ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে শাব্দিক ও বিচ্যুত উদারতা নিষ্ফল

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ।।

গত ২ এপ্রিল  দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘শুধু নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে অন্য ধর্মকে বাতিল মনে করার মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।’

এ বক্তব্যটি একজন ভিসির মুখে উচ্চারিত হলেও দেশে কিছু কিছু লোকের মানসিকতা এরকমই। এ জাতীয় কথা যারা বলে এবং এরকম চিন্তা ও ধ্যানধারনা যারা লালন করে তারা মূলত ধর্মীয় জ্ঞানের স্বল্পতা আর ধর্মীয় জীবনের চর্চা না থাকার কারণেই এটা করে থাকে।

যারা বলে, আমার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করা যাবে না, অন্য ধর্মকে বাতিল মনে করা যাবে না– তাদের একটা ধারণা হচ্ছে, নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ আর অন্য ধর্মকে বাতিল মনে করার ফলে ধর্মীয় সংঘাত তৈরি হবে। সব ধর্মের লোক সমাজে বসবাস করে। সেখানে নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করলে আর অন্য ধর্মকে বাতিল মনে করলে অসহিষ্ণুতা ‍ও সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। তাদের এ চিন্তাটাই ভ্রান্ত। ইসলামের শিক্ষা ও জ্ঞান না থাকা এবং ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে ন্যুনতম ধারনা না থাকার কারণে তারা এভাবে ভাবছে এবং তাদের মধ্যে এ জাতীয় বিভ্রান্ত ধারণার জন্ম হচ্ছে।

মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের চিত্রটি ইতিহাসের পতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। সে রাষ্ট্রে ধর্মের অনুসারী, মুশরিক, ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে মুসলমানদের সুন্দর সহাবস্থান ছিল। এটা ছিল হিজরতের পরের চিত্র। অথচ ততদিনে বহু মক্কী সূরা নাযিল হয়েছে, যে সূরাগুলোতে ইহুদী, নাসারা ও মুশরিকদের ধর্মচিন্তা ও জীবনধারা যে সুষ্পষ্ট বাতিল– এ কথা বিভিন্নভাবে ঘোষিত হয়েছে। সাহাবিগণ সেসব সূরা পড়েছেন, নিয়মিত তেলাওয়াত করতেন, অন্যান্য ধর্মের ভ্রষ্টতা সম্পর্কে স্পষ্ট বিশ্বাস তারা লালন করতেন, ধারণ করতেন। কিন্তু স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তাতে মোটেও ক্ষুণ্ন হয়নি। যতদিন পর্যন্ত ভিন্ন ধর্মের কোনো দল বা গোষ্ঠী বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটায়নি, ততদিন পর্যন্ত মদীনার সহাবস্থানের চিত্র এ রকম শান্তিপূর্ণ  ছিল।

একটি পূর্ণ ইসলামী সমাজে অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ এই সহাবস্থানটা কেন ও কীভাবে হয়েছিল? এটা হয়েছিল এ জন্য যে, ইসলাম এ শিক্ষাই দেয় যে তোমাদের সমাজে ভিন্ন ধর্মের যেসব অনুসারী রয়েছে তারা যদি কোনো পীড়াদায়ক ও আক্রমণাত্মক আচরণ না করে তবে তুমি তাদের প্রতি রুঢ় হতে পারবে না, তাদের শান্তি বিঘ্নিত করতে পারবে না। সুতরাং অন্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, স্বাভাবিক জীবনযাপন আর অপর ধর্মের প্রতি, অপরের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন কিংবা তাদের ধর্মের প্রতি আধা-বিশ্বাস স্থাপন মৌলিকভাব্ দুটি ভিন্ন বিষয়। এ দুটি এক বিষয় নয়। ইসলাম সম্পর্কে যাদের খণ্ডিত লেখাপড়া, এমন সব লোককেই এ দুটি বিষয়কে গুলিয়ে ফেলতে দেখা যায়।

পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে বহু ঘোষণা আছে, ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ  কর। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- ভিন্ন চিন্তা ও ধর্মকে পরিহার করতে । ইসলামের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস না হলে এবং অন্য ধর্ম ও চিন্তার ভ্রষ্টতা সম্পর্কে স্বচ্ছ বিশ্বাস না রাখলে আক্ষরিক অর্থেই কেউ মুমিন বা মুসলমান হতে পারে না। সুতরাং নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ মনে করা আর অন্য ধর্মকে বাতিল মনে করার মানসিকতা পরিবর্তনের যে আহ্বান, এটা সম্পূর্ণভাবেই পরিত্যাজ্য। একজন মুসলমান এ জাতীয় ভ্রষ্ট চিন্তা লালন করতে পারে না। এ জাতীয় চিন্তা ও বক্তব্য কিছুতেই গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।

আমরা বরং বলি, ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে এ ধরণের উদ্ভট কথা না বলে মুসলিম দেশে মুসলমানদেরকে ইসলামের সামাজিক জীবন ব্যবস্থার পরিপূর্ণ তালীম দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। যদি বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামের সামাজিক জীবনের শিক্ষাদান ও সে শিক্ষার চর্চা শুরু হয় এবং ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদেরও এ শিক্ষার আওতায় আসার সুযোগ দেওয়া হয়- তাহলে সে শিক্ষা সবার জন্যই কল্যাণকর হবে। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী সমাজ বিষয়ক শিক্ষার ধারণা থাকলে ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এ জাতীয় ভুল চিন্তা তৈরি হওয়ার অবকাশই থাকতো না ।

এক শ্রেণির লোক আছেন যারা মনে করেন, অপর ধর্মকে বাতিল মনে না করার কথাটা হচ্ছে ধর্মীয় উদারতার বহিঃপ্রকাশ। এটা সম্পূর্ণ ভুল চিন্তা। ধর্মীয় উদারতার চিন্তাটা এভাবে করার প্র্রয়োজন নেই। আপনি মুসলিম। আপনার বাড়িতে হিন্দু ধর্মের মেহমান এলে আপনি তাকে ঘরে রান্না করা গরুর গোশত না দিয়ে তার আপত্তি নেই – এমন খাবার তাকে খেতে দিলেন – এটাই ধর্মীয় উদারতা। পাশের বাড়িতে ভিন্ন  ধর্মের কেউ পুজো করছে কিংবা তার মতো করে ধর্ম পালন করছে, আপনি কোনো বাধার সৃষ্টি করছেন না– এটা ধর্মীয় উদারতা। অপরদিকে আপনি যদি তার ধর্মের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানকে ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে, মনের দিক থেকে দোষনীয়ই মনে না করেন তাহলে আপনার ধর্মবিশ্বাসের অবস্থানটাই নড়বড়ে হয়ে যায়। এটা উদারতার পর্যায়ে পড়ে না। শিরকি কোনো চিন্তা বা অনুষ্ঠানের সঙ্গে মনের দিক থেকে সমর্থন আপনি করতে পারেন না। সাধরণ অবস্থার নীতি হলো, যদি মুসলমানদের উপর অন্য ধর্মের অনুসারীরা চড়াও না হয়– আক্রমণকারী না হয়– তাহলে কোনো মুসলমান তাদের কোনো ক্ষতি করতে উদ্যত হতে পারবে না। এটা ইসলামের উদারতা, এটা ইসলামের শিক্ষা।

বিশ্বাস শিথিল করা বা বদলে ফেলার নাম উদারতা নয়। ইসলামে ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এমন উদারতার  কোনো প্রয়োজন নেই, অবকাশও নেই। ‘নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বা সত্য ধর্ম মনে করা যাবে না- অপর ধর্মকে বাতিল মনে করা যাবে না’ এসব কথা আসলে নিস্ফল শাব্দিক উদারতা। এমন উদারতা হচ্ছে বিচ্যুত উদারতা। ঈমানের সঙ্গে এ জাতীয় শাব্দিক ও বিচ্যুত উদারতার কোনো সম্পর্ক নেই।

পূর্ববর্তি সংবাদআজও দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা
পরবর্তি সংবাদচট্টগ্রামের দারুল মা’আরিফের সহকারী পরিচালক ড. জসীম উদ্দীন নদভীর ইন্তিকাল