সাকিব মুস্তানসির ।।
পহেলা বৈশাখ গত হয়ে গেছে প্রায় দুই সপ্তাহ এখনো অস্বাভাবিক ও অনান্দনিক পাড়ায় এর রেশ পূর্নপমাত্রায় রয়েগেছে। রয়ে গেছে তীব্র দুঃখ ও বেদনাবোধ। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার লজ্জা। বাঙ্গালির সাংস্কৃতি বলে গণমানুষের স্বাভাবিকত্বের উপর যে অস্বাভাবিক পেঁচা, ময়ূর, হাতী, ঘোড়া, সাপ, বিচ্ছু, হরিণ শাবক, হাঁস, পান্তা-ইলিশ ও রমনার বটমূল চাপিয়ে দিয়েছিল একদল কুপমুন্ডুক শিক্ষিত মূর্খমানুষ তা বাঙ্গালী মুসলমানরা স্বাভাবিক ও নান্দনিক নিয়মেই প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রথম প্রথম তাঁদের ভুজং-ভাজং আর চাকচিক্যের ফাঁদে পরে কিছুদিন তালে তাল মিলালেও শুভঙ্করের ফাঁকি ধরতে সময় লাগেনি। সাজসাজ ডাক পাড়া অবাঙ্গালিয়ানা মোহ থেকে বেরিয়ে এসেছে সতঃস্ফুর্তভাবে। সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির যে পৈশাচিক নৃত্য বাংলাদেশের স্বাভাবিকত্ব ও নান্দনিকতাকে খামচে ধরেছিল তা থেকে মুক্ত হতে আত্মসম্ভ্রমে ভরপুর সচেতন বাঙ্গালিরা খুব বেশি সময় নেয় নি। এটাই বাংলাদেশিদের স্বাভাবিক চরিত্রের সুষমা, আভিজাত্যের অনুপম উপমা ও অনন্য বৈশিষ্ট্যময় চরিত্রের দৃঢ়তা। স্বাধীনচেতা বাঙ্গালিদের পায়ে শিকল পরাতে পারেনি বৃটিশ বেনিয়ারা। পাকিস্তানী শোষণ বেঁধে রাখতে পারেনি, মাথা নোয়াতে পারেনি ভারতীয় অপসংস্কৃতি বা স্বদেশে গজিয়ে উঠা বিদেশি পদলেহী কোনো সংগঠনের চাপিয়ে দেয়া অপসংস্কৃতি ও অনান্দনিক কার্জকলাপ। এ দেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায় না।
সকল অন্ধকার, অপসংস্কৃতি, কুপমুন্ডকতা, অ-নান্দনিকতাকে তেড়েফুঁড়ে পায়ে দলে উল্কার মতো স্বকীয়তা নিয়ে উত্থিত হয়। আলোর রোশনিতে মাতোয়ারা করে পৃথিবীকে।শিক্ষার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে যে বা যারা মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো অবৈজ্ঞানিক, অ-নান্দনিক, অস্বাভাবিক যাত্রাকে পালনীয় মেনে নেয় তাদের আপনি সাংস্কৃতিক নান্দনিকতার কী জ্ঞান দিবেন ? শিক্ষার আলো যাদের মন ও দৃষ্টিকে আলোকিত করতে পারেনি তাদের বোধ আলোকিত হবে এটা যেন ছাই থেকে হীরে খুঁজে পাওয়ার মতই অবাস্তব কল্পনা। শিক্ষিতমুর্খ মানুষগুলো যখন নির্লজ্ব মিথ্যাচার ও ইতিহাসের বিকৃতিতে মগজ বিকিয়ে দেয় তাদের থেকে আলোর দিশা খুঁজে জাতিকে নান্দনিকতা উপহার দিতে যাওয়া জাতির স্বকিয়কতাকে মিটিয়ে দেয়ার নামান্তর অথচ আজ সভ্যতার মাথায় চেপে বসে আছে এরাই ! এরাই জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। দিকনির্দেশনা দেয় আর পথ দেখায় তবে স্বস্তি ও আনন্দের বিষয় হচ্ছে, অভিজাত বাঙ্গালীরা আলাপে-আচরণে প্রত্যাখ্যান করেছে এদের।
বুঝে গেছে, মহিমান্বিত হিজরতের পথ ধরে আসা হাজার বছরের বাঙ্গালিয়ানা সংস্কৃতির পহেলা বৈশাখে জমিদারী করমুক্তি দিবসের আনন্দ, পুরো বছরের হিসাব নিকাশ, হালখাতা, নতুন ফসল উঠার আনন্দে শরীক হতে বাড়িতে বাড়িতে মেহমানদের আনাগোনা , শহর-গ্রামে নিত্বপ্রয়োজনিয় সামানার বাজার এক জিনিস। আর মেলা বসিয়ে বর্তমানের পান্তা-ইলিশ, রমনার বটমূলে গান-বাজনার মাধ্যমে অগ্নিস্নানে সূচি হওয়া, সনাতন ধর্মের বিভিন্ন দেব দেবীর বাহনের সাজে সজ্জিত হয়ে এক কিম্ভুতকিমাকার মঙ্গলশোভাযাত্রা, পূজার চড়কার উত্থাপন আর দিনব্যাপী অশ্লীলতার পসরা মেলে ধরে নারীদের শ্লীলতাহানি করার পহেলা বৈশাখ উদযাপনে আরেক জিনিস। আগেরটা স্বাভাবিক, সুন্দর, নান্দনিক ও পরেরটা অসুন্দর, অস্বাভাবিক ও অনান্দনিক, মতলববাজদের চাপিয়ে দেয়া। হাজার বছরের বাঙ্গালির ইতিহাসে এর কোন উল্লেখ বা প্রমাণ নেই। অংশগ্রহণকারী থেকে বেশি নিরাপত্তারক্ষীর বেষ্টনীতে যে অনুষ্ঠান উদযাপন করতে হয় তা আর যাই হোক প্রাণের হতে পারে না।
শত বছর কাল গত হয়েছে মাত্র এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছোট্ট একটা বিভাগ থেকে দশ বিশ বছর আগে জন্ম নেয়া এক অনুষ্ঠানকে আজ হাজার বছরের বাঙ্গালির সাংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে একদল অসৎ ও মতলববাজ শিক্ষাব্যবসায়ী । এদের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট। হাজার বছরের বাংলাদেশি মুসলমানদের ইসলামি কৃষ্টি-কালচার, জীবনযাপন, অনুষ্ঠান উদযাপন, লেনদেন, নিজস্বতা ও স্বকিয়তা সব কিছুকে আস্তে আস্তে ধ্বংস করে দিয়ে একটা নির্জীব আত্মসম্ভ্রমহীন জাতিতে পরিণত করা। বাংলাদেশের মুসলমানদের মাঝে হিন্দু সংস্কৃতি সহজলভ্য ও স্বাভাবিক করে দেয়ার স্লো পয়জোনিং -এর শুরু আজ থেকে নয়, বরং প্রায় দেড় হাজার বছর আগে থেকেই চলছে। ইসলামের আগমন আরবে হলেও সারা বিশ্বব্যাপী এর গ্রহণযোগ্যতা ও স্বীকৃতি ছিল অবশ্যম্ভাবী। কারণ ইসলাম পুরো মানব জাতির জন্য।
বাংলাদেশের মানুষ ছিল ইসলামের অনেক নিকটতম। মনে ও মগজে। চিন্তায় ও চেতনায়। যেকারণে বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার প্রসার স্থায়িত্ব কখনই বড় কোন পরীক্ষার সম্মুখীন হয় নি। এটা একটা অবাক করা বিষয়! আরব থেকে ১৫০০ কি মি দূরত্বের একটা রাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি মসজিদ থাকবে! সবচেয়ে বেশি রুকু হবে, সবচেয়ে বেশি সিজদা হবে! সবচেয়ে বেশি জিকির হবে! সবচেয়ে বেশি আলেম হবে ! সবচেয়ে বেশি মাদ্রাসা হবে !অভাবনীয়!! এটা হয়েছে, কারণ বাংলাদেশের মানুষ ইসলামের আগেও ইসলামী ভাবাপন্ন ছিল। ইসলামের দাওয়াত পৌঁছা মাত্রই সাদরে গ্রহণ করেছে। ইসলামের সাথে এ সম্পর্ক নিছক ভালোবাসার। বানিজ্য পথে সাহাবাদের নৌযান বাংলাদেশের মাটিতে নোঙ্গর ফেলত সুপেয় মিঠাপানি আর খাদ্যদ্রব্যের জন্য। বাংলাদেশীদের সহজাত হৃদ্যতা, মেহমানদারীতা বুকে টেনে নিয়েছিল আরব কাফেলাকে। ভাষার পার্থক্য হৃদয়ের হৃদ্যতার সামনে বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারেনি। পারেনি বলেই আজ চতুর্দিক হিন্দু বেষ্টনী থেকেও বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম।
বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা ভারতীয় উপমহাদেশীয় বদ্বীপ বাংলাদেশের মানুষের স্বভাবজাত নম্রতা ও সহজতার জন্যই এখানে ইসলামের বয়স প্রায় হিজরতের সমান! ফিতরাত ( স্বভাবজাত) থেকে যে ধর্মের পথচলা তাকে আপন করে নিতে সময় নেয়নি বাংলার মানুষ। প্রথম সুযোগেই আগলে নিয়েছে বুকে। আঁকড়ে ধরেছে পরম মমতায় আপনজনের মতো। তৃষিত হৃদয় তৃপ্ত হয়েছে ইসলামের আলোকচ্ছটায়। এ যেন নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনের মতো ছিল। বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছরের কৃষ্টি কালচার মুসলমানদের কৃষ্টি কালচার। এই সংস্কৃতির জন্মই হয়েছে ইসলাম ও মুসলমানদের হাত ধরে। হাজার বছরে লক্ষ ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে তবুও টলানো যায়নি এক বিন্দু।
যখনই পরদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন উদ্যত হয়েছে, সাপের মতো ফেনা তুলেছে তখনই জেগে উঠেছে মানুষ, মানুষের ফিতরাত। নির্দ্বিধায় ছুড়ে ফেলেছে সব অপসাংস্কৃতি। বর্জন করেছে। প্রত্যাখ্যান করেছে নির্মমভাবে।বাঙ্গালীর হাজার বছরের ঐতিহ্যের কথা বলতে চাইলে আল্লাহ, রাসুল, আজান ,নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ইমাম, মুয়াজ্জিন, সালাম, মুসাফাহা, মুয়ানাকা, কুরবানি, মহররম, শবে বরাত, শবে কদর, দস্তরখান, ঈদগাহ, টুপি, আতর, রোমাল, জায়নামাজ, তাসবিহ, আলহামদুলিল্লাহ্, সুবাহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, মক্তব, মাদরাসা, দরগাহ, খানকাহ, পীর , মুরিদ, উস্তায, দাওয়াত, মাহফিল, ওয়াজ, নসিহত, পর্দা,শালীনতা, মান্যতা, ইত্যাদির কথাই আগে বলতে হবে। কেননা হাজার বছর আগে থেকেই বাঙ্গালীর সাথে উতপ্রেত ভাবে মিশে আছে ইসলাম। এগুলোই বাংগালির বিশুদ্ধ কৃষ্টি ও কালচার। এর বাইরে বাঙ্গালীর বিশেষ করে বাংলাদেশীদের, তার চেয়েও বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের আলাদা কোনো ঐতিহ্য থাকতে পারে না। এর বাইরে যা কিছুই বাঙ্গালীর সংস্কৃতি বলা হবে তা বাইরে থেকে ধার করা। ইসলামের সাথে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্কটা আত্মিক। এটাকে দমিয়ে রাখা যায় মাত্র, মিটিয়ে দেয়া যায় না।
তরুণরা এখন আর অসচেতন নয়। তারা জাগছে স্বকীয়তায়। নিজের পরিচয়ে, আত্মবিশ্বাসে, আভিজাত্যে। শিক্ষায় বলিয়ান হচ্ছে। মতলববাজদের চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতি তারা মানবে না। ছুঁড়ে ফেলবে বুড়িগঙ্গার পানিতে ইনশাআল্লাহ্।
সাকিব মুস্তানসির : আলেম, প্রকৌশলী