সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে জেগে উঠুক সুস্থরুচিবোধ

এনাম হাসান।।

প্রযুক্তির কিছু প্লাস দিক যেমন রয়েছে, তেমনি কিছু মাইনাস দিকও রয়েছে। আমাদের উচিত প্রযুক্তিকে সুস্থ, সুন্দর, রুচিশীল প্রতিভা বিকাশে কাজে লাগানো। প্রযুক্তির মাধ্যমে অসুস্থ, অরুচিকর এবং অস্বস্তিকর জিনিসের প্রচার কখনোই কাম্য হতে পারে না।

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে  দিন দিন যেন আমাদের মধ্য থেকে সুস্থ রুচিবোধ হারিয়েই যাচ্ছে। এই প্রযুক্তির যত্রতত্র ব্যবহার করে আমরা আমাদের ব্যক্তিত্বহীনতা ও  রুচিহীনতারই পরিচয় দিচ্ছি।

গতকাল বাংলাদেশের একটি অন লাইন পত্রিকায় এনিয়ে একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে। তাতে লেখক একজন অসুস্থ রাজনীতিকের সাথে আমাদের আচরণ নিয়ে কিছু কথা বলেছেন।

লেখক লিখেছেন, ‘একটি বিষয় আমাকে খুবই পীড়া দিচ্ছে, তা হলো তাঁর এই অসুস্থতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে কেউ কেউ না না ধরনের নেগেটিভ পোস্ট দিচ্ছেন ফেসবুকে।

কার জীবনে কখন কী ঘটবে, কী ঘটতে পারে তা আমরা কেউই জানি না। কিন্তু তাই বলে মানুষের দুঃসময়ে এমন কথাবার্তা কেমন নীচু মানসিকতা!!

বিশ্বের বড় বড় অনেকগুলো হাসপাতালে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে বিভিন্ন প্রয়োজনে। ‘প্রাইভেসি অব প্যাশেন্ট’ – বলে একটি কথা আছে। যা রোগীর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য অবস্থা নিশ্চিত করে। এবং সঙ্গত কারণেই তা গোপন রাখা হয়। একজন রোগীর একজন প্রতিনিধি থাকেন। তিনিই ‘প্রক্সি’ হিসেবে রোগী চেতনাবিহীন হলে প্রধান সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেন।

বিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রথমত যে বিষয়টি বলতে চায়- তা হলো রোগীর মানসিক শান্তি। তাকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা- সকল কোলাহল থেকে। না- বিশ্বের কোনো দেশে হাসপাতালে গিয়ে ভিড় করে রোগীর চিকিৎসা সেবার ব্যত্যয় ঘটাবার নিয়ম নেই। এটা আইনতও সিদ্ধ নয়। রোগীকে দেখার জন্য একটা নির্দিষ্ট ‘ভিজিটিং আওয়ার’ থাকে। কেউ দেখতে চাইলে সেই সময়ে গিয়েই দেখবেন। বাংলাদেশেও, যতদূর জানি- এমন নিয়ম আছে। কিন্তু এই নিয়মটি মানা হয় না কেন ?’

বড় কোনো ব্যক্তিত্বের অসুস্থ অবস্থার ছবি প্রকাশ করা কোনো রুচিশীলতা নয়। কোনো সুস্থ রুচির মানুষই এটা পসন্দ করেন না। এবিষয়ে লেখক লিখেছেন, ‘ খবর বেরিয়েছে, হাজার হাজার নেতা-কর্মী হাসপাতালে গিয়ে ভিড় করছেন। ওই রাজনীতিকের হাসপাতালের বেডে থাকা ছবি আমরা মিডিয়ায় দেখছি। এগুলো প্রকাশ করা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি কি? আমি বিবেকবান সমাজের কাছে সবিনয়ে এই প্রশ্নটি করতে চাই।

বিশ্বে এখন একটি নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে- ‘সেইফমার্ক’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই বিষয়টিকে সহজলভ্য এবং খেলো করে তুলেছে। বিশ্বের কোনো দেশে কোনো হামলা হচ্ছে। এক শ্রেণির মানুষ খুব পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি দিয়ে বলছে আমি ভালো আছি! দেখাচ্ছে ‘সেইফমার্ক’!

চকবাজারে মানুষ পুড়ছে! জাপানে সুনামি হচ্ছে! প্যারিস-লন্ডন-ট্যাক্সাসে মানুষ আততায়ীর হাতে খুন হচ্ছে! আর একটি মহল বসে বসে দেখাচ্ছে সেইফমার্ক’! আমরা কোথায় চলেছি আজ? কোথায় চলেছে আমাদের সামাজিক বিশ্ব?

একজন মুমূর্ষু সুপারস্টারের পরলোকগমনের খবর কে আগে প্রচার করবে- তা নিয়ে নিয়মিত প্রতিযোগিতা এখন! বাংলাদেশে এই বিষয়টি খুব দীন ভাবে চোখে পড়ার মতো!

গত দুই বছরে কত বিশিষ্ট ব্যক্তির ভুয়া মৃত্যু সংবাদ ফেসবুকে প্রচারিত হয়েছে- তা আমাদের সকলেরই মনে থাকার কথা। কে কার আগে দেবে- এই যে হীন প্রতিযোগিতা, তাতে কেন ডুবতে বসেছে আজকের প্রজন্মের কেউ কেউ? বিশ্বে মিডিয়া এখন সহজলভ্য। হাতে হাতে ক্যামেরা। হাতে হাতে কম্পিউটার। যা দিয়ে ছবি তুলে, নিউজ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে। কিন্তু এটা কি খুবই দরকারি? যা সামাজিক নিয়ম, ঐতিহ্য, প্রথা ও শান্তিকে ব্যাহত করে?”

ফেইসবুকে মুহূর্তে মুহূর্তে  আপডেট দিতে থাকা, সেলফি দিতে রীতিমত হাস্যকর  একটি কাজ। এর মাধ্যমে ব্যক্তি অন্যের চোখে হালকা ও খেলো হয়ে  ওঠে।

এবিষয়ে ওই প্রাবন্ধিক লিখেছেন,“ গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটেছে। মানুষ সড়কের পাশে পড়ে কাতরাচ্ছে। আর কেউ দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে! কী বিষাদ আজ এই সমাজে! নিহত-আহতদের সেবা না দিয়ে, তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে আত্মপ্রচারের যে মানসিকতা, তা কোন মানবিক বিবেক? এই প্রশ্নটি আমি বার বার করতে চাই। সেলফির বিষবাষ্প আমাদের ঈমান-বিশ্বাসকেও হালকা করে তুলছে দিনে দিনে। মক্কায় হজ্বে গিয়ে, মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে, গীর্জায় প্রার্থনা করতে গিয়ে এখন সেলফি’তে নিজেকে দেখানোই একটা বড় কাজে পরিণত হয়েছে।

কিছুদিন আগে দেখলাম, একজন তার পুরো ডাক্তারি রিপোর্ট ফেসবুকে আপলোড করেছেন।

একজনের ছেলে ইউরোপের একটি দেশের ভিসা পেয়েছে। পুরো ভিসার পাতা তিনি স্ক্যান করে ফেসবুকে দিয়ে দিয়েছেন। যাতে তার ছেলের নাম, ভিসা নম্বর,মেয়াদ,ব্যক্তিগত সকল তথ্যই দেখা যাচ্ছে। কী হচ্ছে আজকাল এসব?

আমাদের অনেক বন্ধু আছেন- যারা মাঝে মাঝেই ‘লেখক ডাইরেক্টরি’ করেন। এতে লেখককের নাম, ঠিকানা, ইমেল, ফোন নম্বর, ব্যক্তিগত তথ্য সবই চান তারা।

এই বিষয়ে একটি ঘটনা আমি বলি। একবার নিউইয়র্কের একজন খুব নামকরা কবি’র সাথে আমার দেখা করার প্রয়োজন পড়ে। আমি হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজতে থাকি। পরে নিরুপায় হয়ে নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির শরণাপন্ন হই।

তারা আমার নাম, ফোন নম্বর রেখে দেন। বলেন ঐ কবি’র সাথে তারা যোগাযোগ করে আমার কথা বলবেন। কবি সম্মতি দিলে আমার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হবে। আমি আশায় থাকি। দশ দিন পর কবি আমাকে ফোন করেন। এটাই হলো ব্যক্তিগত সামাজিক নিরাপত্তা। আমি বিদেশে থাকি। বাংলাদেশে যখন দুপুর বারোটা, আমার শহরে তখন রাত একটা। এই রাত একটায় কেউ যদি আমার ব্যক্তিগত ফোনে কল করে বলে- ‘ইলিয়াস ভাই, এই মাত্র কবিতাটি লিখলাম- আপনাকে পড়ে শোনাতে চাই’। বুঝুন তো আমার অবস্থা কেমন হবে! কিংবা রাত দুইটায় যদি কেউ ভিডিও কল দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে!

তাই বলে কী আমার ফোন নম্বর বন্ধুরা পাবে না? অবশ্যই পাবে। তবে তাদের বুঝতে হবে কারো ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটির যেন অপব্যবহার না হয়। প্রযুক্তির বিষাদ আজ আমাদের চারিদিকে। প্রযুক্তির প্লাস-মাইনাস অনেক দিক রয়েছে। এটি ব্যবহার করে সহজেই দূর-দূরান্তের মানুষের কাছে আসা যায়।

আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেন্দ্রিক নানা ধরনের ব্যবসায়িক দিকগুলোও উম্মুক্ত হয়েছে। মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করে অনেকে নিজেদের তুলে ধরছেন। এতে অনেকের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়েছে।

অন্যদিকে আঁধারযুক্ত অনেক প্রোগ্রামও ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ইউটিউবে। এখন কে কোনটা গ্রহণ করবে সেটার ওপর নির্ভর করছে তার মানসিকতা। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুঁদ হয়ে ভুলে যাচ্ছে তার মৌলিক কাজ কর্ম। এক ধরনের নেশায় যেন আক্রান্ত হয়ে যায়। দেখার বিষয়টি হলো- এই বুঁদ হয়ে যাওয়ার ব্যাপরে সমাজ কী দায়িত্ব পালন করছে? মানুষ প্রচার চায়। তা হওয়া দরকার পজিটিভ। লক্ষ্য রাখা দরকার মানুষের জীবন বড়। মানুষের নিরাপত্তা বড়।

প্রযুক্তির হাতে সমাজ জিম্মি হতে পারে না। বাংলাদেশেও এখন অনেক নতুন প্রয়োজনীয় আইন হচ্ছে। বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ আইনের ৬৬ ধারায় বলা হয়েছে, টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতি বা বেতার যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কেউ মিথ্যা, প্রতারণামূলক বিপদ সংকেত বা বার্তা পাঠালে তাকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান রয়েছে। আবার দুটি দণ্ডই কার্যকর করা যেতে পারে।

টেলিযোগাযোগ আইনের ৭০ ধারায় বলা হয়েছে, বার বার টেলিফোন করে কাউকে বিরক্ত করা বা অসুবিধার সৃষ্টি করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক্ষেত্রে অপরাধীকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে। জরিমানার টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়ারও বিধান করা হয়েছে।

দুই ব্যক্তির টেলিফোনে আলাপ চলাকালে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ আড়ি পাতলে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এজন্য অপরাধীকে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডই দেওয়া যেতে পারে। এসব কথা প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রথমে মানুষ হয়ে দাঁড়াতে হবে। বিত্ত-বৈভব তো দরকার বটেই, কিন্তু তাই বলে তা করতে গিয়ে জনজীবনের নিরাপত্তাতো বিঘ্নিত হতে পারে না।’

চলুন, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা আরো সামাজিক দায়িত্বশীল হয়ে উঠি।

 

পূর্ববর্তি সংবাদএক নোটিশেই সকল সংবাদ কর্মীর চাকরিচ্যুতি
পরবর্তি সংবাদসৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই বাংলাদেশী নিহত