সংসদে মাদরাসা শিক্ষা ও উলামা বিদ্বেষী বক্তব্য : দুই আলেমের প্রতিবাদ

আতাউর রহমান খসরু ।।

গতকাল (৩ মার্চ, রবিবার) জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে একজন কমিউনিস্ট নেতা ও সাবেক মন্ত্রী দেশের ইসলামপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতা, উলামায়ে কেরাম, কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি ও হেফাজতে ইসলাম নিয়ে অশোভন ও অমার্জিত বক্তব্য দিয়েছেন।

তিনি তার বক্তব্যে আল্লামা আহমদ শফীকে ‘তেঁতুল হুজুর’, দেশে ইসলাম ও মুসলমানের দীনি কার্যক্রমকে মোল্লাতন্ত্র, হেফাজতে ইসলামকে মোল্লাতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক আখ্যা দেন এবং কওমি মাদরাসার শিক্ষাসনদের স্বীকৃতিকে বিষবৃক্ষ রোপণের সাথে তুলনা করেন। তিনি ইসলামপন্থীদের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা খাজা শাহাবুদ্দিনের যুগে (পাকিস্তান আমলে) ফিরে যাচ্ছি।

এ সময় তিনি উলামায়ে কেরাম ও কওমি মাদরাসার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, দেশের মধ্যে চরম পশ্চাৎপদ ভাবনা ছড়ায়, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টিতে তারা লিপ্ত রয়েছে। হিন্দুদের ওপর অত্যাচার আক্রমণ তো সাধারণ ব্যাপার। এখন তাবলিগ জামাতে বিভাজন সৃষ্টি, আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা, তাদের ওপর আক্রমণ- মোল্লাতন্ত্রের এ ধরনের পাকিস্তানি অনুকরণ রাষ্ট্রপতি যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন- সেটাকে চরম বিপদে ফেলেছে।

তার এই বক্তব্যে দেশের দ্বীনপ্রাণ সাধারণ মুসলিম ও উলামায়ে কেরাম ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারা মনে করেন, একটি মুসলিম দেশের জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ইসলামি শিক্ষা ও আলেমসমাজের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা বক্তব্য কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষত তার মতো একজন প্রবীণ রাজনীতিকের মুখে এমন ভিত্তিহীন ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য একেবারেই অশোভন।

তারা বলেন, মুসলিম পরিচয় ধারনকারী কোনো ব্যক্তি অমুসলিম, প্রতারক ও ভ্রান্ত কোনো গোষ্ঠির পক্ষাবলম্বন করে কথা বলতে পারেন না।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, এটাকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে একটা অশনি সংকেত মনে করি। আমরা এ ধরনের ইসলাম ও উলামা বিদ্বেষী বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই।

তিনি এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান ও বক্তাকে জাতীয়ভাবে অবাঞ্ছিত ঘোষণার দাবিও জানান।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দাজ্ঞাপন করেন এবং এর পেছনে অন্য কারও মদদ থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের বক্তব্য চরম ধৃষ্টতা। আমরা মনে করি, তারা সরকারেরই অংশ। মহাজোটের অংশ। এর পেছনে অন্য কারও উসকানি থাকতে পারে।

তিনি মনে করেন, বিষবৃক্ষ রোপণের কথা বলে সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন এই কমিউনিস্টপন্থী নেতা। মাওলানা ইসলামাবাদী প্রশ্ন তুলে বলেন, যে মন্ত্রীসভা কওমি মাদরাসাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যে সংসদ এই বিল পাশ করে তার সদস্য ছিলেন এই নেতা। তখন তিনি এর বিরোধিতা করেননি। সুতরাং তিনি একপ্রকার স্ববিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন।

সাথে সাথে এই নেতার বিরুদ্ধে সংসদকে অবজ্ঞা, আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখানো এবং নাগরিক অধিকার অস্বীকার করার অভিযোগ আনেন তিনি।

একই কথা বলেন, মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি। তার ভাষায়, তার এই বক্তব্য শুধু ধর্মবিদ্বেষী নয়, বরং সংবিধান, সংসদ, সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শনের শামিল।

তিনি এই সংসদ সদস্যের বক্তব্যের প্রতিবাদে বলেন, আলেমরা বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্রের পরিণত করার চেষ্টা করছেন। সরকারি স্বীকৃতি আলেমদের এই চেষ্টাকে আরও বেগবান করবে।

মাওলানা আফেন্দি বলেন, গণবিচ্ছিন্ন ও প্রত্যাখ্যাত এসব রাজনীতিকদের থেকে সরকার যতো দূরে থাকবে ততোই ভালো। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সরকারকেও গণবিচ্ছিন্ন করবে। মনে রাখতে হবে, মহান সংসদে দাঁড়িয়ে এমন বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ যারা দিচ্ছেন তারাও আল্লাহর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হবেন।

মাওলানা ইসলামাবাদী বলেন, আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলবো, ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের এসব কথিত রাজনীতিকদের ভূমিকা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। এরা আপনার পরিবার ও দলকে বিপন্ন করে তুলেছিলো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা খোলস ও মুখোশ পরিবর্তন করতে এদের দেরি হয় না। সুতরাং এসব নেতাদের প্রতি সাবধান থাকবেন। সুতরাং আপনিই সিদ্ধান্ত নেবেন বিষবৃক্ষ কারা।

তিনি আলেম-উলামার উপর এই নেতা ও তার গোত্রীয়দের ক্ষোভের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, আলেম-উলামার উপর এদের ক্ষোভ অনেক। তারা দেশি-বিদেশি টাকায় এদেশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ উলামায়ে কেরামের প্রতি সমাজের সাধারণ মানুষ শ্রদ্ধাশীল, মানুষ তাদের কথা শোনেন– এটা তাদের সহ্য হওয়ার কথা নয়। এজন্য তারা উলামায়ে কেরামকে হেয় ও অবজ্ঞা করার জন্য কখনও মৌলবাদি, কখনও ফতোয়াবাজ, কখনও উগ্রপন্থী ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছে। এখন তারা শুরু করেছে মোল্লাতন্ত্র শব্দের ব্যবহার।

অন্যদিকে মোল্লাতন্ত্র নয়, বরং মেননতন্ত্র এই দেশে নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ। কারণ, তারা ও তাদের দল দেশ ও জাতির ক্ষতি ছাড়া কোনো উপকার করেনি– বলেন মাওলানা আফেন্দি।

হেফাজতে ইসলাম মোল্লাতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ করে মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, হেফাজতে ইসলাম কোনো তন্ত্র-মন্ত্রে বিশ্বাস করে না। হেফাজত একটি ঈমানি সংগঠন। হেফাজতের কাজ মানুষের ঈমান-আকিদা রক্ষায় জনগণ ও সরকারকে সতর্ক করা ও পথ দেখানো।

একই সঙ্গে এই দুই নেতা সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, তাবলিগ জামাতের বিভক্তির অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার বলে মন্তব্য করেন। তারা এর বক্তব্যের জোর প্রতিবাদ করে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার যতো ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো তৎপরতার জন্য কোনো আলেমের নাম কখনও আসেনি। সুতরাং এই অভিযোগ বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

পূর্ববর্তি সংবাদতওবা করে ঘুষের টাকা ফেরত দিলেন পিয়ন
পরবর্তি সংবাদযুব সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে : লিটন