পহেলা বৈশাখের নানা অনুষ্ঠান : বর্ষীয়ান আলেমরা যা বলেন

আগামী ১৪ এপ্রিল বাঙলা নববর্ষের প্রথম দিন -পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আয়োজনের মাত্রা বাড়ছে দিনদিন। বলা হচ্ছে, এটাই আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতি। যদিও দুই দশক আগেও পহেলা বৈশাখের এমন চর্চা দেখা যায়নি বাংলাদেশের বাঙালি সমাজে। বাংলাদেশে যখন বিপুল সমারোহে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়, তখন ভারতীয় বাঙালি সমাজে পহেলা বৈশাখ থাকে এক রকম উপেক্ষিত। তাই পহেলা বৈশাখ কতোটা বাঙালির তা নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেকের।

আলেমরা অবশ্য বিষয়টি বিবেচনা করেন অন্যভাবে। তারা বলেন, পহেলা বৈশাখের বর্ণিল আয়োজনের গা-জুড়ে রয়েছে অনেকগুলো শিরকি-প্রলেপ। যার কিছু নেওয়া হয়েছে পৌত্তলিক হিন্দু ধর্মবিশ্বাস থেকে। আর কিছুর উদ্ভব হয়েছে উদ্ভট কিছু চিন্তা থেকে। তাই তারা মনে করেন, একজন মুসলমানের পহেলা বৈশাখের আয়োজনে শামিল হওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই। বরং ঈমান-ইসলাম রক্ষা ও পরিপালনে তাদের বিমুখ থাকা উচিত এসব আয়োজন থেকে।

এ বিষয়ে দেশের শীর্ষ দুই আলেম -বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা আশরাফ আলী ও সহ-সভাপতি আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ, কথা বলেছেন ইসলাম টাইমসের সঙ্গে। আলোচনায় তারা পহেলা বৈশাখের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া কিছু অনুষ্ঠান সম্পর্কে জাতিকে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন। দেশের অন্যতম দুই মুরব্বি আলেমের কথা ধারণ ও অনুলিখন করেছেন আবরার আবদুল্লাহ

সরকারকে বলবো, জনগণের ঈমান-আকিদা নষ্ট হয় এমন কাজ করবেন না : আল্লামা আশরাফ আলী
এখন পহেলা বৈশাখের নামে মুখোশ, ঢোল, তবলা, ভাস্কর্য বহনের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে -তা ইসলামে নেই। এই ক্ষেত্রে সরকার যে অর্থ ব্যয় করছে তা অপচয় ও অপব্যয় হিসেবে গণ্য হবে বলেই আমি মনে করি। জনগণের অর্থ এভাবে ব্যয় করার অনুমতি ইসলাম সরকারকে দেয়নি।

আমি যতোদূর জানি পহেলা বৈশাখে এমন অনেক কাজ হয়, যা মানুষকে শিরকের প্রতি ঝুঁকিয়ে দিতে পারে। মুসলমানদের এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। মুসলমানের স্রোতে গা ভাসানো উচিত না। সে ঈমান-ইসলাম সামনে রেখে কাজ করবে। যে কাজের কোনো লাভ নেই, যে কাজ মানুষকে পাপের প্রতি উৎসাহিত করে সেসব কাজ থেকে বিরত থাকাই উচিত। বরং যেখানে পাপের আশঙ্কা বেশি বা প্রায় নিশ্চিত তা-ও পরিহার করা আবশ্যক।

আর আলেম-উলামারা মসজিদে-মাহফিলে ঈমান বিধ্বংসী বিষয় থেকে সাধারণ মুসলিমদের সতর্ক করবেন। এটা তাদের দায়িত্ব।

আমি সরকারের প্রতি আহবান জানাবো, কুরআন-হাদিসে নেই এমন কাজ থেকে বিরত থাকুন। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে আছে, সেসবের প্রতি মনোযোগ দিন। জনগণের ঈমান-আকিদার ক্ষতি হয় এমন কাজ করবেন না, তাকে উৎসাহিতও করবেন না।

ধর্মের উর্ধ্বে গিয়ে পহেলা বৈশাখ পালনের সুযোগ নেই : আল্লামা আনোয়ার শাহ
বর্তমানে যেভাবে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয় ইসলামে তার কোনো অবকাশ নেই। ইসলামে নববর্ষ পালনের সুযোগ থাকলে হিজরি সন হিসেবে পহেলা মহররম পালন করা হতো। কিন্তু তা করা হয় না। বাংলা নববর্ষ একটি ব্যবসায়িক ক্যালেন্ডারের হিসাব। এখন পহেলা বৈশাখের অনেক আয়োজন শিরক বা শিরকের পর্যায়ভূক্ত। মুসলিম হিসেবে তা চর্চা করা যায় না।

পহেলা বৈশাখের আয়োজনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। তাতে বিভিন্ন মুখোশ ও প্রাণীর প্রতিকৃতি বহন করা হয়। আমরা যতোটুকু জানি, একেক প্রতিকৃতি বহনের পেছনে একেকটি বিশ্বাস বা চিন্তা কাজ করে। আর এই বিশ্বাসের অনেক কিছুই নেওয়া হয়েছে হিন্দু ধর্মমত থেকে। হিন্দু ধর্মমত থেকে নেওয়া না হলেও যদি বিশ্বাস করা হয় ‘অমুক প্রাণী’ এই কল্যাণ বয়ে আনবে -তাও শিরক বলে গণ্য হবে। কারণ, কোনো প্রাণী কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না এবং তা কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণের প্রতীকও নয়। এভাবে যদি শিরক বা শিরকতুল্য কাজের চর্চা হতে থাকে তাহলে মানুষ তাওহিদ ও একত্ববাদের বিশ্বাস থেকে নিজের অজান্তে বিচ্যূত হয়ে যেতে পারে।

আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে পহেলা বৈশাখের আয়োজনের যে পৃষ্ঠপোশকতা ও নির্দেশনার কথা শোনা যাচ্ছে, তার পেছনে যুক্তি হলো, এটি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। আসলে মুসলমানের জন্য বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে বড় পরিচয় হলো আমি একজন মুসলিম। একজন অমুসলিম বাঙালি যা করতে পারে একজন মুসলিম বাঙালি তা করতে পারে না –এটা সরকারের বোঝা উচিত। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ন্যূনতম দ্বীনি বোধ ও চেতনা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন লোক রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আছে বলে তো দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং তাদেরকে এই তফাৎ কে বোঝাবে?

মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখি মেলা ও চৈত্র সংক্রান্তি ইত্যাদিকে আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতি বলা হয়। আমার প্রশ্ন হলো, বাংলা সনের উদ্ভব যদি সম্রাট আকবরের হাতে হয় তাহলে পহেলা বৈশাখের আয়োজন আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতি কী করে হয়? এর আগে কী বাঙালি ছিলো না? সম্রাট আকবরের জন্মের পর এখনও পাঁচশো বছর হয়নি। আমাদের শৈশব এই দেশেই কেটেছে। আমরা এই দেশের বাঙালিকে এখনকার বাঙালির মতো করে পহেলা বৈশাখ পালন করতে দেখিনি। শোভাযাত্রা বলতে কিছুই ছিলো না। পহেলা বৈশাখে হিন্দুদের মেলা হতো এবং দোকানে দোকানে হালখাতা হতো। মুসলিম দোকানিরা দোয়া-মাহফিল করে হালখাতা করতো।

পহেলা বৈশাখে কোনো কোনো ‘বুদ্ধিজীবী’কে বলতে শোনা যায় ধর্মের উর্ধ্বে গিয়ে উৎসব পালন করার কথা বলতে। আমি তাদেরকে বলতে চাই, ইসলামে ধর্মের উর্ধ্বে কিছু নেই। এখানে আমি আমার ধর্মকে বিসর্জন দিচ্ছি অথচ অন্যের ধর্মমতের আলোকে তা পালন করছি –এটাকে আমি ধর্মের উর্ধ্বে কীভাবে বলি? মন্দিরের মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে বা ওই চেতনার মঙ্গল শোভাযাত্রা করে যে উৎসবের সূচনা হয় তাকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলার সুযোগ কোথায়? রাসুল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি যে জাতির দলকে ভারি করবে, সে তাদের অন্তর্ভূক্ত। পহেলা বৈশাখে কাদের দল ভারি হচ্ছে সেটা ভেবে দেখা দরকার।

আমি মনে করি, যেহেতু উলামায়ে কেরাম এই উম্মতের জিম্মাদার। তাই তাদেরকে উম্মতকে শিরকি কাজ থেকে বিরত রাখার চিন্তা ও প্রচেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। জাতিকে সতর্ক করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, উত্তেজক ও উস্কানিমূলক কথা বলা উচিত নয়। সরকারের প্রচণ্ড সমালোচনা করারও দরকার নেই। আমরা কুরআন ও হাদিসের কথা বলবো, তুলে ধরব। যুক্তি ও দলিল দিয়ে মানুষকে বোঝাবো। যাতে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে মুসলিম হিসেবে তাদের কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়। আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দেব না।

পূর্ববর্তি সংবাদসাতক্ষীরায় খ্রিস্টান মিশনে আগুন, চারটি ঘর পুড়ে ছাই  
পরবর্তি সংবাদশেকৃবিতে ছাত্রলীগের রাতভর সংঘর্ষ, তিন গ্রুপের ৭১জন আহত