মুসলিম বাহিনীর কাশগর বিজয় ও একজন বীরের করুণ মৃত্যু

আবরার আবদুল্লাহ ।।

কাশগর পূর্ব তুর্কিস্তানের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রাচীনকাল থেকে একটি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ। কাশগরের একদিকে দিকে রাশিয়া, দুইদিকে চীন এবং একদিকে মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহ। উন্নত কাপড় উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে এই শহরটি। প্রাচীনকালে এটি মাওরাউন নাহার ও ছগদ অঞ্চলের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো।

https://i.redd.it/2et8pxnwxns11.png

পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীনকাল থেকে অত্র অঞ্চলের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। কাশগর ছিলো ঐতিহাসিক সিল্করোডের সংযোগস্থলে। যা চীনকে প্রাচীন রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করেছিলো।

ইসলামের আগমন
উমাইয়া শাসক আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের যুগে ৮৩ হিজরিতে (৭০৫ খ্রি.) কাশগড়ে ইসলামের আগমন হয়। কিন্তু কাশগড়ে ইসলামি শাসনের গোড়াপত্তন হয় ৩৫৩ হিজরি (৯৬৪ খ্রি.) সনে। যখন সুলতান সাতুক বুগরা খান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সে ইসলাম গ্রহণের পর পুরো দেশে দ্রুত ইসলামের প্রসার ঘটে। সেই থেকে কাশগরবাসী এখনও ইসলামের উপর অটল রয়েছেন।

১৯৪৯ সালে চীন পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করার পর তার দিয়েছে জিংজিয়াং। তবে মুসলিমরা তাদের এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ব্যবহার করতেই ভালোবাসে। কাশগরে বহুজ্ঞানী-গুণী মুসলিম মনীষার জন্ম হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন, আবুল মাআলি মুহাম্মদ ইবনে হাসান কাশগরি রহ. (জন্ম ৪৯০হিজরি), আবু আবদুল্লাহ হুসাইন ইবনুল আলি(মৃত্যু ৪৮৪ হি.) প্রমুখ।

https://lh3.googleusercontent.com/U90sqqcGiT9wNE64ABToEaXlg3kXl_mRah0or9TKcWd5PFTw1zvpK5G_N55cMzDogdEIzed8ZMpJDi2dApQXGxCgPybwOc8T_mZvqHXtFYDrl9Ko72kTmWV_yIQ2GaJuYwIHg5BsjLQ_DyJRax2v7KVKIukZp-LRQtwzmLYWdvJeEWvG1BqEUogrJDE_lq2loD5zGPxFDMPscN3ItVUp1WBF7eMBbROzjUoTTFAbJS5gvBdQPtDw7CycfTFHdnktm4SGucfsh8KPrBCmZNLG2zLSa1qGyKewWVX3I0SAkBIoVTbox18qbcDqVKDmdWC2pmicZFOkRHUUmwcbz53C0jHsByBuiwyZ8oWs46SofkFsIXkvVGk2ZUz1POyX-_60_cHN-4DB8WivBjo3M66wkRm73EfIEdViOTaQfeM-3JnJgPHvJIPxiXc7WsunSFhM_I2XgSTVW3yym-gJcB0LOY0GVXsAQCOEgrWVYIMrg-YlJUSYSUOlhtKNjGtfBY2DDe91X5QbhshRM086WE_zBhmmX3burAitBFyNiCnmwKzou4cBGkcEhJGwnu6q2mR6-BqYCajTev6LT4H62dMSIYZCrVf9UEWaAMi4_ClF_Sml5nwS8U9UxuZS12Pf69iWXWwLBPeBdwgWFZrm9HMsRLzlaA=w1200

জয়যাত্রা শুরু
৯৩ হিজরিতে মুসলিম সেনাপতি কুতাইবা ইবনে মুসলিম ফারগানা জয় করার উদ্দেশ্যে জায়হুন নদী অতিক্রম করেন। তখন ফারগানা ছিলো মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় অঞ্চল। সবুজ-শ্যামল অসংখ্য সমৃদ্ধ গ্রাম ছিলো এই ফারগানাতে।

কুতাইবার সঙ্গে ফারগানার সেনা বাহিনীর সংঘাত হয় খাজান্দাহ নামক স্থানে। উভয় বাহিনীর মাঝে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে তাদেরকে সঙ্গ দেয় কাশগরের সেনাবাহিনী। সম্মিলিত বাহিনীর বারবার মুখোমুখি হতে হয় কুতাইবাকে। তবে প্রতিটি যুদ্ধে মুসলিমরা একটু একটু করে অগ্রসর হচ্ছিলো। অবশেষে ফারগানাবাসী ও তাদের মিত্ররা পরাজিত হয় এবং মুসলিম সেনাপতি কুতাইবা বিন মুসলিম ফারগানার অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেন।

দৃষ্টি এবার কাশগরে
ফারগানা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা ছিলো মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমরা চাচ্ছিলো সীমান্তবর্তী কাশগর দখল করতে। ৯৬ হিজরিতে কুতাইবা ইবনে মুসলিম কাশগরে অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি খোরাসানের রাজধানী মিরো থেকে রওনা হন এবং সেনা সদস্যদের স্ত্রী-পরিবারকে সমরকান্দে রেখে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

মুসলিম সেনারা জায়হুন নদী পার হন। নদী পার হয়েই তিনি নদীপথে চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণারোপ করেন। যেনো কেউ তাদের অনুমতি ছাড়া নদী পারাপারের সুযোগ না পায়। মুসলিম বাহিনী সমরকান্দে তাদের পরিবার-পরিজন রেখে ফারগানাতে পৌঁছান। এখানেই অভিযানের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। কাশগরের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন।

যুদ্ধের প্রস্তুতি
আধুনিক যুগের সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগের মতো কুতাইবার সেনাবাহিনীরও প্রকৌশল বিভাগ ছিলো। যারা সেনা বাহিনীর অভিযানের পথ সুগম করতে কাজ করতো। তিনি সর্বপ্রথম ইসাম পর্বতের প্রতি মনোযোগ দেন। প্রকৌশলিদের এই পথ অতিক্রমের উপায় বের করতে বলেন। ইসাম পর্বত ফারগানা ও প্রাচীন চীনের মধ্যে প্রাচীর হিসেবে কাজ করতো। কোনো বাহিনীর অতিক্রমের জন্য এটাই ছিলো প্রধান বাধা। এই ক্ষেত্রে কাশগর ও চীনে যেসব ব্যবসায়ীরা যাতায়াত করতেন তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন।

মূল অভিযান পরিচালনার পূর্বে কুতাইবা একটি অগ্রগামী দল প্রেরণ করেন এবং তারা সীমান্তে পৌঁছানোর পর তিনি তাদের সঙ্গে যোগ দেন এবং চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেন। তবে পথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। অগ্রগামী দলই সেগুলোতে বিজয় লাভ করেন।

https://www.mircorp.com/wp-content/uploads/2018/03/Kashgar-Old-Old-Town-3.jpg

যুদ্ধ ও বিজয়
চীনা বাহিনী ও মুসলিম বাহিনীর মাঝে সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে চীনা রাজা কুতাইবাকে আলোচনার প্রস্তাব দেন। কিন্তু কুতাইবা তা এড়িয়ে যান। তিনি চীনের পশ্চিম সীমান্তে পৌঁছানোর পর চীনা রাজা তার কাছে আবারও প্রস্তাব পাঠান। তিনি লেখেন, ‘আমার নিকট একজন অভিজাত ও সম্মানিত ব্যক্তিকে প্রেরণ করুন যার কাছ থেকে আমি আপনাদের সম্পর্কে এবং আপনাদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারবো।’

এবার কুতাইবা বিন মুসলিম চীনের সঙ্গে আলোচনায় রাজি হন। তিনি তার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে যোগ্য ১২জনকে আলোচনার জন্য চীনের রাজ দরবারে পাঠান।

তিনি তাদেরকে বলে দেন, ‘তোমরা চীনের রাজ দরবারে প্রবেশ করেই তাদের জানিয়ে দেবে, নিশ্চয় আমি শপথ করেছি যে, আমি তাদের রাজ্য বিজয় না করে, তাদের রাজত্ব শেষ না করে এবং তাদের ভূমি-রাজস্ব না নিয়ে ঘরে ফিরবো না।’

আরও পড়ুন : পূর্ব তুর্কিস্তান : উইঘুর মুসলমানের হারানো মানচিত্র

মুসলিম প্রতিনিধি দল চীন পৌঁছানোর পর চীনের রাজ দরবারে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হলো। মুসলিমরা সাদা পোশাকের উপর উর্দি পরে রাজ দরবারে যান। তখন রাজদরবারে সভাসদ ও দেশের গণমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। মুসলিম প্রতিনিধি দল তাদের নির্ধারিত আসন গ্রহণ করেন কিন্তু তাদের সঙ্গে কেউ কথা বললো না। না রাজা, না অন্য কেউ। মুসলিমরা দরবার থেকে বের হয়ে আসার পর রাজা উপস্থিত ব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করলেন, তাদেরকে কেমন দেখলে? তারা উত্তর দেয়, আমরা যাদেরকে দেখেছি তারা মানুষ নয়।

চীনের রাজা যখন সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রভাবিত হতে দেখলেন তিনি মুসলিমদের দখলকৃত অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার শর্তে সমঝোতায় সম্মত হলেন।

https://amp.businessinsider.com/images/5afd24601ae6621c008b464d-750-375.jpg

আহ! কুতাইবা বিন মুসলিম!!
অন্যদিকে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালেক মারা যান। নতুন খলিফা হিসেবে সোলায়মান ইবনে আবদুল মালেক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ওয়ালিদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে সোলায়মান কুতাইবা ইবনে মুসলিমকে রাজধানীতে ফেরার নির্দেশ দেন। কিন্তু রাজধানীতে পৌঁছার পূর্বেই ফারগানাতে তাকে ও বাহিনীর উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের শহিদ করে দেওয়া হয়। কুতাইবা বিন মুসলিমের মৃত্যুর পর কাশগর মুসলিমদের হাতছাড়া হয়ে যায়।

পূর্ববর্তি সংবাদহাটহাজারীতে নবীন আলেম ও সেবক সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত
পরবর্তি সংবাদধর্ষণ ও হত্যামামলায় বিরলে যুবলীগ নেতা আটক