস্ত, কিন্তু তারপরও মানুষকে লম্বা সময় এই ত্রাণসাহায্য গ্রহণের জন্য লাইন ধরতে হয়।

কামাল হোসেন, (৬৪)  কুতুপালং ক্যাম্পের একজন শরণার্থী, এক ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার রেশনের জন্য। ৯সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের প্রধান  বলছিলেন, ‘যে খাবার আমি নিয়েছি তা আমার পরিবারের এক মাসের জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু আমি আমার পরিবারকে মাছ কিংবা গোশত ব্যবস্থা করে দিতে পারি না। মাছ গোশত তো আর রেশন এর অন্তর্ভুক্ত থাকে না।’ বলছিলেন কামাল হুসাইন।

তাইবা বেগম বলছিলেন,  ‘কখনো কখনো আমরা আমাদের ত্রাণের সামগ্রীগুলোকে বিক্রি করে কিছু মাছ-গোশত সংগ্রহ করি বাচ্চাদের জন্য।’

আমি মনে মনে একটা হিসাব করলাম, ঢাকায় আমার একদিনে দুপুরবেলা যা খরচ হয়,  তাদের তো একমাসেও সেই পরিমান খরচ হয় না।

আমি তাইবা বেগমের তাঁবু দেখতে গেলাম। ১০ ফিট বাই ১০ ফিট তাঁবুতে তার সাত সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের বসবাস। এই এতটুকু জায়গার মধ্যেই তারা ছয় সাত জন মানুষ গাদাগাদি করে থাকে। গত বছর লাকড়ি সংগ্রহ করাটা তাদের জন্যে অনেক কঠিন একটা ব্যাপার  ছিল। এই বছর তাদেরকে একটি গ্যাসের স্টোভ দেওয়া হয়েছে, যা তাদের রান্নাবান্নাকে সহজ করে দিয়েছে।

আমি অনেক শিশু-কিশোরদের সাথে দেখা করলাম যারা স্কুলে যাওয়া-আসা করে না। জাতিসংঘের মতে, প্রায় ৫৫  হাজার রোহিঙ্গা শিশু, যারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ৫৫ পার্সেন্ট, তাদের অধিকাংশ এখনো স্কুল শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে।

রাতের বেলা গোটা ক্যাম্প এক ভুতুড়ে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে  গেল। বাংলাদেশ সরকার ক্যাম্পের  প্রধান রাস্তাগুলোতে বিভিন্ন সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছে।  ক্যাম্পের ভেতর দোকানগুলো দেখলাম আটটার মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল।

একটি চায়ের দোকানের পাশে বসা ছিল কয়েকজন যুবক। তাদের সাথে দেখা করলাম। তারা সবাই তাদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। তাদের  কোনো পড়ালেখা নেই। তাদের কাজ করার কোন সুযোগ নেই। এমনই কথা বললেন মাহমুদ জালাল, শামসুল আলম, মুজিবুর রহমান, আব্দুর রশিদ।

আব্দুর রশিদ জিজ্ঞেস করলেন, আমরা সারাদিন বেকার বসে থাকি,  এখানে ওখানে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করি। আমাদের কোন কাজ নেই। কিন্তু আমরা এভাবে  বেকার কতদিন থাকবো?

অনুবাদ: এনাম হাসান জুনাইদ

 

পূর্ববর্তি সংবাদভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ঢাবির ৮৭ শিক্ষার্থীসহ ১২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র
পরবর্তি সংবাদকুলাউড়ায় গভীর রাতে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা, নিহত ৭, আহত ২৫০