এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার ছুটিতে হতে পারে দ্বীন শিক্ষার নানা আয়োজন

আতাউর রহমান খসরু ।।

দেশের মোট মুসলিম শিক্ষার্থীর ৯০ ভাগ বা তারও বেশি পড়ালেখা করে সাধারণ ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যারা প্রয়োজনীয় দ্বীনি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। পারিবারিক পরিমণ্ডলে এবং তাদের প্রচেষ্টায় কেউ কেউ কুরআন শরীফ দেখে দেখে পড়া শিখলেও দৈনন্দিন জীবনের অনেক প্রয়োজনীয় মাসায়েল তাদের শেখা হয় না কোনো দিন। ফলে ত্রুটি থেকে যায়, ঈমান-আকিদা ও ইবাদত-বন্দেগিতে।

বিপুল সংখ্যক মুসলিম শিক্ষার্থীর দ্বীনি শিক্ষার অভাব দূর করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে উলামায়ে কেরামের মধ্যে। এর মধ্যে রয়েছে, সময়ে সময়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের একত্র করে দ্বীনের গুরুত্ব বিষয়ে আলোচনা করা, ছুটির সময়ে সংক্ষিপ্ত কোর্সের ব্যবস্থা করা, নৈশ মাদরাসা ও বছরব্যাপী খণ্ডকালীন (সপ্তাহের যে কোনো ২/৩ দিন ২/৩ ঘণ্টার) দ্বীনি শিক্ষার কোর্স চালু করা। তবে এই উদ্যোগগুলোর প্রায় সব ক’টিই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে এবং তার বিস্তৃতিও ঘটেনি সেভাবে।

দেশের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ও শায়খ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতী মিযানুর রহমান সাঈদ মনে করেন, এই ধরনের উদ্যোগকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ, ইসলামি শিক্ষার দুটি স্তর। জরুরি স্তর এবং ঐচ্ছিক স্তর। জরুরি স্তর হলো, একজন মুসলমান মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা। এটা শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। ঐচ্ছিক স্তর হলো উচ্চ শিক্ষা। সেটা উম্মতের একটি দল অর্জন করলেই হয়।

তিনি মনে করেন, মুসলিম দেশে মুসলিশ শিশুদের প্রাথমিক স্তরের ফরজ পরিমাণ দ্বীনি শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব সরকারের। তাই তার প্রস্তাব হলো, আলেমদের দায়িত্ব জাতীয় পাঠ্য কারিকুলামে অন্তত ফরজ ইলমের অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাদের সামনে বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরা। প্রয়োজনে এই দাবি আদায়ের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।

তবে দাবি আদায় হওয়ার আগ পর্যন্ত উলামায়ে কেরাম নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্বীনি শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন বলে মত দেন মুফতী মিযানুর রহমান সাঈদ। পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অবকাশকালী সময়ে তাদেরকে দ্বীনি শিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ময়মনসিংহে দারুল উলুম নেজামিয়াতে এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন মাদরাসার পরিচালক মাওলানা আমিনুল হক। এসএসসি পরীক্ষা ২০১৯-এর পর প্রায় ৮৫ জন শিক্ষার্থী সেখানে ৪০ দিনের একটি কোর্স করছেন। এসএসসি, এইচএসসি ও জেএসসি পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীদের জন্য এমন কোর্সের আয়োজন করে থাকে নেজামিয়া মাদরাসা। ২০১০-১১ সাল থেকে সেখানে এমন কোর্স নিয়মিত হয়ে আসছে।

এই কোর্স চালু করার ইতিহাস তুলে ধরে মাওলানা আমিনুল হক বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্বীনি শিক্ষা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতাম। তাদেরকে কীভাবে দ্বীনি শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করা যায় বিষয়টি নিয়ে ভাবতাম। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী আমাদের কাছে এলেন কুরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত ও অতি প্রয়োজনীয় মাসয়ালা-মাসায়েল শেখার জন্য। তারা একবার আসার পর সুযোগ মতো বারবার আসতে লাগলেন। তাদের আগ্রহ-উদ্দীপনা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ করে দেয়।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য মাদরাসার বর্তমান আয়োজনের বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, এসএসসি ও জেএসসি -এই দুইটাই মূল। এছাড়াও মেডিকেল ও পলিটেকনিক্যাল ইনিস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা সারা বছরই তাদের ক্লাসের শেষে বা সুযোগ মতো দুয়েক ঘণ্টা করে শিখছে। সারা বছরের কোর্স আছে আমাদের।

মাওলানা আমিনুল হক দুঃখ করে বলেন, দেশের সর্বত্র দ্বীন শেখার এমন ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই শিখতে পারছেন না। সুযোগটা সব জায়গায় থাকলে তারা অনেক বেশি উপকৃত হতে পারতো। কারণ, এখানে পড়তে এসে অনেকেই দ্বীনি শিক্ষার প্রতি আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা তখন মাদরাসা ছেড়ে যেতে চায় না।

কিন্তু দেশের সবখানে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য দ্বীন শেখার ব্যবস্থা কে করবে? মুফতী মিযানুর রহমান সাঈদের পরামর্শ হলো, প্রত্যেকটা থানা-উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের প্রধান প্রধান মাদরাসাগুলো এই উদ্যোগ নিতে পারে। তারা স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের ছুটির সময়ে এবং সাধারণ সময়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দ্বীনি শিক্ষার কোর্স চালু করতে পারে।

তিনি বলেন, কয়েকদিন পূর্বে ঢাকার এক মাদরাসায় খতমে বোখারিতে গেলাম। সেখানে দেখলাম এসএসসি পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা ৩০ দিনের একটি কোর্স করছে। কোর্সে তাদেরকে কুরআন শরীফ ও প্রয়োজনীয় দোয়া মাসায়েল শেখানো হচ্ছে। আমি মনে করি, এমন উদ্যোগ মাদরাসায় মাদরাসায় হওয়া দরকার। বিশেষত একটু বড় মাদরাসা –যাদের সামর্থ্য ও দক্ষতা বেশি, কাজের সুযোগ বেশি- তারা বিভিন্ন সময় এলাকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের দ্বীনি শিক্ষার উদ্যোগ নিতে পারেন। এটা জরুরিও।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সংক্ষিপ্ত সময়ে প্রয়োজনীয় দ্বীনি শিক্ষা নিশ্চিত করতে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন? মাওলানা আমিনুল হক বলেন, আমরা কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়। তাহলো, কুরআনুল কারিমের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত, ঈমানি তরবিয়্যাত, আমলি তরবিয়্যাত ও আখলাকি তরবিয়্যাত। কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে যার যেখান থেকে ত্রুটি সেখান থেকেই আমরা শুরু করি। সবাইকে এক জায়গা থেকে শুরু করা হয় না। চল্লিশ দিনের কোর্সে অবশ্য এক সাথে শুরু করা হয়।

তিনি এই সংক্ষিপ্ত সময়ের শিক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের যে পরিবর্তন আনে তা তুলে ধরে বলেন, এখানে যতোদিন বা যতোটুকু সময় থাকে তখন পরিবর্তন অনেক বেশি মনে হয়। কিন্তু এখান থেকে যাওয়ার পর অনেকেই পরিবর্তন ধরে রাখতে পারে না। আবার অনেকেই তাবলিগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দ্বীনের উপর চলা শেখে। আমরাও তাদের সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক কোনো যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি না। পারলে হয়তো আরও বেশি ফলাফল পাওয়া যেতো।

এই পরিবর্তন ও প্রভাবের বাইরে সুদূর প্রসারী আরেকটি প্রভাবের কথাও বলেন মাওলানা আমিনুল হক। তিনি আশা করেন, যদি শিক্ষার্থীদের জন্য ছোট ছোট আয়োজনের মধ্য দিয়ে হলেও দ্বীনের প্রয়োজনীয় ঈমানি ও আমলি শিক্ষা দেওয়া যায় তবে ভবিষ্যতে এর সুফল পাওয়া যাবে। তার ভাষায় সেটা হলো, তারা হয়তো পুরোপুরি দ্বীন মেনে চলতে পারবে না। কিন্তু যদি তাদের ঈমান-ইবাদত ঠিক হয়ে যায়, তাহলে দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব তো পড়বেই। আশা করা যায়, তারা ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে না। দ্বীনি কাজের বিরোধিতা করবে না।

আর যদি এসব সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের প্রতি উলামায়ে কেরাম মনোযোগ না দেন তবে তার পরিণতি কী হতে পারে সে ব্যাপারে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ। তিনি বলেন, উদ্যোগ না নিলে মুসলমানের সন্তানরা ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাবে। আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্যের পথ ভুলে যাবে। এক সময় নাম ছাড়া তাদের মধ্যে ইসলামের আর কিছুই বাকি থাকবে না। মুসলিম হয়ে এক সময় তারাই ইসলামের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

পূর্ববর্তি সংবাদমনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে, শরীরের যত্ন নেবে: কিশোরদেরকে প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তি সংবাদটেকনাফে যুবকের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ উদ্ধার