মাহে রমযান : পারস্পরিক সহযোগিতা ও ছাড়ের কিছু কথা

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ।।

অনন্য ইবাদতের মাস রমযান। এ মাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য মাসব্যাপি রোযা পালন করা। মাসের প্রতিটি দিন উপোস করে, সংযমের সঙ্গে কাটানো। এর সঙ্গে উতপ্রোতভাবে জড়িত সাহরী ও ইফতার-রোযার সূচনা ও শেষের খাবার-উপলক্ষ, আছে তারাবীহ। ফরয নামায ও জরুরি অন্যান্য আমলের পাশাপাশি নফল ইবাদত, তেলাওয়াত এবং দান-খায়রাতের সম্পর্কও এ মাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এজন্য দ্বীনী প্রয়োজন ও নিয়মসহ স্বভাবজাত ওবাস্তব নানা কারণে এ মাসটিতে মুসলমানদের জীবনে কিছু ব্যতিক্রমী রুটিন, প্রস্ত্ততি, উপলক্ষ ও প্রবণতা ফুটে ওঠে। এর প্রভাব মুসলিম প্রধান এ দেশটিতে অ-মুসলিমদেরও স্পর্শ করে যায়। এজন্য রমযানের রোযা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত আমল হওয়া সত্ত্বেও এ উপলক্ষে পারস্পরিক নির্ভরতা, সহযোগিতা ও একের প্রতি অন্যের বিবেচনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও সামনেচলে আসে। এ বিষয়গুলো আসেবিভিন্ন দিক থেকে। মনোযোগ, বিবেচনা ও সচেতনতা না দিলে এতে বিভিন্ন ধরনের বিপত্তি ও সংকটের সৃষ্টি হতে পারে ও হয়ে থাকে। মাহে রমযানে প্রাসঙ্গিক ও জরুরি এ বিষয়গুলোর প্রতি তাই সচেতন হওয়া আমাদের প্রত্যেকের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমেই চলে আসে মুসলিম রোযাদার পরিবারগুলোর ঘরণী বা নারী সদস্যদের কথা। রমযানে ঘরের প্রয়োজনীয় সম্মিলিত আয়োজনগুলোতে তারাই সবচেয়ে বেশি শ্রম ও সময় দিয়ে থাকেন। সংসারের কঠিন কাজগুলোর পাশাপাশি ইফতার, সাহরী, রাতের খাবারের প্রস্ত্ততিসহ পরিবারের রোযাদার সদস্যদের নানা চাহিদা মেটানোর পেছনে অকাতরে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। আবার তারা রোযাও রাখেন। ফরয, ওয়াজিব, নফল ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার আবশ্যকতা ও আগ্রহ তাদের মাঝেও থাকে। রোযাজনিত অবসাদ ও ক্লান্তিও তারা বোধ করেন। কিন্তু পরিবারের পুরুষ-সদস্যরা অনেক সময়ই পরিবারের নারীদের সামর্থ ও সীমাবদ্ধতার এই দিকটির প্রতি চোখ রাখেন না। চাহিদা অনুযায়ী কিংবা মনমতো কিছু একটার ঘাটতি ঘটে গেলে তারা বিরক্তি বা ক্ষোভ লুকিয়ে রাখতে পারেন না। এটা রমযান ও রোযার সংযমনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল নয়। কখনো কখনো এসব ক্ষেত্রে মানসিক জুলুমের ঘটনাও ঘটে যায়-যেটা রমযান-অ-রমযান কোনো অবস্থাতেই অনুমোদিত নয়।

এজন্য এ বিষয়টির প্রতি পূর্ণ সতর্কতা ও সর্বোচ্চ বিবেচনা বজায় রাখা রোযাদার পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিলে সমস্যার মাত্রা কমে যাবে বলে আশা করা যেতে পারে।

এক. রমযানে নারীদের ঘরোয়া আয়োজনগত সেবার মূল্যায়ন করা। কারো পক্ষ থেকে উপকৃত হলে মানুষ যেমন তাকে কথায়-আচরণে খুশি করার চেষ্টা করে, রমযানে ঘরের নারীদের প্রতি তেমন সৌজন্য ও সদাচার প্রকাশ করা উচিত।

দুই. সাহরী-ইফতার ও অন্য যে কোনো আয়োজন এবং সেবায় কখনো কখনো মন ও রুচিমাফিক কিছু না পেলে সয়ে যাওয়া ও ধৈর্য্য ধরা। এ কারণে ঘরণীর প্রতি কোনো রকম তিক্ত আচরণ করা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকা উচিত।

তিন. নিজে রোযাদার হয়েও ঘরণী যে শ্রম ও সময় দিচ্ছেন, সেক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করার ব্যবস্থা নেওয়া। এটা প্রত্যক্ষভাবে নিজে হাত লাগিয়েও করা যায়। আবার সহযোগী কাজের মানুষের ব্যবস্থা করেও তার কষ্ট কমানোর উদ্যোগ নেওয়া যায়। সময়, পরিস্থিতি ও সুবিধা অনুযায়ী সহযোগিতার ধরণটা ঠিক করে নেওয়া যেতে পারে।

চার. রমযানে শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া নফল-মুস্তাহাব পর্যায়ের সেবার জন্য নারীদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে না দেওয়া। যেমন পরিবারের কর্তার মনে হল, আজ কয়েকজনকে দাওয়াত করে ইফতারের বিশেষ মেহমানদারি করবেন। এজন্য তিনি ঘরণীর সুবিধা-অসুবিধা, ক্লান্তি ও আয়োজনের শ্রম-কোনোদিকেই খেয়াল করলেন না। তার সঙ্গে আলোচনা করে আগেই তাকে মানসিকভাবে তৈরি করা সম্ভব হল না। তাকে শুধু জানিয়ে দিলেন, এতজন মেহমান আসছেন, এই এই আয়োজন করতে হবে। মেহমানদারির এ পদ্ধতি ঠিক নয়।

রমযানে ইফতার করানো অনেক ছওয়াবের কাজ। এটা স্বতন্ত্র বিষয়। ঘরণীর ওপর চাপিয়ে না দিয়ে আগ্রহ ও উৎসাহের সঙ্গে সেটা করতে উদ্বুদ্ধ করা এটিও স্বতন্ত্র বিষয়। দুটির মাঝে সমন্বয় করেই এ ধরনের পুন্যের উপলক্ষগুলো সমাধা করতে হবে। কিংবা অন্য উপায়ও তো খোলা আছে। বাইরে থেকে ইফতার কিনে এনেও এটা করা যায়। আবার ঘটনা যদি এমন হয় যে, দাওয়াত কিংবা বিশেষ মেহমানদারির কোনো ব্যাপার নেই, মেহমান নিজেই বাসায় চলে এসেছেন, সেক্ষেত্রে পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যেইে সেটি পড়ে যায়। তখন আয়োজন নিয়ে অস্থিরতারও কিছু নেই। যা আছে এবং যতটুকু করা গেল, তাতেই ইফতার করানোর হক আদায় হয়ে যায়। ঘরণীর প্রতি, পরিবারের নারী সদস্যদের প্রতি সদাচার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের দাবি। রমযানুল মুবারকে এ দাবির জোর ও প্রাসঙ্গিকতা অনেক বেশি। সেজন্য রমযানে এ বিষয়টির প্রতি সবার বিশেষ মনোযোগ থাকা দরকার।

রমযানুল মুবারক ও রোযার প্রতি সম্মানের ছওয়াব এবং অধীনস্থদের প্রতি সদয় ও সদাচারী হওয়ার ছওয়াব হাসিলের সৌভাগ্য এভাবে হাসিল হতে পারে। একইভাবে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রমযানে রোযাদার কর্মচারীদের ওপর কাজের চাপ কমানোর ব্যবস্থা করা যায়। একজন সুস্থ-সবল ও প্রাণচঞ্চল কর্মীর কাছে যতটুকু সময়ে যতটুকু কাজ নেওয়া হয়ে থাকে, রমযানে রোযাদারের জন্য সেক্ষেত্রে রোযাজনিত ক্লান্তিবোধের প্রতি কিছুটা হলেও সদয় হওয়া অত্যন্ত ছওয়াবের কাজ হবে। মানবিক ও ভ্রাতৃত্বমূলক আচরণ হিসেবেও সেটা গণ্য হবে। এটা অন্যভাবেও করা যায়। কাজের সময়-পরিমাণটাই কমিয়ে দিয়ে তাতে পূর্ণ উদ্যমে কাজ করানোর ব্যবস্থা করা যায়। এতে রোযাদারের প্রতি সদয় আচরণের সুফল ও বরকত প্রতিষ্ঠানটি অন্যভাবে লাভ করতে পারবে বলেই আশা করা যায়-ইনশাআল্লাহ।

মাহে রমযানের রোযা ও অন্যান্য ইবাদত-আমলের মধ্য দিয়ে একটি সামগ্রিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। এজন্য রমযান ও রোযার বিষয়টিকে যার যার ব্যক্তিগত ধর্মপালনের পর্যায়ে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এর জন্য ব্যক্তির পর সমাজ, সমাজের পর রাষ্ট্রের পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতাকে সবারই গুরুত্বের চোখে দেখা দেখা উচিত। এটি কেবল এদেশীয় প্রেক্ষাপটের বিষয় নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের সবকটি দেশেই এ মাসের চিত্রে একটি উজ্জ্বল ভিন্নতা ফুটে ওঠে। অমুসলিম-প্রধান দেশগুলোতেও মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে রমযানের পবিত্রতা ও জরুরি আনুষ্ঠানিকতা রক্ষায় জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। তাহলে আমরা কেন সচেতন হব না? নিজেদের পরিমন্ডলে সহযোগিতা, সদয়তা ও ছাড়ের মধ্য দিয়ে সুন্দর ও কামিয়াব রমযান কাটানোর চেষ্টা আমাদের করা উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের কবুল করুন।

পূর্ববর্তি সংবাদঅবশেষে পানি দূষিত হওয়ার কথা স্বীকার করে ওয়াসার প্রতিবেদন
পরবর্তি সংবাদরাজধানী আগারগাঁওয়ে টিভি বিস্ফোরণে স্বামী-স্ত্রী দগ্ধ