আতাউর রহমান খসরু ।।
নিকট অতীতের যে কয়েকজন বাঙালি আলেম উপমহাদেশে সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন এবং উপমহাদেশের বাইরেও যাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম রহ. তাদের অন্যতম। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই আলেম একই সঙ্গে দরস-তাদরিস, রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি ছিলেন দেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া ইউনুছিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দীর্ঘ চার দশকের অধ্যক্ষ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির অন্যতম নেতা, কাদিয়ানি ও বিদআতি ফেতনার বিরুদ্ধে এক অপরাজেয় মুনাজির (বিতার্কিক)।
আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ভূবন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মাওলানা আনোয়ার আলী রহ.ও যুগের বিশিষ্ট আলেম ও বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন।
মাওলানা তাজুল ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা স্কুলে। তবে মাত্র নয় মাসে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সব পাঠ্যপুস্তক আয়ত্ত করে তিনি এক মহাবিস্ময়ের সৃষ্টি করেন। ছেলের অসামান্য মেধা দেখে তার পিতা তাকে মাদরাসায় ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন।
দ্বীনি শিক্ষার প্রথম পাঠ তিনি মাওলানা আবদুল করিমের কাছ থেকে গ্রহণ করেন। এরপর তিনি শ্রীঘর মাদরাসা ও সিলেটের বাহুবল মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। উচ্চতর শিক্ষার জন্য আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। মাদরাসার তৎকালীন সদরুল মুদাররিসিন আল্লামা মুফতি সহুল উসমানি রহ. মাওলানা তাজুল ইসলাম রহ. সম্পর্কে বলেন, ‘এ যুবক আগামীতে একজন বড় আলেম ও বুযুর্গ হবে।’
সিলেট আলিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ হলে মুফতি সহুল উসমানি রহ. তাকে ১৩৩৮ হিজরিতে দারুল উলুম দেওবন্দ পাঠান। সেখানে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ৪ বছর লেখাপড়া করেন। তার বিদায়ের সময় আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি রহ. বলেন, দারুল উলুমের ইলমের ভাণ্ডার তাজুল ইসলামের সঙ্গে বাংলায় চলে যাচ্ছে। ১৩৪২ হিজরিতে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।
দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফিরে তিনি প্রথমে ঢাকায় এবং পরে কুমিল্লার জামিয়া মিল্লিয়ার (কাসেমুল উলুম) শায়খুল হাদিস হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৩৪৫ হিজরিতে ফখরে বাঙ্গাল রহ. জামিয়া ইউনুসিয়ার অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ ৪২ বছর তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি প্রখ্যাত বুজুর্গ ও হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ.-এর বিশিষ্ট খলিফা কারী ইবরাহিম রহ.-এর জামাতা ছিলেন। অবশ্য প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি নিজ এলাকায় দ্বিতীয় বিয়েও করেন।
আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. ছাত্র জীবন থেকে সংগ্রামী মানসিকতা পোষণ করতেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সংগ্রাম ছিলো তার জীবনে অন্যতম সৌন্দর্য্য। বাতিল ফেরকার সঙ্গে জীবনে অসংখ্য মুনাজারা ও মুবাহাসা করেছেন তিনি। দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি দিল্লি, মিরাট, সাহারানপুর ইত্যাদি স্থানে কাদিয়ানিদের মুনাজারা করে সত্যের পক্ষে জয় ছিনিয়ে আনেন।
দেশে ফেরার পরও তিনি কাদিয়ানি ও বিদআতিদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও ঢাকা অঞ্চলে অসংখ্যবার তিনি কাদিয়ানি ও বিদআতিদের মোকাবেলা করেন।
তার জীবনের একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা হলো, একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে কাদিয়ানিরা মুনাজারার ডাক দেয়। সেখানে তারা কাদিয়ানিদের মূল কেন্দ্র পাঞ্জাব থেকে বিতার্কিক নিয়ে আসে। আল্লামা তাজুল ইসলাম ছিলেন আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের পক্ষের বিতার্কিক। আলোচনার এক পর্যায়ে ফখরে বাঙ্গালের অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণের সামনে টিকতে না পেরে পাঞ্জাব থেকে আগত কাদিয়ানি নেতারা তাদের কিতাবপত্র রেখেই পালিয়ে যান।
যখন তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের মেশকাতের ছাত্র, তখন কাব্যিক (আরবি) ভাষায় কাদিয়ানিদের সঙ্গে বাহাস করেন এবং তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ধারণা করা হয়, আরবি ভাষার উপর তার দক্ষতা বাহাসের ফলাফল নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো।
কাদিয়ানি বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি দুটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তাহলো, মৌলভীপাড়া জামে মসজিদ এবং আনন্দবাজার জামে মসজিদ। মূলত মসজিদ দুটো কেন্দ্র করে তিনি তার দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
মাওলানা ইলিয়াস রহ. দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ শুরু করলে তাতে অংশগ্রহণ ও জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন যেসব আলেম ফখরে বাঙ্গাল রহ. তাদের অন্যতম। বাংলাদেশে তাবলিগি কাজের বিস্তারে তার বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে দেশে ও দেশের বাইরে একাধিকবার সফর করেছেন।
১৯৬৩ সালে মিসরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক উলামা সম্মেলনে ফখরে বাঙ্গাল রহ. পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। পাকিস্তানের বিখ্যাত আলেম আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রহ.ও সেই প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। তিনি উলামা সম্মেলনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মাওলানা তাজুল ইসলাম উক্ত সম্মেলনে এক অনন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানি ও ভারতীয় প্রতিনিধিরা সেখানে নতুন কোন বক্তব্য পেশ করিনি। ফখরে বাঙ্গালের বক্তব্যের সমর্থনেই জোরালো বক্তৃতা দিয়েছি মাত্র’।
ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সিলেট অঞ্চলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তৎকালীন খেলাফত আন্দোলনে সক্রীয় ভূমিকা রাখেন। রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে তিনি হজরত মাহমুদ হাসান দেওবন্দি ও হজরত হুসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর অনুসারী ছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও তিনি দেশে কুরআনি আইন প্রতিষ্ঠায় তার আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এ সময় তিনি নেজামে পার্টির অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন। শোনা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজে মৃত্যুপূর্ব মুহূর্তেও উপস্থিত নেতাকর্মীকে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমরণ সংগ্রাম অব্যাহত রাখার ওসিয়ত করেন।
৩ এপ্রিল ১৯৬৭ সালে মোতাবেক ২০ চৈত্র ১৩৭৩ বাংলা সনে রোজ সোমবার এই বরেণ্য আলেমে দ্বীন ৭১ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তার খাদেম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অপর বিশিষ্ট আলেম মুফতি নুরুল্লাহ রহ.-এর ভাষ্য মতে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার বলতে বলতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
তার মৃত্যুর সংবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শোকের ছায়া নেমে আসে। সমস্ত দোকানপাট, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। জেলা ঈদগাহ ময়দানে তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। তার জানাযা নামাজের ইমামতি করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুফাসসির সাহেব খ্যাত মাওলানা সিরাজুল ইসলাম রহ. (বড় হুজুর)। জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসা সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
দেশের বিশিষ্ট আলেম ও জামিয়া ইউনুছিয়ার শায়খুল আল্লামা সাজিদুর রহমানের মনে করেন, বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রামই হজরত ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম রহ.-এর জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ, তার জীবনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় পুরোটা সময়ে তিনি কোনো না কোনো দ্বীনি সংগ্রামের সাথে জড়িত ছিলেন।
আল্লামা সাজিদুর রহমান বলেন, আমি তাকে দেখেনি তবে তার বিশিষ্ট ছাত্রদের দেখেছি। তাদের সঙ্গে আমার কাজ করারও সুযোগ হয়েছে। তাদের ভেতর হুজুরের যে ছায়া আমি খুঁজে পেয়েছি তাহলো, দ্বীনের ব্যাপারে আপোষহীন সংগ্রামী চেতনা। সাথে সাথে জ্ঞানের নীবিড় চর্চা ও সত্যের মুখপাত্র হয়ে সমাজে দ্বীনি দাওয়াতের কাজ করে যাওয়া।
বিশিষ্ট এই আলেমের মূল্যায়ন হলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ মানুষের মাঝে যে জাগ্রত দ্বীনি চেতনা দেখা যায় তার ভিত রচনা করেন জামিয়া ইউনুছিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইউনুছ আহমদ ও ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম রহ.। আর মাওলানা সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুর তাকে মজবুতি (দৃঢ়তা) দান করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশপাশের অঞ্চল থেকে বিদআত-শিরকসহ ধর্মীয় অনাচার দূর করতে এই তিন মহীরূহ-ই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।