রাজনীতিতে ‘ইসলাম-বিদ্বেষ’ ইস্যু : পেছনে কার কী স্বার্থ?

শরীফ মুহাম্মদ ।।

রাজনীতিকদের একটি অংশের মধ্যে ইসলামি ইস্যু নিয়ে নাক সিঁটকানোর ঘটনা নতুন নয়। আগেও অনেকবার এ জাতীয় ঘটনা ঘটেছে। বেশ কিছু দিন পরিস্থিতি শান্ত থাকার পর আবার শুরু হয়েছে এমন ‘বিদ্বেষ’ ইস্যুর ঘনঘটা। নতুন করে এ জাতীয় উৎপাত শুরুর পেছনে কার কী স্বার্থ কাজ করছে- অনেকের ভেতরেই সেটা নিয়ে কৌতূহল দানা বাঁধছে।

গত ৩ মার্চ জাতীয় সংসদে ওয়াকার্স পার্টি নামের একটি বামদলের নেতা রাশেদ খান মেনন এমপি ইসলামি শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে নতুন করে ‘বিদ্বেষী’ উৎপাতের ঘটনা ঘটান। কাদিয়ানিদের পক্ষে কথা বলে সে বক্তব্যে বিষোদগারের ষোলকলা পূর্ণ করেন তিনি। এ নিয়ে পরের দিন থেকেই অবশ্য আলেম-ওলামাদের বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদে নেমে পড়ে। রাজপথ ও মিডিয়ায় এখন ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য, বক্তব্যের আক্রমণাত্মক সাফাই এবং এ জাতীয় বক্তব্যের প্রতিবাদের ভাষায় কিছুটা মুখর। এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির এমপি কাজী ফিরোজ রশিদ সংসদে দাঁড়িয়ে মেননের নাম উচ্চারণ না করে এক প্রতিবাদী বক্তব্য দিয়ে দেশবাসীর নজর কেড়েছেন। তিনি মেননের বক্তব্যের এক্সপাঞ্জও দাবি করেছেন।

ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্যের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে চলে আসে দেশের বামদলগুলোর কথা। তারপর আসে বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগের কোনো কোনো অতি-উৎসাহী নেতার অনিয়ন্ত্রিত কথাচার প্রসঙ্গ। প্রায় ৩০ বছরের রাজনীতিতে এমন চিত্র বারবার দেখা গেছে। ইদানীং অবশ্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে ইসলামি ইস্যুতে অনিয়ন্ত্রিত বাক্যাচারে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের আলমত মাঝে-মধ্যেই চোখে পড়ে। কিন্তু তাদের সহযোগী বাম দলের নেতারা তাদের বিদ্বেষী বক্তব্যের ধারাবাহিকতার স্রোতটা থামাতে প্রস্তুত হচ্ছেন না। সাধারণ মূল্যায়নে এরও কিছু দায় গিয়ে পড়ছে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ওপর।

অনেকেই মনে করেন, মন্ত্রিত্বের কক্ষচ্যুত ভোটশূন্য বাম নেতারা হঠাৎ করে জাতে ওঠার জন্য নতুন চেষ্টার অংশ হিসেবে এ জাতীয় বিষোদগারের পথে হাঁটার অনুশীলনটা আবার ঝালাই করতে নেমেছেন। প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশের সুনজর ও পুঁজিবাদী পশ্চিমা কূটনীতিকদের পিঠ চাপড়ানি ছাড়া বাম রাজনীতির এখন দিন চলে না। আসন, প্রভাব, মন্ত্রিত্ব আর আন্তর্জাতিক হালুয়া-রুটির প্রতি ধাবমানতাই তাদেরকে এ জাতীয় ‘শর্টকার্ট’ বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করছে।

‘তেঁতুল হুজুর’ বলে আল্লামা আহমদ শফীকে খোঁচানো আর কওমি আলেমদের কর্মপ্রয়াসকে ‘মোল্লাতন্ত্র’ নাম দিয়ে নতুন বিদ্বেষী রাজনীতির পিচ্ছিল জমিন তৈরির চেষ্টাটা তাই তারা ছাড়তে চান না। এতে তাদের অনেক লাভযোগের ব্যাপার জড়িয়ে আছে বলে মনে করা হয়। তারা যে বাম রাজনীতি করছেন আবার রাজনীতির চালে মন্ত্রিত্বের বাইরে ছিটকে পড়েছেন- এর জন্য একটা ইমেজ-উদ্ধার প্রকল্পও তো তাদের দরকার। এ জন্য বিদ্বেষ চর্চার চেয়ে সহজ-সংক্ষিপ্ত গলিপথ তাদের সামনে আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তারা হয়তো সেই গলিপথেই এখন হেঁটে চলেছেন।

এর মধ্যে সরকারি দলের নতুন একজন মন্ত্রী একই কায়দা রপ্ত করার পথে নেমেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত মাসে পঞ্চগড়ে কাদিয়ানিদের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে তিনি তার চেহারা কিছুটা খুলেছেন। আর গত ৮ মার্চ নারী দিবসের অনুষ্ঠানে হিজাব-বোরকার বিরুদ্ধে কথা বলে মনে হলো, ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্যের ময়দানে তিনি ভালো করেই হাত পাকাতে চাচ্ছেন। দলের কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং যে দিকেই ধরা থাকুক- তিনি নিজের ইমেজে ‘বিদ্বেষের’ একটা প্রলেপ বসিয়ে হয়তো রাজনীতির বাইরের ‘রাজনীতিকেন্দ্রগুলোর’ নজরে পড়তে চাচ্ছেন।

কওমি সনদ, শোকরানা মাহফিল, হেফাজত ও সরকারের মধ্যকার দৃশ্যমান দূরত্ব হ্রাসের পর রাজনীতির ময়দানে ইসলামি ইস্যু নিয়ে বিদ্বেষ-বিরোধিতার বড় কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এক ধরনের না ধরি-না ছুঁই অবস্থা চলছিল। আপাত শান্ত এ পরিস্থিতির মধ্যেই বামনেতা মেনন আর সরকারের এক মন্ত্রীর ‘বিদ্বেষী’ বক্তব্যের মধ্যে অনেকে নতুন করে রাজনতিতে কোনো বাঁকবদলের গন্ধও খুঁজে পাচ্ছেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে মৌলবাদ বান্ধবের ‘দুর্গন্ধ’ ঝেড়ে ফেলার কোনো গরজ কি সরকারের কোনো কোনো স্তরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে কি না-এ প্রশ্ন জেগেছে অনেকের মনে। আবার নতুন করে উঁচু আওয়াজের ‘সেকুলারিজমের’ ছকে ধরে মৌলবাদ-পাল্টা মৌলবাদের কোনো ‘গরম ক্ষেত্র’ রচনার প্লট কি তৈরি হচ্ছে? পশ্চিমা দেশ ও প্রতিবেশী দেশের বিশেষ সুনজর পেতেই কি সংসদের ভেতরে-বাইরে নানান রকম বিদ্বেষের চর্চা শুরু হয়েছে?

উপরের অনুমান ও প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেতে হয়তো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে শান্তিপ্রয়াসী দায়িত্বশীল নেতৃত্বের জন্য উচিত হবে- রাজনীতির নতুন-পুরনো সব মতলবী প্রবণতা পরখ করতে চেষ্টা করা। অস্তিত্ব, প্রতিবাদ, আত্মরক্ষা ও শান্তির সব কটি মাইলপোস্ট সামনে রেখে মেপে মেপে রাস্তায় কদম ফেলা।

পূর্ববর্তি সংবাদছাত্রলীগের বিরুদ্ধে জালভোট ও কারচুপির অভিযোগে উত্তাল ঢাবি
পরবর্তি সংবাদগৌরনদীতে গণধর্ষণের অভিযোগে দুই কলেজ ছাত্র গ্রেফতার