ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ড: জীবনের মূল্য কি কমছে?

শাহ মুহাম্মাদ খালিদ  ।।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। আমাদের প্রিয় এই শহরটি ইতোমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস-অযোগ্য এলাকা হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। ১৩৪ বর্গমাইলের এই শহরে প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের বসবাস। প্রতি বর্গ কিলোতে ১ লক্ষ ১৪ হাজার মানুষ রয়েছেন। এই হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরও এই জাদুর শহর ঢাকা।

ঢাকায় অত্যাধিক জনসংখ্যার যে সমস্ত কুফল আমরা প্রতিনিয়ত ভোগ করি তার একটি হচ্ছে ঘনঘন অগ্নিকাণ্ড এবং এতে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি। আজ বনানীতে অগ্নিকাণ্ডে ঝরে গেল অনেকগুলো প্রাণ।

পেছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিগত এক দশকে ঢাকায় বড় বড় অনেকগুলো অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। যাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় অর্ধ সহস্র মানুষ।

✓ ২০১০ সালের ৩রা জুন পুরনো ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে তৈরি এই অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ১১৯ জন মানুষ।

✓ ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার মাত্র দুই বছরের মাথায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আগুন লাগে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের একটি গার্মেন্টসে। তাজরীন ফ্যাশন নামের ওই গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে মারা যান ১২১ জন পোশাক শ্রমিক। সরাসরি আগুনে পুড়ে মারা যান ১০১ জন। আগুন থেকে বাঁচতে ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু ঘটে আরো ১০ জনের।

✓ এরপরে লম্বা সময় ধরে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গাতেই ছোটখাটো আরো অনেক অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। বিশেষ করে অতিরিক্ত ঘিঞ্চি এলাকা যেগুলো রয়েছে, অর্থাৎ ঢাকার বস্তি এবং পার্শ্ববর্তী জায়গাসমূহ সেখানে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের কথা এবং সেই আগুনে নিরীহ মানুষের সমস্ত কিছু জ্বলে পুড়ে ছারখার হওয়ার সংবাদ আমরা পত্র-পত্রিকায় দেখতে পাই।

✓ এরপর গত ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখে সেই পুরনো ঢাকারই চকবাজারে সংঘটিত হয় দেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ আরেকটি অগ্নিকাণ্ড। প্রথমে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এবং সেই আগুন বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার এ লেগে আশপাশের অসংখ্য বিল্ডিংয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী চকবাজারের আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছেন কমপক্ষে ৭৮ জন মানুষ।

✓ চকবাজারের এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আজ আবার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ঢাকার অন্যতম অভিজাত এলাকা হিসেবে খ্যাত বনানীর এফ আর টাওয়ারে। সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এখন পর্যন্ত ১৯ জন নিহত হবার কথা জানা যাচ্ছে।

এই যে এত অগ্নিকাণ্ড, তাতে অজস্র মানুষের প্রাণহানি— বিশ্লেষকরা এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। আমাদের ঢাকা শহরের জনসংখ্যার অতিরিক্ত ঘনত্ব অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম একটি কারণ। জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে দুর্ঘটনার প্রতিরোধমূলক এমন অনেক কিছুই সম্ভব হয় না যা স্বাভাবিকভাবে হয়তো সম্ভব হতো। অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে অধিক মানুষ বসবাস এর ফলে আদর্শ জীবন যাপনের যে রুচি, শৈলী ও নীতি রয়েছে, আমরা ঢাকাবাসীরা তা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হই।

অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম প্রধান আরেকটি কারণ আমাদের অসচেতনতা। আজকের বনানীর অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানা না গেলেও চকবাজারের ব্যাপারে আমরা জানতে পেরেছি, গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরবর্তীতে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারে লেগে সেই আগুন বীভৎস রূপ লাভ করে।

আমরা গাড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করি। কিন্তু তার মেয়াদ আছে কি পার হয়ে গিয়েছে সে ব্যাপারে নাক গলাই না। ঘরে বিদ্যুতের লাইন নিরাপদ ভাবে এসেছে কিনা, বিদ্যুতের উৎসগুলো কতটুকু নিরাপদ, এগুলো নিয়ে ভাবার ফুরসত আমাদের হয় না।

বিশেষত আগুন লাগার পর সেই আগুন দ্রুত নির্বাপিত করার জন্য যে সমস্ত প্রক্রিয়া আগ থেকে অবলম্বন করে রাখতে হয় আমাদের ঢাকায় তেমন কোনো ব্যবস্থা আসলে নেই। ঢাকার ভেতর ও আশপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, খাল ও লেকগুলো দূষণ আর ভরাটের মাধ্যমে আমরা সেগুলোর চেহারাই পাল্টে ফেলেছি। ফলে কখনো অগ্নিকাণ্ড হলে পানির জন্য চারদিকে হাহাকার লেগে যায়। রাস্তাঘাট অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হাওয়ায় এবং নিশ্চিতভাবেই পথে জ্যাম থাকার কারণে অগ্নি নির্বাপন এবং দ্রুত উদ্ধার করার কাজে বিঘ্ন ঘটে।

অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রচলন রয়েছে বাংলাদেশ তেমন যন্ত্রপাতির ব্যবহারে অনেক পিছিয়ে। তবে বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশে রাতারাতি সেসব যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়ে যাবে এমনটা আশা করাও বোকামি। অবশ্য সরকার ইতোমধ্যেই ফায়ার সার্ভিসে বেশ কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করেছে। কিন্তু চকবাজার ট্রাজেডির পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ওখানকার সড়কগুলো অতি সংকীর্ণ হওয়ায় তারা কোন আধুনিক যন্ত্রই ব্যবহার করতে পারেননি। তাহলে প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে— ঢাকার এ ধরনের অতি সংকীর্ণ জায়গাতেও লক্ষ লক্ষ মানুষের বসবাস। ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডের মত প্রাণনাশী দুর্ঘটনা মোকাবেলায় আমাদের কর্তারা কী উদ্যোগ নিচ্ছেন? এসব জায়গায় আবাস গড়ার সময় এই মানুষগুলোই বা তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটুকু ভাবছেন?

ভূমিকম্প, ভবনধ্বস এবং অগ্নিকাণ্ডে কী করা উচিত এ ব্যাপারে মানুষের সচেতনতার অভাব রয়েছে। এধরনের নাজুক মুহূর্তে আত্মরক্ষার উপায় কী হতে পারে সে বিষয়গুলো ব্যাপক হারে মানুষের জানা উচিত।

ক্যামেরা মোবাইল ও স্মার্টফোনের ছড়াছড়ির কারণে একটা বিষয় ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। আমরা দেখতে পাই, সড়ক দুর্ঘটনায় একজন মানুষ রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অন্যরা তাকে উদ্ধার করার বদলে ভিডিও করার কাজে ব্যস্ত। খুব সম্ভবত এই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করে বেশ কিছু লাইক ও মন্তব্য অর্জন করার মানসিকতা তাদের মধ্যে কাজ করে। বিশেষ করে আজকে বনানীর অগ্নিকাণ্ডে ভবনের সম্মুখবর্তী রাস্তায় স্মার্ট ফোনের ক্যামেরা চালু করা অবস্থায় যে হাজার হাজার মানুষ দেখা গিয়েছে, তাতে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তাদের এই ধরনের অযাচিত ভিড়ের কারণে উদ্ধারকাজ মারাত্মক রকম ব্যাহত হয়েছে। এই জাতি কবে থেকে এমন তামাশাপ্রিয় হয়ে গেছে সেই ইতিহাস অবশ্য জানা নেই।

অনেকে চোখ বন্ধ করে জনসংখ্যাকে দায়ী করতে নারাজ। কারণ জাপানের টোকিও থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক ঘনবসতিপূর্ণ শহর আছে, যারা এইসব জটিলতা কাটিয়ে উঠেছে দেশপ্রেম, মেধা ও প্রযুক্তির সাহায্যে। একই রকম জনসংখ্যা নিয়েও সেখানে নেই অগ্নিকাণ্ড, ভবনধ্বস, সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট— যেগুলো আমাদের দেশে হরহামেশার চিত্র। মেধা আমাদেরও আছে, অর্থনৈতিক সক্ষমতাও যে কমবেশি আছে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেলের মত মেগা প্রকল্পগুলো সেকথা জানান দিচ্ছে। অভাব হল উন্নত মানসিকতা আর দেশপ্রেমের। মাটি ও মানুষের প্রতি দরদের সীমাহীন ঘাটতি আমাদের। অবৈধ পথে দু’পয়সা অর্জনের সুযোগও হাতছাড়া করতে চাই না আমরা।

দিন দিন যেভাবে মানুষের প্রাণের মূল্য পড়ে যাচ্ছে সেটা যথেষ্ট শঙ্কা উৎপাদন করে। একটা দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই নতুন করে আরেকটা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয় আমাদের দেশের মানুষেরা। দৈনিক সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ৩০ জন করে মানুষ নিহত হয়। এই যে প্রাণ ঝরছে, প্রাণের প্রয়াণে অন্য চোখে অশ্রু ঝরছে, জীবনভর যে পরিকল্পনা সাজিয়ে তুলেছে এক চিলতে সুখের জন্য, বিধবা স্ত্রী অথবা এতিম সন্তানের চোখের জলে তা ভেসে যাচ্ছে— এসবের মূল্যপতন ঘটছে ধীরে ধীরে আমাদের সমাজে। ‘যার চলে যায় সে বুঝে হায় বিচ্ছেদে কি যন্ত্রণা।’

এই যন্ত্রণা যত বেশি যত দ্রুত আমরা জাতিগতভাবে উপলব্ধি করতে পারব এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী সর্বোত্তম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারব ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমরা নিজেরা যদি দুর্ঘটনা রোধে সচেতন না হই তাহলে সরকার অথবা সরকারি প্রতিষ্ঠান হাজার চেষ্টা করেও এই অজস্র প্রাণহানি রোধ করতে পারবে না।

পূর্ববর্তি সংবাদউৎসর্গিত আশেকের পাশে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মহীরূহ
পরবর্তি সংবাদগড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিরোধী সমাবেশের সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ!