কাদিয়ানি বিষয়ক সংলাপ : কী আছে, কী নেই

গত ৪ এপ্রিল বিবিসি বাংলার বিশেষ মৌসুম ‘বিভেদ পেরিয়ে’-তে ইসলাম ও কাদিয়ানি মতবাদ নিয়ে ‘বিতর্ক ও আলোচনা’র আয়োজন করা হয়। এতে কাদিয়ানিদের প্রতিনিধিত্ব করেন ‘আহমদিয়া মুসলিম জামাতের বাংলাদেশে’র মুবাল্লিগ ইনচার্জ আবদুল আউয়াল খান চৌধুরী এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের প্রতিনিধিত্ব করেন আল কুরআন রিসার্চ অ্যান্ড রিসাইটেশন সোসাইটির চেয়ারম্যান সাইয়্যিদ জুলফিকার জহুর। আলোচনায় সময়ের স্বল্পতাসহ নানাবিদ কারণে আবদুল আউয়াল খান চৌধুরীর কিছু কথার স্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি প্রচারিত ভিডিও ক্লিপসে।  ফলে তা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। অনেকেই ইসলাম টাইমসকে এসব বিষয়ে একটি পরিস্কার বক্তব্য তুলে ধরার অনুরোধ করেছেন এই কয়েকদিনে।

পাঠকের অনুরোধে বিবিসি প্রচারিত আলোচনার ভিডিওটির প্রতি ইসলাম টাইমস  মাওলানা আবু সালমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি  বেশ কিছুদিন যাবত কাদিয়ানি ধর্মমত বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করছেন এবং কাদিয়ানিদের মাঝে মাঠপর্যায়ে দাওয়াতি কাজেরও অভিজ্ঞতা আছে তার। তিনি বিষয়টি নিয়ে ইসলাম টাইমসের সঙ্গে কথা বলেন। তার আলোচনাটি ‘মুখকলাম’ হিসেবে ধরা হলো।


আমার মনে হয়, ব্যক্তি নির্বাচনে বিবিসির বিবেচনা এখানে সমান হয়নি। কাদিয়ানিদের পক্ষ থেকে ডাকা হয়েছে মুবাল্লিগ ইনচার্জকে আর মুসলমানের পক্ষ থেকে যাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তিনি এই বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোক বলে হয়নি। অন্তত তার কথা শুনে মনে হয়েছে, এই বিষয়ে তার বিশেষ কোনো প্রস্তুতি ছিলো না।

কাদিয়ানি মুবাল্লিগ আবদুল আউয়াল খান শুরুতেই বলেছন, কাদিয়ানিদের সাথে মুসলমানের ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য খুব সামান্য। তাহলো, মুসলিমরা মনে করে রাসুলুল্লাহ সা. যে মাহদির কথা বলেছেন তিনি এখনও আগমন করেননি। আগামীতে আসবেন। কাদিয়ানিদের বিশ্বাস তিনি চলে এসেছেন। তার নাম মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি। আর তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অথচ ইসলামি আকিদা-বিশ্বাসের সঙ্গে কাদিয়ানিদের মৌলিক ও প্রধান প্রধান অনেক পার্থক্য রয়েছে। তার এই বক্তব্যটাই অত্যন্ত ধোঁকা ও প্রতারণামূলক।

যে বিষয়টি পুরো আলোচনায় আসেনি তাহলো, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানির নবুওয়াত দাবি। অথচ এটিই আলোচনার মূল বিষয় হতে পারতো। রাসুল সা.-এর পর যে কোনো ব্যক্তি যে অর্থেই নবুওয়াত দাবি করুক না কেন সে কাফের। নবুওয়াতের কোনো ধরন বা প্রকার নেই -যেমনটি কাদিয়ানিরা বলে থাকে। তারা জিল্লি নবী, বুরুজি নবী ইত্যাদি প্রকার উদ্ভব করেছে। এজন্য সাহাবায়ে কেরাম রা. ও তাবেয়িনদের যুগে যারা নবুওয়াত দাবি করেছিলো সাহাবাগণ ও তাবেয়িরা কোনো চিন্তা ছাড়াই তাদের প্রতিরোধ করেছেন। তারা ভাবতে যাননি যে, তার নবুওয়াত দাবির ধরনটা কেমন। মূলকথা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি নবুওয়াত দাবি করে কাফের হয়ে গেছে এবং যারা তার অনুসরণ করবে তারাও কাফের হিসেবে গণ্য হবে।

খতমে নবুওয়াতের অস্বীকারের ব্যাপারেও আলোচনা আসতে পারতো বলে আমি মনে করি। কাদিয়ানি আলোচক আবদুল আউয়াল খান তার আলোচনার শুরুতে একটি উদ্ধৃতি পাঠ করেছেন। সেখানে রাসুল সা.-কে শেষ নবী মানার কথা রয়েছে। এটাও একটা প্রতারণামূলক বক্তব্য। কারণ, কাদিয়ানিরা যখন কুরআনের শব্দ হিসেবে ‘খতমে নবুওয়াত’ অস্বীকার করার সাহস পেলো না, তখন তারা খতমে নবুওয়াতের এমন একটি ব্যাখ্যা দাড় কারিয়েছে –যা এই পর্যন্ত কেউ করেনি। তাদের ব্যাখ্যাটি হলো, খাতামুন নাবিয়্যিন-এর অর্থ এমন নবী যার মোহর দ্বারা অন্যান্য নবীর সৃষ্টি হবে। এই অর্থে তারা দাবি করে, নবী কারিম সা.-এর মোহর দ্বারা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি নবী। নাউজুবিল্লাহ! এই ব্যাখ্যা যেহেতু সম্পূর্ণ কুরআন-হাদিস বিরোধী তাই তারা খতমে নবুওয়াত স্বীকার করে -এটা বলা যায় না।

কাদিয়ানিদের দ্বিতীয় খলিফা মির্জা মাহমুদ –যিনি গোলাম আহমদ কাদিয়ানির বড় ছেলে- তিনি বলেছেন, আমার গলায় যদি তলোয়ার রাখা হয় তবুও আমি বলবো আল্লাহর রাসুলের পরে হাজারও নবীর আগমন হতে পারে। তার বক্তব্য থেকে খতমে নবুওয়াত বিষয়ে কাদিয়ানিদের বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

আমরা যেহেতু বিশ্বাস করি, রাসুল সা.-এর পর আর কোনো নবী আসবেন না তাই ওহির দরজাও বন্ধ। কিন্তু কাদিয়ানিদের দাবি গোলাম আহমদ কাদিয়ানির উপর প্রচুর ওহি নাজিল হয়েছে। মুসলিমদের সাথে কাদিয়ানিদের বিশ্বাসের আরেকটি পার্থক্য হলো, আমরা বিশ্বাস করি রাসুল সা.-এর শরিয়ত ও শিক্ষার উপর আমলই নাজাতের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তারা মনে করে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানির শিক্ষাগ্রহণ ও তার নবুওয়াতের স্বীকৃতি ছাড়া কেউ মুক্তি পাবে না। তাদের এসব বক্তব্যই প্রমাণ করে তারা রাসুল সা.-কে শেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস করে না।

আলোচক আবদুল আউয়াল খান বারবার মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানিকে মাহদি হিসেবে উল্লেখ করছিলেন। কিন্তু হাদিসে বর্ণিত ইমাম মাহদির নিদর্শনের সাথে তার কোনো মিল নেই। যদিও তারা হাদিস বিকৃত করে, হাদিসের অপব্যাখ্যা করে, তার কিছু অংশ নিয়ে এবং কিছু অংশ ছেড়ে দিয়ে কাদিয়ানিকে মাহদি প্রমাণের চেষ্টা করে তবুও তা কোনোভাবেই প্রমাণিত হয় না। আশ্চর্য বিষয় হলো, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি মাহদি হওয়ার দাবি করেন ১৮৯১ সালে আর নবী হওয়ার দাবি করেন ১৯০০ সালে। সুতরাং নবী হওয়ার দাবিটি তার মূল দাবি হওয়ার কথা। কিন্তু কাদিয়ানিরা তার নবুওয়াতের দাবি গোপন করতে চায়। অধিকাংশ সময় তারা বলে তিনি নবী হওয়ার দাবি করেননি।

কাদিয়ানি আলোচক আবদুল আউয়াল খান তার বক্তব্যে আরেকটি কথা বলেছেন, তিনি শেষ শরিয়তবাহী নবী। তার এই কথা মূলত তাদের একটি বিশ্বাসের প্রতি ইঙ্গিত। তাহলো, রাসুলুল্লাহ সা.-এর পর কোনো শরিয়তবাহী নবী আসতে পারবে না। কিন্তু শরিয়তবিহীন নবী আসতে পারে। তাদের মতে, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি শরিয়ত বিহীন নবী। কিন্তু কুরআন হাদিসের কোথাও এমন কথা নেই যে, রাসুল সা.-এর শরিয়ত বিহীন কোনো নবী আসতে পারে।

আলোচনায় আবদুল আউয়াল খান বলেছেন, মাহদির আগমন হবে দামেস্কের পূর্ব দিকে আর ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব দামেস্কের পূর্ব দিকে অবস্থিত। এটাও একটা বিকৃতি। প্রথম কথা হলো, হাদিসটি মাহদি আ. সম্পর্কে না। তা হজরত ঈসা আ.-এর আগমন সম্পর্কে। দ্বিতীয় কথা হলো, হাদিসের শব্দটি হলো ‘শারকিয়্যাতু দামেস্ক’ দামেস্কের পূর্বাংশ বা পূর্ব দামেস্ক। যদি বলা হয়, পূর্ব ঢাকা। তাহলে মানুষ কী বুঝবে? বুঝবে, ঢাকার পূর্বাংশ কিন্তু তা ঢাকার ভেতরেই অবস্থিত। তবে জেনে রাখা প্রয়োজন, কাদিয়ানিরা মির্জা গোলাম আহমদকে একই সঙ্গে ঈসা ও মাহদি মনে করে। তাই এক বিষয়ের হাদিস অন্য বিষয়েও ব্যবহার করে।

ইমাম মাহদি আ. সম্পর্কে হাদিসের কিতাবে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে আমরা কিছু নিদর্শন বের করতে পারি। যেমন, তিনি ফাতেমি বংশের হবে। হজরত হাসানের অধস্তন পুরুষ হবেন। তার নাম হবে মুহাম্মদ এবং পিতার নাম হবে আবদুল্লাহ। হাদিসে এসেছে রাসুল সা. বলেছেন, ‘আমার পরিবারের এমন ব্যক্তি যার নাম হবে আমার নামে এবং যার পিতার নাম হবে আমার পিতার নামে।’ এটা একটা বড় পরিচয়। তার আবির্ভাব হবে হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানির মাঝে। সেখানে মানুষ তাকে চিনে ফেলবে এবং তার হাতে বাইয়াত হবে। এর কোনোটা কী কাদিয়ানিদের মধ্যে পাওয়া যায়?

আলোচনা শুরুর আগে কাদিয়ানি নেতা আবদুল আউয়াল খান বলেছেন, আমরা সরকারি ঘোষণায় মুসলিম না, তাই সরকারি ঘোষণায় অমুসলিমও হবো না। এটা তারা কেন বললো? তারা বলে, মূলত মুসলমানের দাবিকে খাঁটো করে দেখানোর জন্য। গুরুত্বহীন প্রমাণ করার জন্য। এই কথার উত্তর হলো, মুসলমানরা সরকারি ঘোষণা ছাড়াই কাদিয়ানিদের অমুসলিম মনে করে। তবুও তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবি করা হয় যেন তারা নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। নিজেদের সঠিক পরিচয়টা প্রদান করে।

অনুষ্ঠানে কাদিয়ানি নেতা আবদুল আউয়াল বলেছেন, যারা কোনো মুসলিমকে অমুসলিম বলে তারা নিজেরা অমুসলিম হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য যেহেতু আলেমরা কাদিয়ানিদেরকে অমুসলিম বলেন তাই তারা অমুসলিম। আমার কথা হলো, কাদিয়ানি বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের ধর্মমত গ্রহণ না করলে সে আর মুসলিম থাকে না। সে হিসেবে পৃথিবীতে মুসলিমের সংখ্যা খুব সামান্য। তারাই তো অধিকাংশ মুসলিমকে কাফের প্রমাণ করলো। কাদিয়ানিদের বিশ্বাস হলো মির্জা গোলাম আহমদ ‘মাসিহ’। হাদিসে এসেছে, মাসিহ আসার পর পৃথিবীর অমুসলিমরা মুসলিম হয়ে যাবে। আর তাদের মাসিহ এসে মুসলিমদের অমুসলিম করে দিলো।

দ্বিতীয় কথা হলো, হাদিসে মুসলিমকে কাফের বলতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু কাফেরকে কাফের বলতে নিষেধ করা হয়নি।

মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি ১৯০০ সালে গোলাম আহমদ কাদিয়ানি নবুওয়াত দাবি করেন। ১৮৯১ সাল থেকে নবুওয়াত দাবির আগ পর্যন্ত তিনি রাসুল সা.-কে শেষ নবী হিসেবে স্বীকার করতেন। তিনি একথাও বলেছেন, রাসুল সা.-এর পরে যে কোনো ধরনের নবুওয়াতের দাবিদার কাফের। তাই আমরা এটাও বলতে পারি, মির্জা গোলাম আহমদের ফতোয়া অনুযায়ী কাদিয়ানিরা কাফের।

শ্রুতিলিখন : আবরার আবদুল্লাহ

পূর্ববর্তি সংবাদ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা  ৪২ হাজার ২০০ ট্যাবও কাজ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে
পরবর্তি সংবাদসংঘাত ও সহিংসতার পথ পরিহার করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আহবান সিইসির