বাড়ছে হেজবুত তওহীদের তৎপরতা, সচেতন মহলে উদ্বেগ

আতাউর রহমান খসরু ।।

২০০৮-০৯ সালের কথা। ঢাকার রাস্তাঘাটে ও গণপরিবহনে হঠাৎ একটি বই ও সিডি বিক্রি শুরু হলো। বই ও সিডির অভিন্ন নাম। তাহলো, ‘দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা!’। বইটি প্রচার পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তা উলামায়ে কেরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারণ, এই বইটিতে দাজ্জাল সম্পর্কে চরম বিভ্রান্তিমূলক কথা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দাজ্জাল নামে কোনো ব্যক্তির আবির্ভাব হবে না। ইহুদি-খ্রিস্টানদের লালিত পশ্চিমা সভ্যতাই দাজ্জাল। অসংখ্য সহি হাদিসের বিরোধী একটি বক্তব্য এটি। তখন উলামায়ে কেরাম নিজ নিজ অবস্থান থেকে তার ব্যাখ্যা ও প্রতিবাদ করেন। এরপর উলামায়ে কেরাম বারবার সংগঠনটির ব্যাপারে জনগণ সচেতন করে আসছেন এবং প্রশাসনকেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন।

আলোচিত সেই বই ও সিডির সাথে সাথে ‘হেজবুত তওহীদ’ নামক সংগঠনের নামও মানুষের চোখের সামনে আসে। আলোচিত দাজ্জাল বইয়ের লেখক বায়েজীদ খান পন্নী এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এবং তার কর্মীরাই বইটির প্রচারের কাজ করছিলো। কিছুদিন পর গণপরিবহনে বইটির বিক্রি থেমে যায় এবং হেজবুত তওহীদও মানুষের আলোচনার আড়ালে চলে যায়।

কিন্তু তাই বলে থেমে নেই এই বিভ্রান্ত সংগঠনের কার্যক্রম। প্রকাশ্য কর্মসূচির পাশাপাশি সাজামিক মাধ্যম, ইউটিউব ও ‘বজ্রকণ্ঠ’ পত্রিকাসহ একাধিক প্রচার মাধ্যমে নিজেদের মতবাদ প্রচার করে যাচ্ছে সংগঠনটি। ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচার মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে সহজেই ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও মতবাদ। সরলমনা এবং দ্বীনি শিক্ষা-বঞ্চিত বহু সাধারণ মুসলমান তাদের অপপ্রচারে শিকার হয়ে ঈমানহারা হচ্ছে। ভ্রান্ত এই সংগঠনের খপ্পরে পড়ে ঘর-সংসার ত্যাগ করে চলে যেতেও শোনা যাচ্ছে অনেক নারীকে।

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে তাদের একাধিক পেইজ ও গ্রুপ রয়েছে এবং ইউটিউবে রয়েছে বেশ কয়েক চ্যানেল। এসব পেইজ ও চ্যানেলে তারা হেজবুত তওহীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্লিপস প্রচার করে থাকে। এর মধ্যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বায়েজীদ খান পন্নী ও বর্তমান ‘এমাম’ হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম-এর বক্তব্যের ভিডিও-ই বেশি।

ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রচার মাধ্যমে পাওয়া বেশ কিছু ভিডিও ক্লিপসে হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমকে বিভ্রান্তিকর ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় কথা বলতে দেখা যায়। তিনি তার বক্তব্যে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও আকিদার বিরুদ্ধে যেমন লাগামহীন ভাষায় কথা বলেন, তেমনই বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে থাকেন। হেজবুত তওহীদের সাংগঠনিক কার্যক্রমেও ‘উগ্রপন্থা’ অনুসরণের অভিযোগ পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমেও এই বিষয়ে একাধিক সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে।

১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠার মাত্র ৬ বছরের মাথায় ২০০১ সালেই তাদের সামগ্রিক কার্যক্রম ও বিভ্রান্তিকর কর্মকাণ্ডের জন্য হেজবুত তওহীদকে কালো তালিকাভূক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারের পক্ষ থেকেও সংগঠনের কার্যক্রমের উপর গোয়েন্দা নজরদারির কথা জানানো হয়েছে বারবার। অভিযোগ রয়েছে, তারা বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙ্গে তারা তাদের ‘প্রস্তাবিত কাঠামো’ গঠনে কর্মীদের উদ্দীপ্ত করেন। কর্মীদের বলা হয়, মহাবিপর্যয়ের পূর্বেই এই কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুবা এই দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে ভীতি সঞ্চার করা হয় কর্মী ও অনুসারীদের মনে।

তবে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন হলো, গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যেও সংগঠনটি তার ইসলাম ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ তৎপরতা কীভাবে চালিয়ে যাচ্ছে? সুস্পষ্ট অভিযোগ ও তাদের বক্তব্য-প্রকাশনায় অসংখ্য রাষ্ট্রবিরোধী উপাদান থাকার পাওয়ার পরও ১৮ বছরে কেন তা নিষিদ্ধ হলো না? বিশেষত অনলাইন প্রচার মাধ্যমের উপর সরকারের কঠোর নজরদারির পরও তারা সেখানে কীভাবে তাদের ইসলাম ও রাষ্ট্রবিরোধী মতবাদ প্রচারের সুযোগ চাচ্ছে চরমপন্থী এই সংগঠনটি?

হেজবুত তওহীদ-এর অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, তাদের প্রয়াত নেতা বায়েজীদ খান পন্নী এই যুগের ‘এমাম’ এবং ২০০৮ স্বয়ং আল্লাহ তাকে এই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ) তারা নিজেদের ব্যতীত সাধারণভাবে বাকি সকল মুসলমানকে বিভ্রান্ত মনে করে। তাদের ভাষায় পৃথিবীর সব মুসলিম এখন বিকৃত, বিভ্রান্ত ও বিচ্যূত ইসলামের অনুসরণ করছে। সুতরাং তারা সবাই ঈমানহারা।

অন্যান্য বিভ্রান্ত সংগঠন ও দলগুলোর মতোই উলামায়ে কেরামের প্রতি চরম বিদ্বেষের মাধ্যমেই এই সংগঠনের দীক্ষা নেন কর্মীরা। তাদের কর্মীদের বোঝানো হয়, আলেমরাই সকল সমস্যার মূল। তাদের হাত থেকে ‘এসলাম’-কে রক্ষা করতে হেজবুত তওহীদের এমামের হাতে বাইআত গ্রহণ করতে হবে।

এছাড়াও তারা ইসলামের নামাজ, যাকাত, হজ্জ ও পর্দার বিধানের চিরায়ত রূপরেখাকে অস্বীকার করে থাকে। তাদের ভাষায় সামাজিক ব্যবস্থার নামই দ্বীন। সুতরাং দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের আনুগত্য অপরিহার্য নয়। আর ঈমান ছাড়া আর কোনো কিছুর ব্যাপারেই পরকালে জবাবদিহি করতে হবে না।

সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে পাওয়া এক ভিডিও ক্লিপে হেজবুত তওহীদের বর্তমান এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা শুধু তওহীদের পথে আসুন এরপর যতো ইচ্ছা পাপ করুন। আল্লাহ মাফ করে দিবেন। এই হেজবুত তওহীদই সিরাতে মুস্তাকিম। আপনারা এই পথে চলুন আমি আপনাদের জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’

হেজবুত তওহীদের ইসলাম ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে দিনদিন উদ্বেগ বাড়ছে দেশের সচেতন নাগরিক ও দ্বীনপ্রাণ মুসলমানের। তারা মনে করেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে কালো তালিকাভূক্ত এই সংগঠনের কার্যক্রমের উপর এখনই লাগাম টেনে ধরা দরকার। নতুবা দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষই শুধু ঈমানহারা হবে না; বরং দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে সংগঠনটি।

জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া-এর মুহাদ্দিস ও রিসালাতুল ইসলামিয়া বিডি-এর সমন্বয়ক মাওলানা তহমীদুল মাওলা মনে করেন, এই বিষয়ে সরকারের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সাথে সাথে উলামায়ে কেরামেরও উচিৎ এই বিষয়ে আরও বেশি সোচ্চার হওয়া। কারণ, আমার মনে হয়, বহু সাধারণ মানুষ তাদের ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা রাখে না।

তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমে হেজবুত তওহীদের ব্যাপারে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন ও রিপোর্টে তাদের যে প্রবণতা প্রকাশ পায় তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমাদের দৃষ্টি তাদের কয়েকটি ভিডিও পড়েছে। সেখানে প্রতারণামূলক বেশ কিছু উপাদান রয়েছে। যেমন, অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াই’। অথচ তাদের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থার অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের। একইভাবে সেখানে কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টিও চোখে পড়ার মতো।

মাওলানা তাহমীদুল মাওলা প্রস্তাব করেন, উলামায়ে কেরাম যেন তাদের ব্যাপারে জনগণকে আরও বেশি আহবান জানান এবং প্রতিনিধিত্বশীল আলেমরা যেন তাদের শরয়ি স্খলন, বিভ্রান্তি ও বিকৃতি বিষয়ে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কাছে প্রমাণাদি তুলে ধরেন। যাতে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হন।

পূর্ববর্তি সংবাদনিউজিল্যান্ড ভ্রমণে বাংলাদেশিদের সতর্ক হতে বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পরবর্তি সংবাদসৌদি সরকারের হজ বিষয়ক সচিব ঢাকায় আসছেন ৬ এপ্রিল