মক্কার বুকে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের সুর: হামিদ মীর

এবছর রমযান মাস আসার পূর্বে অন্তরে উমরা করার খেয়াল আসল। প্রয়োজনীয় বিষয় জেনে নিলাম। তখন আমাকে বলা হলো অনেক দেরী হয়ে গেছে। রমযানে অনেক ভীড় হয় এজন্য রমযানের দুই তিন মাস আগ থেকেই সমস্ত প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। আপনি আগামী রমযানে আগে চেষ্টা করে দেখুন।

কিন্তু আল্লাহর কি কারিশমা এই রমযানের মধ্যেই সৌদি সরকারের ঘোষকদের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো মে মাসের শেষের দিকে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের গুরত্বপূর্ণ বৈঠক সৌদিতে অনুষ্ঠিত হবে। আমাকেও ঐ বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য ডাকা হলো। এই বৈঠকের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট হলো, তারা মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতি বছরই মক্কা মুকাররমায় একত্র করেন।

রমযানের শেষ দশকে মক্কা মুকাররমায় প্রচন্ড ভীড় হওয়ার কারণে বাদ মাগরিব সাধারণ লোকদেরকে মসজিদে হারামে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। মহিলারাও মসজিদে হারামে প্রবেশ করে, অবশ্য পুরুষেরা ইহরাম না বাধঁলে তাদেরকে মসজিদের সীমানার বাহিরে নামাজ আদায় করতে হয়।

আমি দিনে উমরা আদায় করায় কষ্ট কিছুটা কম হলেও আমার মায়ের নামে উমরা আদায় করার ইচ্ছাটা এখনো বাকি আছে। সাথে বাইতুল্লাহর সামনে ইফতার করার আকাঙ্খা ও অন্তরে ছিলো, তাই ফায়সালা করলাম পরবর্তী উমরার ইহরাম মসজিদে আয়েশা থেকে করবো।

ইহরাম বাধাঁর কারণে হারামে তো প্রবেশ করলাম কিন্তু সাথে ইফতার নিয়ে যায়নি। ইফতারের কয়েক মিনিট পূর্বে হারামে প্রবেশকারী একজন বোরকা পরিহিতা মহিলা আমার হাতে কয়েকটা খেজুর ‍এগিয়ে দিল, আরেকজন দিল পানি, অন্য একজন জুসের বোতল ধরিয়ে দিল। আসলে সেখানে আগত প্রত্যেকেই নিজেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মেহমান মনে করেন এবং ইফতারের সময় নিজের চেয়ে অন্যের চিন্তা বেশী করেন।

লোকজন সাধারণত আসর নামাজের পর কাতারেই মাগরিবের অপেক্ষায় বসে থাকে, যেন কাবা শরীফের সামনে নামাজ আদায় করার খৈাম নসীব হয়। আমিও এক কাতারে জায়গা পেয়ে বসে থাকলাম।

ইফতারের পর নামাজ শুরু হল। ক্লান্তি ও অবসন্নতা সত্বেও নামাজের মধ্যে একাগ্রতা ‍ছিল। আমার আশে পাশে অনেক মহিলারাও পুরুষদের মত নামাজ আদায় করছিল। কারো হাত সিনার উপর, আবার কারো হাত খোলা ছিল। কেউ সাদা, কেউ কালো, ভাষা, বর্ণ ও গোত্র যদিও বিচিত্র রকমের ছিল কিন্তু সকলেই আল্লাহর সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।

মসজিদে হারামে আদায়কৃত এই নামাজে সৌদি, ইরানী, এবং পাকিস্তানী ও আফগানিস্তানীদের মাঝে কোন ভেদাভেদ ছিল না। বরং সকলের পরিচয় হল তারা মুসলমান। আল্লাহ, কুরআন ও রাসূলকে এক মেনে মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে একত্র হয়েছে। কিন্তু এই ঐক্যটা এই দুই মসজিদের বাহিরে কেন দেখা যায়না? এই প্রশ্নটি মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে বারবার আমাকে চিন্তা ফিকিরের প্রতি উদ্ভুদ্ধ করছিল। কাবার তওয়াফ এবং সাফা, মারওয়া সায়ী করার সময় আমার চেয়ে কম বয়সী এক যুবক চোখে পড়ল।

এক সময় তো এমন ছিলো যে, শুধু বৃদ্ধলোকেরা হজ্জ ও উমরা করত, আর বলা হতো, যখন গুনাহ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে তখন সওয়াব অর্জনে বের হয়। কিন্তু সময়ের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। এখন হজ্জ ও উমরায় যুবকদের পরিমাণ বেশী হয়। এতে বৃদ্ধলোকদের অনেক উপকার হয়। কেননা তাদেরকে সাহায্য করার মত লোক তারা সহজেই পেয়ে যান।

নবীজির রওযায় উপস্থিত হওয়ার জন্য মদীনা মুনাওয়ারায় গেলাম। তখন মনে হলো আমি পাকিস্তানের কোন মসজিদে এসে গেছি। আসরের কিছুক্ষণপূর্বে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলাম। দেখি পান্জাবী পায়জামা পরিহিত পাকিস্তানী অনেক লোক মসজিদের বাহিরের চত্ত্বরে উপর শুয়ে আছে। মসজিদের ভিতরের পাকিস্তানীরা হয় কুরআন তিলাওয়াত করছে না হয় নফল আদায় করছে। লোকজন দলে দলে আসছে। মুসাফাহা করছে। কুলাকুলি করছে।রিয়াযুল জান্নাতও পাকিস্তানীদের দ্বারা ভরপুর ছিলো। সেখানে পাকিস্তানীরা ছাড়া বাঙ্গালী ও তুর্কি লোক বেশী চোখে পড়ছিলো।

আজকে বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমান বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখিন। এর সবচে বড় কারণ হলো মুসলমানদের অনৈক্য। মুসলিম বিশ্বের জনগণের মধ্যে একাত্মতা ও সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে মুসলিম বিশ্বের সংঘঠন ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এই সংঘঠন এখনও পর্যন্ত মুসলমানদের মাঝে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে পারনি।

এ অবস্থায় মক্কা মুকাররমায় ওআইসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া অনেক গুরত্বপূর্ণ একটা কাজ। এ বৈঠক দ্বারা মুসলমানদের মাঝে যদি ঐক্য ফিরে আসতো তাহলে এটা ওআইসির জন্য অনেক বড় একটা সফলতার বিষয় হতো। কিন্তু বৈঠকের পরিণাম যদি অতিরিক্ত ভুল বুঝার কারণ হয় তবে ‍মুসলিম বিশ্বের নেতাদের স্বরণ রাখা উচিত যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে। এসব নেতাদের জন্য শুধু বিগত দশ পনের বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন মুসলিম নেতার শেষ পরিণতি দেখাই যথেষ্ট। যেসব শাসকরা আজ স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের স্বাধীনতাকে মুসলমানদের অধিকারে ব্যবহার করছেনা তাদের পরিণাম  সাদ্দাম হুসাইন, মা’মার কাযাফী, হুসনে মুবারক এবং পারভেজ মুশাররফদের পরিণাম থেকে ভিন্ন হবে না।

মক্কায় একত্রিত হওয়া মুসলিম শাসকদের স্বরণ রাখা উচিত, এই শহরেই জন্মগ্রহণকারী আল্লাহর শেষ পয়গাম্বর গরীব ও নির্যাতিতদের মুক্তির ব্যবস্থা করতেন। তার জীবন ছিলো সাধাসিদা। বাদশাদের মত জাঁকজমকপূর্ণ জীবন যাপন করতেন না। অনেক সময় ঘরে অনাহারে কাটাতেন। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াতেন। কাপড় তালি দিয়ে পড়তেন। আজ প্রিয় নবীর উম্মতের অনেকেই তো শাসক, কিন্তু তাঁর উম্মতের মান-সম্মান ধূলিস্মাৎ। তাঁর উম্মতের কাপড়ে তালি লাগানোর প্রয়োজন। ওআইসি সম্মেলনে উপস্থিত শাসকবর্গ বায়তুল্লাহর মহাত্বকে ভয় পায়, এবং নিজেদের জন্য কাবার রবের সৌন্দর্য্য চায়। আর এই সৌন্দর্য্য তারাই পাবে যারা আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করবে। এই শাসকবর্গ নিজেদেরকে এমন মুসলমান বানিয়েছে যারা বর্ণ ও গোত্রের ব্যবধান করা ছাড়া শুধু মসজিদে হারামে ও মসজিদে নববীতেই একসাথে নামাজ আদায় করে এবং একে অন্যের জন্য কল্যাণের ভাগাভাগি করে। যখন শাসকবর্গ ও সাধারণ মানুষের মাঝে ভেদাভেদ দূর হয়ে যাবে তখন আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে।

অনুবাদ: মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ

পূর্ববর্তি সংবাদজাতীয় ঈদগাহে প্রবেশে তিন দফা তল্লাশি হবে: ডিএমপি কমিশনার
পরবর্তি সংবাদঈদের ছুটিতে বাড়ী ফিরতে টিকেটের জন্য হাহাকার