বস্তিবাসী শিশুদের মাঝে কুরআনের শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব : কী বলেন বিশিষ্ট আলেমরা?

আতাউর রহমান খসরু ।।

এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের শহুরে অধিবাসীদের প্রায় ৫৫ শতাংশই বস্তিবাসী। ২০১৭ সালে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, শুধু রাজধানী ও তার আশপাশের অঞ্চলের বস্তিগুলোতে বাস করে ৪০ লাখ মানুষ। বস্তিতে বসবাসকারী এই বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের নাগরিক জীবনের ন্যূনতম সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অশিক্ষার মধ্যেই বড় হচ্ছে তাদের শিশুরা।

বস্তিবাসীর জাগতিক জীবনের উন্নয়নে সরকার ও কিছু বেসরকারি সংস্থা উদ্যোগী হলেও এসব শিশুদের মাঝে পবিত্র কুরআন ও দ্বীনি শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাচ্ছে অনেকের। ফলে জাগতিক জীবনের অনেক অধিকারের মতো দ্বীনি শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মুসলিম শিশু।

সুবিধাবঞ্চিত এসব মুসলিম শিশুদের বিষয়ে কথা বলি বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সহকারী মহাসচিব ও জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হকের সঙ্গে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বিষয়টি কি উলামায়ে কেরামের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে? উত্তরে বলেন, বস্তির শিশুদের দ্বীনি শিক্ষার বিষয়টি আলেমদের পুরোপুরি দৃষ্টির বাইরে -এটা আমি মনে করি না। কারণ, বস্তি এলাকায় আল-হামদুলিল্লাহ! মাদরাসা-মক্তব গড়ে উঠছে। সেখানে দ্বীনি শিক্ষা প্রসারের চেষ্টা চলছে। বিশেষত মোহাম্মদপুরের বস্তি এলাকায় বেশকিছু মাদরাসা রয়েছে বলে আমি জানি। তারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও শিশুদের দ্বীনি শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।

জামিয়াতুস সুন্নাহ, শিবচরের প্রিন্সিপাল মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ ফরিদী মনে করেন বস্তিবাসীর ভেতর কিছু কাজ হলেও তা বিক্ষিপ্তভাবে হচ্ছে। সম্মিলিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগ না থাকায় প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন কোনো নির্দিষ্ট সংস্থার উদ্যোগে সারাদেশে গোছালোভাবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দ্বীনি শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়া দরকার।

তিনি প্রস্তাব করে বলেন, হাইয়াতুল উলয়া কওমি শিক্ষাব্যবস্থার অভিভাবক হিসেবে এমন একটা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে পারে। যাতে আমরা মুসলিম শিশুদের দ্বীনি শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারি। যদি হাইয়াতুল উলয়া উদ্যোগ নেয় এবং নিয়ম করে, প্রত্যেক ওয়ার্ডে অন্তত একটি কুরআনি মক্তব প্রতিষ্ঠা করতে হবে সম্মিলিত উদ্যোগে। তাহলে যে অভাবটুকু আছে তাও হয়তো থাকতো না।

অন্যদিকে সারা দেশে যারা বিক্ষিপ্তভাবে সুবিধা বঞ্চিত ও বস্তিবাসী শিশুদের জন্য দ্বীনি শিক্ষা প্রদানের কাজ করছেন তাদের প্রতি ধন্যবাদজ্ঞাপন করে মাওলানা মাহফুজুল হক তরুণদেরকে এগিয়ে আসার আহবান করেন।

তিনি বলেন, যারা এজাতীয় কাজ করছেন তারা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আমাদের দায়িত্ব তাদেরকে মানসিক ও আর্থিক সমর্থন প্রদান করা। নবীনদেরকে এই সেক্টরে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা। কারণ, তরুণরা চ্যালেঞ্জটা নিতে জানে।

মিরপুর পল্লবীতে এমনই একজন তরুণ আলেমের কথা জানতে পেরেছ ইসলাম টাইমস। মুফতি হাবিবুর রহমান নামের এই তরুণ ২০১১ সাল থেকে বস্তিবাসী শিশুদের দ্বীনি শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠিত আল মঈন ফাউন্ডেশনের অধীনে একটি মাদরাসা ও রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে ৬৮টি মক্তব পরিচালিত হচ্ছে বলে তিনি জানান। মুফতি হাবিবুর রহমানের দাবি, এসব মক্তবে গড়ে ৪০জন করে শিশু দ্বীনি শিক্ষা লাভ করছে।

তবে মুফতি হাবিবুর রহমান তার কাজের ক্ষেত্রে দুটি বাধার কথা বলেন, এক. তাদের পরিচালিত মক্তবের বিপরীতে এনজিওদের পরিচালিত স্কুলের আয়োজনটা আরও বড় এবং সেখানে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।

দুই. কখনও কখনও বস্তিতে কোনো মসজিদ না থাকায় পার্শ্ববর্তী কোনো মসজিদের বারান্দায় মক্তব পরিচালনা করার প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে শিশুরা মসজিদ নোংরা করে ফেলে-এমন অভিযোগে অনুমতি দিতে চান না অনেক মসজিদের কমিটি।

এই দুটি সমস্যা নিয়ে কথা বলি এই দুই আলেমের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে মাওলানা মাহফুজুল হকের পরামর্শ হলো, মুসলমানের ভেতর যারা বিত্তশালী এবং দ্বীনদার তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। যেন এনজিওগুলোর সমান না হলেও কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায়। শিশুদের অভিভাবকদেরও বোঝানো দরকার। যেন তারা দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব বোঝেন এবং জাগতিক লাভ-ক্ষতির উপর দ্বীনকে প্রাধান্য দেন। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, ইসলাম পছন্দ করে না এমন প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চার ভাগের এক ভাগও সুবিধাও দিতে পারলে মানুষ দ্বীনি প্রতিষ্ঠানকেই বেছে নেয়। কারণ, ইসলাম, দ্বীন ও কুরআনের একটি আকর্ষণ আছে।

মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে বস্তির শিশুদের মসজিদে এসে শিক্ষা গ্রহণে বাধা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তাদের বুঝের অভাব। শিশুরা এলে মসজিদের পরিবেশে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। কিন্তু শিশুদের দ্বীনি শিক্ষা প্রদান করা তো মুসলমানের সামাজিক দায়িত্বও। ইসলামের সূচনাকাল থেকেই যে দ্বীনি শিক্ষা মসজিদ কেন্দ্রিক ছিলো সেটাও আমাদের জোরালোভাবে তুলে ধরা দরকার।

সামগ্রিক সমস্যার সমাধানে মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ ফরিদী সম্মিলিত উদ্যোগের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, হাইয়াতুল উলয়া বা শিক্ষাবোর্ডগুলো উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে যেসব বাধার মুখোমুখি হচ্ছে তা দূর করা সহজ হবে।

সম্মিলিত উদ্যোগের আগ পর্যন্ত সুবিধাবঞ্চিত ও বস্তিবাসী শিশুদের জন্য যারা কাজ করছে তাদের প্রতি তার পরামর্শ হলো, তারা জাতীয় পর্যায়ের মুরব্বি আলেমদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন এবং জাতীয় নেতৃত্ব দানকারী আলেমরা এমন উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে পারেন। সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবেন। সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিলে এবং মুরব্বিরা উৎসাহিত করলে মসজিদ পরিচালনা কমিটি বাধাদানকারী থেকে উদ্যোক্তায় পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ!

মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ ফরিদী শিশুর কুরআনি শিক্ষা নিশ্চিত করতে একটি সামাজিক আন্দোলনেরও প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, আমার মনে হয়, শতভাগ কুরআনি শিক্ষা নিশ্চিত করতে জাতীয় ও সামাজিক আন্দোলন শুরু করা যেতে পারে। হজরত হাফেজ্জি হুজুর রহ.-এর ভাষায় তাহলো, ‘৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ কুরআনি মক্তব প্রতিষ্ঠা’। এই জাতীয় ও সামাজিক আন্দোলনের একটি দাবি হতে পারে ফজরের পরের দুই ঘণ্টা কুরআনি মক্তব চলবে সারা দেশে। এই সময় অন্য কোনো শিক্ষা কার্যক্রম চলতে পারবে না।

প্রস্তাবিত সামাজিক আন্দোলনের পেছনে তার যুক্তি হলো, মুসলিম শিশুদের শতভাগ দ্বীনি শিক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের দ্বীনি দায়িত্ব। শিশুদের ধর্মীয় ও সাংবিধানিক অধিকার। এই দিকে নজর না দিলে ভবিষ্যত প্রজন্ম ধর্মহীন হয়ে যাবে।

যারা মাদরাসায় আসে এবং যারা আসে না সবার জন্য দ্বীনি শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে কুরআনের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সবাহি (সকালের) মক্তবের প্রভাব অনেক বেশি। আজও বাংলাদেশের মানুষ যে ধর্মপ্রাণ হিসেবে পরিচিত আমার মনে হয়, এর পেছনে সকালের মক্তবব্যবস্থার জোরালো ভূমিকা রয়েছে।

আর এসব শিশুদের কুরআনি শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে কী ক্ষতি হবে তা উঠে আসে মাওলানা মাহফুজুল হকের বক্তব্যে।

তিনি বলেন, কুরআনি শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে মুসলমানের সন্তান দ্বীনহীন অবস্থায় বেড়ে ওঠায় সামগ্রিকভাবে দ্বীনি ক্ষতি তো হবেই। দ্বীনি শিক্ষা, সুন্দর পরিবেশ এবং নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তারা দেশ ও সমাজের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। এ কারণেই বর্তমানে নগর জীবনের অনেক অপরাধমূলক কাজের পেছনে এই শ্রেণির ছেলে-মেয়ের অংশগ্রহণ দেখা যায়।

তবে যারা বস্তিবাসী ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করছেন তাদের প্রতি এই দুই আলেমের পরামর্শ হলো, তাদের ফরজিয়্যাতের জ্ঞান নিশ্চিত করা। সাথে সাথে মানসিক বিকাশে মনোযোগী হওয়া। যেন এসব শিশুরা হীনমন্যতা কাটিয়ে এবং সুন্দর তাকওয়াপূর্ণ জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারে। তারা জীবনের সকল হতাশার মধ্যেও নৈতিকতার জায়গায় অটুট থাকতে পারে।

পূর্ববর্তি সংবাদআফগান নিরাপত্তাবাহিনীর উপর তালেবানের হামলা, নিহত ১৩
পরবর্তি সংবাদআমরা এমন সব কাজ করেছি যেগুলো ঠিক না: ইসি রফিক