গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিরোধী সমাবেশের সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ!

আবরার আবদুল্লাহ ।।

আজ ২৮ মার্চ। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন আন্দোলনের সঙ্গে দিনটি বিশেষভাবে যুক্ত। ১৯১২ সালের এই দিনে কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে জনসমাবেশ করে কলকাতার অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায়। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও রাসবিহারী ঘোষের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাবেশে হিন্দু নেতারা পূর্ববঙ্গের মানুষদের রাখাল ও চাষা সম্বোধন করে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্তকে বাস্তবতা বিবর্জিত বলে আখ্যায়িত করেন। তারা প্রস্তাবিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’কে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় নামে কটাক্ষ করে তা ইংরেজ সরকারের জন্য বুমেরাং হবে বলেও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

অবশ্য কলকাতার গড়ের মাঠের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী সমাবেশে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বের বিষয়টি দীর্ঘদিন তর্কহীন থাকার পর ফিলহাল বরীন্দ্রপ্রেমীরা তা অস্বীকার করতে আরম্ভ করেছেন। তাদের দাবি, রবীন্দ্রনাথ সেই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেননি। এমনকি সেদিন তিনি কলকাতায় উপস্থিতও ছিলেন না।

এসব বরীন্দ্রপ্রেমী বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্রনাথের ‘কটাক্ষ বাক্য’ পূর্ববঙ্গের ‘মানুষ রাখাল ও চাষা’-এর সমর্থন করে অবশ্য বলছেন, বরীন্দ্রনাথ ঠিক বলেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হোক এবং পূর্ববঙ্গে সরকার প্রাথমিক শিক্ষায় মনোযোগী হোক। কারণ, এতে উভয় শ্রেণি উপকৃত হতো। তবে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা, বিবৃতি ও চিঠিপত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা পাওয়া গেলেও পূর্ববঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের কোনো সুপারিশ পাওয়া যায় না। বরং পাওয়া যায়, পূর্ব বঙ্গের মানুষের প্রতি তার সীমাহীন অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের বর্ণনা।

নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার ‘দি অটোবায়োগ্রাফি অব এন আননোন ইন্ডিয়ান’ বইতে লিখেছেন, ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দুরা প্রতিবাদ সভা ডাকে। প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারণ তিনি ছিলেন জমিদার। তিনি মুসলমান প্রজাদের মনে করতেন লাইভ স্টক বা গৃহপালিত পশু।

‘একশ বছরের রাজনীতি’ বইতে এই তথ্যের উল্লেখ আছে।

মূলত বঙ্গভঙ্গ রদ-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে, পূর্ববাংলার আশাহত, বিক্ষুব্ধ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সান্ত্বনা দিতে ও বিক্ষোভের মাত্রা প্রশমিত করতে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। তাই অনেকেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে  ব্রিটিশ সরকার বাধ্য ছিল।

ঢাকাকে রাজধানী করে বাংলা ও আসাম প্রদেশ নিয়ে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ‘বঙ্গভঙ্গ’ করে নতুন প্রদেশটি কার্যকর হয়। শিক্ষাদীক্ষাসহ সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য বঙ্গভঙ্গ তাদের প্রাণে আশার সঞ্চার করেছিল। তৎকালীন হিন্দু নেতাদের প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ বাতিলে বাধ্য হয়। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ ঘোষিত হয়।

এতে ক্ষুব্ধ হয় পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজ। পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ২৯ জানুয়ারি তিন দিনের এক সফরে ঢাকা আসেন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ ১৯ জন মুসলিম নেতার একটি প্রতিনিধিদল ৩১ জানুয়ারি গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ববাংলার মুসলমানরা সব দিক থেকে যে নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এ বিষয়টি জানিয়ে তারা আবার বঙ্গভঙ্গ চালুর দাবি জানান। না হয় এর ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কমপক্ষে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দাবি করেন তারা।

জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন : The Government of India realised that education was the true salvation of the Muslims and that the Government of India, as an earnest of their intentions, would recommend to the Secretary of State for the constitution of University of Dacca.

১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়ায় ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার জন্য ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দেয়। এতে আবারও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে হিন্দু নেতারা এবং এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে। ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত তাদের বিরোধিতার ধারা অব্যাহত থাকে।

১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯১২ তারিখে বড় লাটের সাথে বর্ধমানের স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিমণ্ডলী সাক্ষাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা না করার পক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তির জাল বিস্তার করেন। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তা হবে আভ্যন্তরীণ বঙ্গ বিভাগ-এর সমার্থক, তাছাড়া পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা প্রধানত কৃষক; তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তারা কোন মতেই উপকৃত হবে না।’ [Report of the Calcutta University Commission Vol. IV, Prt. II, P. 133]

এছাড়া হিন্দু সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন এবং সভার সিদ্ধান্তগুলো বৃটিশ সরকারের কাছে প্রেরণ করতে থাকেন। বাবু গিরিশ চন্দ্র ব্যানার্জী, ড. স্যার রাসবিহারী ঘোষ এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা বড় লাট হার্ডিঞ্জের কাছে ১৮ বার স্মারকলিপি পেশ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যত নিয়ে সংশয়পূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি লেখেন, ‘আমার নিশ্চয় বিশ্বাস, নিজেদের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রভৃতি উদযোগ লইয়া মুসলমানরা যে উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছে তাহার মধ্যে প্রতিযোগিতার ভাব যদি কিছু থাকে তবে সেটা স্থায়ী ও সত্য পদার্থ নহে। ইহার মধ্যে সত্য পদার্থ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি। মুসলমান নিজের প্রকৃতিতেই মহৎ হইয়া উঠিবে ইহাই মুসলমানের সত্য ইচ্ছা।  অতএব যাহারা স্বতন্ত্রভাবে হিন্দু বা মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে ভয় করেন তাহাদের ভয়ের কোন কারণ নাই এমন কথা বলিতে পারি না।’ [ প্রবন্ধ : পরিচয়, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; সৈয়্দ আব্দুল হালিম, বাঙ্গালী মুসলমানের উৎপত্তি ও বাঙ্গালী বিকাশের ধারা, খণ্ড-৩য়, পরাধীনতা ও প্রতিকার]

হিন্দু নেতাদের চরম বিরোধিতার মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণার বাস্তবায়নও বার বার হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু মুসলিম নেতারা হাল ধরে রাখেন। তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯১৭ সালের ২০ মার্চ সৈয়দ নওয়াব অলী চৌধুরী ভারতীয় আইনসভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন এবং অবিলম্বে ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিল’ পাসের দাবি জানান। আইনসভার পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিলের ‘খসড়া’ প্রস্তুত রয়েছে তবে যুদ্ধ সঙ্কটের মধ্যে সরকার এ বিলে হাত দিতে চান না। যুদ্ধশেষে য্থাসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। একই বছর ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়। উক্ত কমিশন পূর্বেকার ‘নাথান কমিশন’ রিপোর্ট অনুমোদন করে। এ রিপোর্টের ভিত্তিতে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্ট’ পাস হয়।

মজার বিষয় হলো, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন “মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়” বলে ব্যঙ্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে তাদের সংকোচ হয়নি। বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দু পণ্ডিৎগণ পরিচালকের আসনে সমাসীন হন।

যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, ঢাকার বুকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র পাঁচ বছর পর সে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই তিনি বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন এবং তারও দশ বছর পর তিনি সেখান থেকেই সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন।

তথ্যঋণ : প্রবন্ধ : মুহাম্মদ নূরে আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার সত্য-মিথ্যার ইতিহাস

পূর্ববর্তি সংবাদঘন ঘন অগ্নিকাণ্ড: জীবনের মূল্য কি কমছে?
পরবর্তি সংবাদএফআর টাওয়ার পরিদর্শনে যাবেন ড. কামাল হোসেন