পথেঘাটে মাদরাসা-মসজিদের নামে ভিক্ষাসদৃশ চাঁদা : যা বললেন বিশিষ্ট আলেমরা

আতাউর রহমান খসরু ।।

শহরের গণপরিবহনে প্রায় সময়ই এক শ্রেণির দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষ দেখা যায় যারা রশিদবই হাতে নিয়ে মাদরাসা-মসজিদের নামে টাকা সংগ্রহ করেন। হাতে রশিদ থাকলেও অধিকাংশ সময় তারা দাতাকে রশিদ বুঝিয়ে দেন না। আবার রশিদ সংগ্রহ করে দেখা যায় তাতে লেখা আছে ঢাকার পার্শ্ববর্তী বা অন্য কোনো জেলার কোনো মাদরাসা-মসজিদের নাম। রশিদে প্রদত্ত মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়ারও অভিযোগ আছে মানুষের।

একইভাবে নির্মাণাধীন অনেক মসজিদের পাশে মাসের পর মাস মাইক বাজিয়ে টাকা তুলতে দেখা যায়। এসব কাজে ব্যবহার করা হয় অনেক নাবালেগ শিশুদেরও। ভিক্ষা-সদৃশ এই অর্থ কালেকশনের কারণে বার বার বিব্রত হতে হয় দ্বীনদার শ্রেণি ও আলেম-উলামাদের। ইদানীং সামাজিক মাধ্যমে এভাবে অর্থ সংগ্রহের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ ও বিরূপ মন্তব্য করতেও দেখা যাচ্ছে অনেককে।

এভাবে অর্থ উপার্জন করার বিধান জানতে চেয়েছিলাম দেশের শীর্ষ আলেম ও মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্সের মহাপরিচালক মুফতি দিলাওয়ার হোসাইনের কাছে। তিনি বলেন, এভাবে অর্থ সংগ্রহ করা ইসলামও পছন্দ করে না, উলামায়ে কেরামও বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেন না। এভাবে অর্থ সংগ্রহ করে মাদরাসা চালাতে হবে, মসজিদ চালাতে হবে সেই দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দেননি। এতে মসজিদ-মাদরাসা ও ধর্মপ্রাণ মানুষের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

দেশের অপর শীর্ষ আলেম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুছিয়ার শায়খুল হাদিস ও জামিয়া দারুল আরকামের পরিচালক আল্লামা সাজিদুর রহমানও অনুরূপ মন্তব্য করেন। তার বক্তব্য হলো, ইসলাম এটা পছন্দ করে না। এমন না করলেই ভালো হয়। ইসলামের এতো ঠেকে নাই যে বাসে বাসে গিয়ে চান্দা করতে হবে। ইসলামের জিম্মাদার আল্লাহ। সুতরাং নিজে অপমানিত হয়ে এবং আলেম-উলামা ও দ্বীনদার সমাজকে খাটো করে এভাবে অর্থ কালেকশনের দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।

শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কী না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘শরয়ি বিধান ফতোয়া আকারে মুফতি সাহেবদের কাছ থেকে জেনে নেবেন। তবে এমনভাবে সওয়াল করা -যাতে ইসলামকে মানুষ ছোট নজরে দেখে বা ইসলামের ইজ্জত নষ্ট হয়- তাকে আমি বৈধ মনে করি না।

সাথে সাথে তিনি এটাও বলেন, নফসে চান্দা সাবেত (দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের জন্য সাধারণভাবে অর্থ সংগ্রহ করার বৈধতা শরিয়তে প্রমাণিত) আছে। আল্লাহর রাসুল সা. নিজে করেছেন। তবে সেটা করতে হবে এমনভাবে যেন নিজে অপমানিত হতে না হয় এবং ইসলাম ও মুসলমানের প্রতিনিধিত্বকারীদের অসম্মান না হয়।

অর্থ কালেকশনের কাজে নাবালেগ শিশুদের ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরলে মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন বলেন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের দিয়ে কালেকশন করানো বৈধ নয়। তাদের বাবা-মা মাদরাসায় লেখাপড়ার জন্য তাদের পাঠিয়েছেন। কালেকশনের জন্য নয়। সুতরাং এমন করা মোটেও উচিৎ হবে না।

আল্লামা সাজিদুর রহমান অবশ্য শুধু নাবালেগ নয়, বড় ছাত্রদের দিয়েও এমনভাবে অর্থ সংগ্রহ করা উচিৎ নয় বলে মন্তব্য করেন। তার মত হলো, প্রয়োজন হলেও নাবালেগ ছাত্র, বড় ছাত্র কাউকে দিয়ে এমন কাজ করানো উচিৎ না। অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, অন্য চিন্তা করবে।

অন্যচিন্তার ব্যাখ্যা দেন মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন। বলেন, ইখলাসের সাথে মাদরাসা-মসজিদ পরিচালনা করলে আল্লাহ তায়ালা কালেকশন ছাড়াই ব্যবস্থা করে দেন। আল হামদুলিল্লাহ! মসজিদে আকবর কমপ্লেক্সের কোনো কালেক্টর নেই, বিদেশি অনুদান নেই। অথচ গত বছরের খরচ ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে? আমরা কাউকে সেভাবে বলিও না যে, আমাদের টাকা দেন।

তিনি মনে করেন, ভিক্ষা-সদৃশ কালেকশন ছাড়া; এমনকি কোনো ধরনের কালেকশন ছাড়াও মাদরাসা-মসজিদের প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব। তিনি দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, নীতির উপর অটল থেকে কাজ করলে আল্লাহর সাহায্য আসবেই। যেমন মারকাযুদ্দাওয়াহ আলইসলামিয়া –আমি সেখানে ৬ বছর ছিলাম- কোনো প্রকার কালেকশন ছাড়াই তো আল্লাহ চালাচ্ছেন। আমরা পাকিস্তানের দারুল উলুম করাচিতে পড়ালেখা করেছি। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতি মাসের খরচ আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা। কিন্তু সেই মাদরাসারও কোনো কালেক্টর নেই। মুফতি রাফি উসমানিকে আমি নিজে বলতে শুনেছি, আমাদের প্রয়োজনগুলো আমরা আল্লাহকে জানিয়ে দেই, আল্লাহ তা পূরণ করে দেন। এভাবেই সমাধান করতে হবে।

দেশের শীর্ষ দুই আলেমই মনে করেন, দেশের সব মসজিদ-মাদরাসার দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে মুসলিম জনগোষ্ঠির। তবে যে মহল্লার মাদরাসা ও মসজিদ তাদের দায়িত্ব বেশি। মাদরাসা-মসজিদের সুষ্ঠু পরিচালনা ও আর্থিক সহযোগিতা করা মহল্লাবাসীর বিশেষ দায়িত্ব।

অপরদিকে মাদরাসা-মসজিদের জন্য চাঁদার নামে প্রতারণা করাকে জঘণ্যতম অপরাধ বলে মত দেন তারা। তারা বলেন, এমনিতেই প্রতারণা নিষিদ্ধ, কবিরা গুনাহ। আর তা মাদরাসা-মসজিদের নামে হলে তা আরও বেশি ঘৃণ্য বিষয়ে পরিণত হয়। সুতরাং যারা এমন কাজ করছেন তাদের এখনি মহান আল্লাহর দরবারে তওবা করা উচিৎ।

মুফতি দিলাওয়ার হোসাইনের পরামর্শ হলো, দেশের মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডগুলো এই বিষয়ে একটি নির্দেশনাও জারি করতে পারেন। কারণ, যেখানে ইসলাম, মুসলমান ও আলেম-উলামাদের মান-সম্মান নষ্ট হয়, সেখানে বড়দের পক্ষ থেকে নির্দেশনা আসাই কাম্য। যেন পথেঘাটে ভিক্ষাসদৃশ আচরণ কিংবা প্রতারণার মতো এমন কাজ আর না হয়।

শুধু তাই নয়, তিনি মনে করেন, কালেকশনের নামে চলমান প্রতারণা বন্ধ করতে এবং এসবের দায় থেকে মুক্ত হতে কওমি মাদরাসা বোর্ড কর্তৃপক্ষ এভাবে একটি ঘোষণা দিতে পারেন যে, যারা প্রতারণা করছে তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। যে কাজের মাধ্যমে ইসলাম, মুসলমান ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হয় সে কাজের সাথেও আমাদের সম্পর্ক নেই -বলেন মুফতি দিলাওয়ার।

বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের সহ-সভাপতি আল্লামা সাজিদুর রহমান অবশ্য বললেন ভিন্ন বাস্তবতার কথা। সেটা হলো, বেফাক বা অন্য বোর্ডগুলো কারো উপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবে না। তিনি বলেন, তখন কেউ কেউ মন্তব্য করবে, বেফাক কী আমাদের টাকা দেয়! বোর্ডগুলো সর্বোচ্চ পরামর্শ দিতে পারে। এর বেশি কিছু না। কারণ, বোর্ড মাদরাসাগুলোর উপর অনেকভাবে নির্ভরশীল।

অবশ্য তিনি বেফাকের আগামী কোনো বৈঠকে সময়-সুযোগ মতো বিষয়টি উত্থাপন করবেন বলে জানান ইসলাম টাইমসকে।

পূর্ববর্তি সংবাদআকাশপথে ভারতীয় পাইলটের কাণ্ড !
পরবর্তি সংবাদসিরাজগঞ্জে একটি কেন্দ্রে শুরু হওয়ার আগেই স্থগিত হল ভোট গ্রহণ