সিসির দেশে মানবাধিকার: তাহের তার বাবাকে চিনে ফটো দেখে

এনাম হাসান।।

‘খালেদ যখন গ্রেফতার হন তখন আমি সন্তানসম্ভবা। প্রসবের ১০ দিনের মাথায় দুধের শিশুটিকে নিয়ে যাই তার বাবাকে দেখাতে।কিন্তু কারারক্ষীরা তার বাবাকে সন্তান স্পর্শ করতেও দেয়নি। তাহের এখন তার বাবাকে চিনে ফটোগ্রাফ থেকে। আর ৮ বছর বয়সী আসমা তার বাবার সম্পর্কে কেঁদে কেঁদে জিজ্ঞাসা করে, তার বাবা কোথায়? আমি পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি, কিন্তু তাকে বোঝানো তো এত সহজ নয়’, আফসোস করে বলেন ফাতেমা।

কারাগারে স্বামীর সাথে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করছিলেন ফাতেমা।

খালেদ হামিদী ২৭ মার্চ ২০১৪ নিজ বাড়ি থেকে  গ্রেফতার হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে কাতারের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়েছিল। মূলত তিনি মিশরের একটি  টিভি চ্যানেল ‘ইজিপ্ট25’-এ কাজ করতেন, যা ২০১১ সনের আরব বসন্তের লাইভ সম্প্রচার করেছিল।

গ্রেফতারের পর  তাকে কায়রোর ‘তোরা’ বন্দীশালায় নিক্ষেপ করা হয়। তোরা কারাগারের আরবী নাম আল ‘আকরাব যার অর্থ বিচ্ছু। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরও তাকে ১৫ দিনের মেয়াদে কারা ভোগের শাস্তি দেওয়া হয়। কারণ তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন সদস্য, যে দলটিকে ২০১৩ সনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর নিষিদ্ধ করা হয়।

খালেদের স্ত্রী ফাতেমা জোহরা জানিয়েছেন, ২০১৭ সাল থেকে তারা কারাগারে আজ পর্যন্ত আমাকে আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে দেয়নি। তিনি বলেন,  ২০১৮ মার্চ থেকে ‘তোরা’ কারাগারের সকল বন্দীদের জন্যেই আত্মীয়দের সাথে দেখা সাক্ষাৎ  নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়।

এরপরও কদাচিৎ সাক্ষাতের যে সুযোগগুলো দেওয়া হয় তাও ফাতেমার জন্যে একটি পরীক্ষা। কারণ এর জন্যে তাকে কারারক্ষীদের হাতে হেনস্থার শিকার হতে হয়।

‘কারাগারে প্রবেশের জন্যে যে তল্লাশী করা হয়, তাকে যৌন হেনস্থাই বলা চলে,’ বলেন ফাতেমা।

‘এই তল্লাশী পার হয়ে যাওয়ার পরও আমি সব সময় তার সাথে দেখা করতে পারি না। কারণ যখন তার সাথে দেখা করতে যাই তখন কর্তৃপক্ষের কাছে ৫০টিরও বেশী কারণ থাকে আমাকে দেখা করতে না দেওয়ার জন্যে।’

আর যদি বা স্বামীর সাথে দেখা সম্ভব হয়, তখন তাদের সাক্ষাৎ হয় খুবই সংক্ষিপ্ত। তাদের সাক্ষাত বড়জোড় ৩ থেকে ১৫ মিনিটের মাথায় শেষ করতে হয়। তাছাড়া সাক্ষাতের সময় তাদের মাঝখানে একটি কাঁচের দেয়াল থাকে এবং তাদেরকে ফোনের মাধ্যমে কথা বলতে হয়।

‘এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দেখা করতে না দেয়া এটা হামিদী এবং অন্যান্য কারাবন্দীদেরকে শাস্তি দেওয়ার একটি কৌশলমাত্র,’ ফাতেমা বলেন।

একবার খালেদকে কারাগার থেকে স্থানান্তর করা হয়েছিল কারাগারের ‘ডিসিপ্লিন রুমে’। ফাতেমা বলেন, ‘তখন ছিল শীতকাল। যখন সেই কামরায় পাঠানো হল, তিনি আমাকে বলেছেন যে, তারা তাকে বিবস্ত্র করে। তারপর কারারক্ষীরা তার উপরে ঠান্ডা পানি নিক্ষেপ করে। তখন তিনি ২১ দিন না খেয়ে স্ট্রাইক করেছেন। শেষে বাধ্য হয়ে তাকে আবার আগের সেলে ফেরত আনা হয়।’

খালেদের মত বন্দীদের জন্যে এজাতীয় ঘটনা ‘তোরা’ কারাগারে নতুন নয়। বৃটেনের সংসদীয় ডিটেনশন রিভিউ প্যানেল (ডি আর পি) বলেছে, ‘তোরা’ কারাগার খুব নিকৃষ্ট একটি কারাগার। এটি বন্দীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে মিসরের আইন কিংবা আন্তর্জাতিক আইন  কোনোটাই অনুসরণ করে না। তারা মানবাধিকার সংস্থার একটি রিপোর্ট উদ্ধৃত করেন, যাতে বলা হয়েছে, ‘তোরা’ কারাগারটি এমনভাবে বানানো হয়েছে যে, এখানে যারা প্রবেশ করবে তারা লাশ হওয়ার আগে আর বের হতে পারবে না।

২০১৩ এর পর থেকে মিশরে মানবাধিকার অবনতির দিকেই যাচ্ছে। ফাতেমা বলেন,  প্রকৃতপক্ষে মিসরে মানবাধিকার বলতে কিছুই নেই।

যদিও আইনজীবীরা এবং মানবাধিকার কর্মীরা তাকে এবং তার স্বামীকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন কিন্তু পরিস্থিতি খুব কমই পরিবর্তন হয়েছে,’ তিনি বলেন।

তার স্বামীর কেইস নিয়ে বিভিন্ন আইনজীবীরা লড়াই করছেন এবং তারা দেখা করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন কিন্তু যেহেতু সিদ্ধান্ত এসেছে কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে সুতরাং আইনজীবীদের চেষ্টা ব্যর্থ,’ বলেন ফাতেমা। ‘আমি অনেক মানবাধিকার সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করেছি এবং বিভিন্ন অভিযোগ নির্বাহী অফিসার, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং কারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি কিন্তু সবই নিষ্ফল,’ যোগ করেন ফাতেমা।

সূত্র: মিডল ইস্ট মনিটর

পূর্ববর্তি সংবাদইয়াবা ব্যবসায়ীকে ধরতে গেলে পুলিশের সাথে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ
পরবর্তি সংবাদআজ শবে বরাত, রমযানের প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করুন