মনে পড়ে ৬ এপ্রিল : ঈমান ও নবীপ্রেমের জাগরণ

আতাউর রহমান খসরু ।।

৬ এপ্রিল ২০১৩। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আহবানে সাড়া দিয়ে লাখ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলো ‘ঈমান ও ইসলাম রক্ষা’র লংমার্চে। দূর-দূরান্ত থেকে তৌহিদি জনতার সফেদ স্রোত মিলিত হয়েছিলো শাপলার মোহনায়। শাসক গোষ্ঠির সর্বাত্মক অসহযোগিতা, কতিপয় বাম রাজনৈতিক দলের কথিত হরতাল, পথে পথে বাধা বাধা-হামলা-লাঞ্ছনা, ঢাকার প্রবেশ পথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পথরোধ সবকিছু উপেক্ষা করেই শাপলাচত্ত্বরে হাজির হয়েছিলো এদেশের দ্বীনপ্রাণ মানুষ।

তারা এসেছিলো নিজেদের ঈমান ও ইসলামের নিরাপত্তার দাবি নিয়ে, আল্লাহর জমিনে আল্লাহ ও তার রাসুল সা.-এর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার শ্লোগান নিয়ে, দেশ, জাতি, ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুদের সংঘবদ্ধ যাত্রা থামিয়ে দিতে। ঈমানি সেই জাগরণের তীব্র আত্মপ্রকাশে ভীত হয়ে ওঠে স্বার্থপূজারী রাজনীতিক ও পরজীবী বুদ্ধজীবীরা। তাই তা থামিয়ে দিতে সংঘটিত হয় ৫ মের মতো কালো রাতের। কিন্তু সেই চেতনার বিকাশ কী থেমে গেছে? কোথা থেকে শুরু হয়ে তার বিকাশ কোথায় গিয়ে থেমেছে?

৬ এপ্রিল ঐতিহাসিক লংমার্চের অন্যতম সংগঠক মুফতি সাখাওয়াত হোসাইনের ভাষায়, এ দেশের মানুষ যে ইসলাম পছন্দ করে, এদেশের মানুষ উলামায়ে কেরামকে পছন্দ করে তার বড় প্রমাণ ছিলো ৬ এপ্রিলের লংমার্চ। হেফাজতে ইসলাম তখন গোছানো কোনো সংগঠন ছিলো না। তবুও মানুষ তাদের ডাকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছিলো। কিন্তু তার দাবি ছিলো মাটি ও মানুষের দাবি। এজন্য মানুষ তাদের ডাকে সাড়া দেয়। নিকট ইতিহাসে এমন স্বতঃস্ফূর্ত এবং এতো বড় জমায়েত মানুষ দেখেনি।

কেন মানুষের এই বাধভাঙ্গা জোয়ার শুরু হয়েছিলো? উত্তরে বলেন, মূলত দাবি ছিলো, এই দেশের মানুষ যেন তাদের ঈমান ও ইসলামের সাথে বাঁচতে পারে। ঈমান ও ইসলামের উপর কেউ আঘাত করতে না পারে। তখন কতিপয় নাস্তিক ব্লগার নানাভাবে ঈমান ইসলামের উপর আঘাত করছিলো। যা মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ফলে তারা রাস্তায় নেমে আসে।

ইসলাম টাইমস সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের বিপুল ও সারা জাতির মাঝে প্রভাব বিস্তারকারী আত্মপ্রকাশ হয়েছিলো ৬ এপ্রিল।

তিনি এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন। বলেন, ৬ এপ্রিলের মূল্যায়ন করতে হলে শাহবাগ আন্দোলনের দিকে চোখ যায়। শাহবাগ আন্দোলনের অনেক ব্যাখ্যা অনেকে করছেন। তার ভেতরে কী ছিলো, সামনে কী ছিলো এবং শ্লোগানে কী ছিলো। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটি সামনে এসেছে তাহলো, বাংলাদেশের মুসলমানের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি ঝড়। মূল শ্লোগান ভিন্ন হলেও তাদের আন্দোলনে এ ঝড়টাই মুখ্য হয়ে ওঠে ফেব্রুয়ারি শেষ দিকে। এই ঝড় বা আক্রমণের বিরুদ্ধে ৬ এপ্রিল ছিলো দেশব্যাপী ঈমানের মহাজাগরণ। একটি বিজয়।

তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালে ৬ এপ্রিল ইসলাম বিরোধী সংস্কৃতি ও অপবিশ্বাসের বিরুদ্ধে শুদ্ধতার পক্ষে চেতনাগত নতুন প্রতিরোধের সূচনা হয়েছিলো। ইসলাম ও ঈমানের বিরুদ্ধে ঘাপটি মেরে থাকা এ দেশের বাম ও ভারতপন্থী রাজনীতিক বুদ্ধিজীবী, এই জাতিসত্ত্বা, এ দেশের মানুষের ঈমান ও চেতনা বিরোধী এক শ্রেণির মানুষ –তারা যে যূথবদ্ধ একটি যাত্রা শুরু করেছিলো –তার বিরুদ্ধে ৬ এপ্রিল যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলো। ঈমান ও ইসলামের পক্ষে, রাসুল সা.-এর ইজ্জত ও সম্মানের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য একটি নতুন চেতনার জাগরণ ঘটিয়েছিলো।

এই আন্দোলনের প্রভাব সম্পর্কে মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, তৎকালীন রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয় হেফাজতের লংমার্চ। রাষ্ট্র ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকের হিসাব পরিবর্তন করে তা। হেফাজতের লংমার্চ এই বার্তা দিতে সক্ষম পেরেছিলো যে, ইসলাম ও মুসলমানকে উপেক্ষা করে কোনো মত বা মতাদর্শ এই দেশে চলতে পারে না। আমার ধারণা, হেফাজত তার আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারলে আজ দেশের বাস্তবতাও তাই হতো।

সাথে সাথে তিনি এটাও স্পষ্ট করেন যে, হেফাজতের আন্দোলন মৌলিকভাবে কখনও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছিলো না। নিখাঁদ ধর্মীয় আন্দোলন ছিলো। কিন্তু তাতে রাজনীতিকরা জড়িত ছিলেন এবং এখনও আছেন। তাদের কেউ কেউ নিজের রাজনৈতিক অভিলাষ, চিন্তার প্রসার ও স্বার্থ অর্জনের চেষ্টা করে থাকতে পারেন। তার দায় সামগ্রিকভাবে হেফাজত নেবে না।

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদের কথায়ও উঠে আসে আন্দোলনের ফলাফল। তিনি বলেন, ৬ এপ্রিলকে আরেকভাবে স্মরণ করা যায়। তাহলো এরপর সারা দেশে শানে রেসালাত সম্মেলন শুরু হয়। এ সময় যারা পূর্বে শাহবাগ আন্দোলনকে নিজেদের দাবি করেছিলো এবং তার যে কোনো দায় কাঁধে চাপিয়ে নিচ্ছিলো তারা তাদের দাবিকে ভাগ করতে শুরু করে। তারা বলতে থাকে আমরা শাহবাগের এতোটুকুর সাথে একমত এবং শাহবাগের এই অংশটুকু আমাদের নয়। যদিও তারা ও তাদের অভিভাবক সংগঠনগুলোর মূল চেতনা এক রকমই ছিলো। যা বিভিন্ন ঘটনা ও বক্তব্যে সামনে এসেছে।

প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় এগিয়ে যাওয়া এই আন্দোলন যে তার গতি হারিয়েছে তা মেনে উভয় আলেম। যদিও তার গতি ও গতিশীলতা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে তাদের।

মুফতি সাখাওয়াত বলেন, আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারার প্রধান কারণ জুলুম নির্যাতন। হেফাজতের নেতাদের উপরে এতো বেশি জুলুম হয়েছে যে, তারা আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেননি। এরপর বলবো, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব ছিলো। আমরা যারা প্রথম থেকে তৎপর ছিলাম আমরা যথাযথ কুরবানি ও ত্যাগ স্বীকার করতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, হেফাজতে ইসলামের দাবি পূর্ণ হয়নি সত্য। কিন্তু নেতৃবৃন্দ তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে সরে গেছেন বলে আমি মনে করি না। আমার মনে হয়, নানান কারণে তারা লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারছেন না। থেমে আছে।

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ৫ মের বেদনাদায়ক ও বিয়োগাত্মক ঘটনার পর অনেকেই মনে করেছিলো ৬ এপ্রিলের জাগরণটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কাছে তা মনে হয়নি। বিষয়টি আমি এভাবে দেখি, ৬ এপ্রিলের আগের অংশ ছিলো জাগরণের প্রস্তুতি, ৬ এপ্রিলের পর থেকে ৫ মে পর্যন্ত জাগরণের বিকাশ। আর ৫ মে ছিলো প্রচণ্ড রকম বেদনাদায়ক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার পর ঈমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো আঘাত এলে ঈমানের প্রতি ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের জায়গা থেকে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়া, রাস্তায় এসে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটানো –এর একটি নীরব ও শব্দহীন চেতনা সারা দেশে বিকশিত হয় এবং তা এখনও বিকাশমান। এই চেতনা গত সময়গুলোতে কথা বলেছে এবং সামনেও তা কথা বলবে। এই চেতনা এ দেশে নানাভাবে কাজ করবে এবং নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে। জাতির বিশ্বাসগত যাত্রা, সংস্কৃতিগত যাত্রা; এমনকি রাজনৈতিক যাত্রার ক্ষেত্রেও সময়ে সময়ে কথা বলতে শুরু করবে ৬ এপ্রিল ইনশাআল্লাহ!

এরপর হেফাজতে ইসলাম ও শুকরানা মাহফিলের নানা সমীকরণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মুফতি সাখাওয়াত উত্তর দেন, শুকরানা মাহফিলের হেফাজতের ব্যানারে ছিলো না। তাই প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরি হলেও হেফাজতের উপর তার দায় পুরোপুরি চাপানো যায় না। হ্যা, কিছু মানুষের কিছু বক্তব্য ও আচরণ সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছে।

হেফাজতের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, সংগঠন হিসেবে হেফাজতের ভবিষ্যত নিয়ে আমি চিন্তিত না। হেফাজত ওই অর্থে কখনও সংগঠন ছিলো না। হেফাজত দ্বীনি আন্দোলন ও একটি চেতনার নাম। তবে হেফাজত কেন্দ্রি আন্দোলন থেকে আমি আশাবাদী যে, হেফাজত না থাকলেও মানুষ ঈমান ও ইসলামের প্রয়োজনে মানুষ সাড়া দেবে –যদি আমরা উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারি।

মুফতি সাখাওয়াতের কাছে সর্বশেষ প্রশ্ন ছিলো, ৬ এপ্রিলের কোন দৃশ্যটা আপনাকে অনুপ্রাণিত করে? তিনি বলেন, সেদিনের যে দৃশ্যটি আমার চোখে ভাসে তাহলো, লাখ লাখ মানুষ সব বাধা উপেক্ষা করে ঢাকার দিকে ছুটে আসছে। পথে পথে তারা নানা প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছে। ৫০-৬০ মাইল দূর থেকে পায়ে হেঁটে আসছে। কারো পেটে খাবার নেই, কারো পা ফেটে গেছে কিন্তু সবার মুখে হাসি আছে। আবার একদল মানুষ পথে পথে আগত মানুষদের আপ্যায়ন করছে, যতোটা সম্ভব সহযোগিতা করছে –ত্যাগ ও ভালোবাসার এই দৃশ্য অনন্য।

পূর্ববর্তি সংবাদমাস শুরু রবিবার রাতে, ২১ এপ্রিল মধ্য শাবানের রাত
পরবর্তি সংবাদছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে ইজিবাইক চালক নিহত