আধুনিক মালয়েশিয়ায় ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে পাস পার্টির পথচলা

মুকিম আহমাদ ।। মালয়েশিয়া থেকে

স্বাধীনতার পর থেকে মালয়েশিয়ার রাজনীতি ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতি। UMNO ( United Malays National Organaisations) ছিল রাজনীতির মাঠে মূল প্রভাবক, একচ্ছত্র আধিপত্যের অধিকারী। চায়নিজ এবং ইন্ডিয়ানদের বিপরীতে মুসলিম মালয়দের একটি দল। জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র নিয়ে এরা মুসলিম-প্রিতিনিধি হিসেবেই বিবেচিত হত। পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রবল হয়ে ওঠলে ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠায় আলাদা দলের শূন্যতা অনুভব করেন তৎকালীন মুসলিম রাজনীতিবিদরা। ফলে ১৯৫১ সালে UMNO- এর কয়েকজন সিনিয়র নেতা একটি স্বতন্ত্র ইসলামী দল প্রতিষ্ঠা করেন। যার নাম পাস পার্টি। প্রতিষ্ঠা- পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ছিলেন আহমাদ ফুয়াদ হাসসান। তিনি মূলত আমনোর সিনিয়র নেতা। স্বতন্ত্র ইসলামী দল হলেও আমনোর প্রভাবমুক্ত ছিল না পাস পার্টি। ফলে দ্বৈত সদস্যপদের সুযোগ ছিল। তারও আগেও আরও কিছু ইসলামী দল ছিল, কিন্তু সেগুলো বেশি দিন টিকেনি। এক সময় ওইসব দল বিলুপ্ত হয়ে যায়।

শুরুর দিকে পাস পার্টি ছিল মূলত নামমাত্র ইসলামী দল  কারণ ১৯৬৯ পর্যন্ত পাস পার্টির প্রেসিডেন্ট ছিলেন বুরহানুদ্দীন আল হেলমী। যিনি একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। পাস পার্টি ইসলামি আদর্শিক অবস্থানের ওপর সংগঠিত হতে বেশ সময় নেয় । সাধারণ ধর্মপ্রাণ ও ধর্মভীরু রাজনীতিবিদের হাতেই পরিচালিত হয় ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের পরপরই শুরু হয় দলের বাঁকবদল। নেতৃত্বের বাগডোর উলামা-মাশায়েখের হাতে পৌঁছানোর তোড়জোড় শুরু হয়। ইরানে নিযুক্ত মালয়েশিয়ান রাষ্ট্রদূত ইউসুফ রাওয়া তার সহকর্মী আলেমদের সহযোগিতায় পাস পার্টির প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করেন। সূচনা হয় পাস পার্টির এক নতুন অভিযাত্রার।

আর এর পর থেকে সূচিত হতে থাকে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে নতুন নতুন অধ্যায়।

একটি ইসলামী দলের নীতি ওপট পরিবর্তনের সাথে সাথে নেতাকর্মীদের পোশাকেও চলে আসে পরিবর্তন। দলটির নেতৃস্হানীয় ব্যক্তিবর্গের মাথায় সাদা টুপি আর গায়ে জুব্বা। দলের মৌলিক কাঠামোতেও পড়ে তার প্রভাব। মফস্বল এলাকাগুলোর সাধারণ মুসলমানদের মাঝে তৈরি হয় এ দলের আলাদা আবেদন। গোটা রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে পরিবর্তনের প্রভাব। যেখানে একটিমাত্র সংসদীয় আসন জেতার ঘটনাও ছিল কঠিন, সেখানে একটি প্রদেশ শাসনের সৌভাগ্য অর্জন করে দরটি। ১৯৯০ সালে সাধারণ নির্বাচনে পাস পার্টি অবিস্মরণীয় জয় লাভ করে কেলান্তান প্রদেশে। ভোটের রাজনীতিতে পাস আবির্ভূত হয় এক নতুন শক্তি নিয়ে। চিন্তা ও চেতনায় মৌলিকত্ব নিয়ে।

পাস পার্টির আধ্যাত্মিক গুরু মাওলানা নিক আব্দুল আজীজ বিন নিক মাত কেলান্তান প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। যিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর দারুল উলূম দেওবন্দে পড়াশোনা করেছেন। দেওবন্দিয়্যাত তার ব্যক্তি জীবনে ও প্রদেশ শাসনে প্রবলভাবে ফুটে ওঠে । তাঁর সুশাসনের গল্প আজ মানুষের মুখে মুখে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর সুনাম ও সুকীর্তি। উলামায়ে দেওবন্দ ও উলামায়ে আযহারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাস পার্টি হয়ে উঠে মালায় সাধারণ মুসলিমদের আস্হা ও ভালবাসার ভরসাস্হল। ধ্যান-ধারণায় হয়ে উঠে আরও বেশি মৌলিক।

পাস পার্টির রাজনৈতিক উত্থানে এবং আদর্শিক পরিবর্তনের মূল নেপথ্য নায়ক ছিলেন মাওলানা নিক আব্দুল আজীজ বিন নিক মাত। পার্টি যখন জাতীয়তাবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের মিশ্র আদর্শে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন সেই পথ রোধ করে দাঁড়ান মাওলানা নিক আব্দুল আজীজ , ১৯৮২সালের অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের সূচনা করেন তিনি। ইউসুফ রাওয়াকে তিনিই “আধ্যাত্মিক গুরু” হিসেবে পরিচিত করে তোলেন। সুদীর্ঘ ২৩ বছরের শাসন পাস পার্টিকে ভোট ও ক্ষমতার লড়াইয়ে আরও বেশি দৃঢ় ও সুসংহত করে।

ভোটের লড়াইয়ে পাস পার্টি এখন জোটবদ্ধ প্রধান বিরোধী দলে পরিণত। আধুনিক মালয়শিয়াতে ইসলামের মৌলিকত্বকে স্পষ্টভাবে সামনে নিয়ে আসায় এবং নির্বাচনী ইশতেহারগুলোতে কোনো প্রকার রাখঢাক বা লুকোচুরি না করে সরাসরি হুদূদ ও অন্য মৌলিক বিধানকে ফলাও করে প্রচার করাতে একদম পরিচ্ছন্ন অবস্হান তৈরি হয়। ধর্ষণের কারণ বর্ণনায় পাস পার্টি নির্ভীকভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের ক্ষেত্রে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধান্বিত হয় নি। দেশের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ভিন্নধর্মের অনুসারী হলেও পাস পার্টি ইসলামকে আধুনিকায়নের পথে না গিয়ে মৌলিকত্বে অটল থেকেছে, যেখানে দেশের প্রতাপশালী ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রেসিডেন্ট মাহাথির মুহাম্মাদও হুদূদ ও অন্যান্য প্রসঙ্গে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও আধুনিকতার দোহাই দিয়েছেন বিভিন্ন সময়।

বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার পালাবদলে ও মালয় মুসলিমদের বিশ্বস্ত নেতাদের দিকবদলের কারণে পাস পার্টি এখন এক শক্তিশালী প্রভাবক। মালয়শিয়ার রাজনীতিতে এখন আস্হার সংকট চলছে। চিরচেনা ইসলামী চিন্তাধারার আনোয়ার ইব্রাহীম যখন লিবারেল সঙ্গীদের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছেন তখন লিবারেল চিন্তাধারার ড. মাহাথির মুহাম্মাদ পাস পার্টির আব্দুল হাদী আওয়াংঙের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। গত ১৫ই ফেব্রুয়ারী ড. মাহাথির মুহাম্মাদ পাস পার্টির প্রেসিডেন্ট আব্দুল হাদী আওয়াঙের সাথে একটি রাজনৈতিক বৈঠকে মিলিত হন । এটি নির্বাচন পরবর্তী তাদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। হাদী একটি উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থনের আশ্বাস দেন। সম্প্রতি মাহাথির মুহাম্মাদ তার ফেসবুক পেইজে দুজনের সাক্ষাতের ছবি আপলোড করেন। সাধারণ মানুষের ধারণা দুই মেরুর দুই্ নেতার আদর্শিক বিরোধের বরফ গলতে শুরু করেছে। মাহাথির মুহাম্মাদ কর্তৃক ইসরাইলের খেলোয়াড়দের ওপর মালয়শিয়ায় প্রবেশ-নিষেধাজ্ঞায় সেটাই স্পষ্টতর হতে থাকে।

এদিকে প্রধান বিরোধী দল নানরকম বড় মাপের দুর্নীতির মামলার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে তাদের সামাজিক অবস্হান হারিয়ে ফেলছে। আনোয়ার ইব্রাহীমের পিপলস জাস্টিস পার্টি প্রচ্ছন্নভাবে লিবারেল দলের তকমা পেতে যাচ্ছে। ফলে তাদের প্রতি মালায় মুসলিমদের সমর্থনে ভাটা পড়বে বলে অনেকেই মনে করছেন।

অপরদিকে বলা যেতে পারে, প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী সময় থেকেই নানা চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে মালয়শিয়ার সর্ববৃহৎ ইসলামী রাজনৈতিক দলটি (পাস পার্টি) এখন মালয়শিয়ার রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী প্রভাবক দল হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।

লেখক: শিক্ষক, মা’হাদ আসসাফা লিততারবিয়াতিল ইসলামিয়া, হুলুলাঙ্গাত, সেলেঙ্গার , মালয়েশিয়া

পূর্ববর্তি সংবাদগাজীপুরে পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে স্কুল শিক্ষিকার লাশ উদ্ধার
পরবর্তি সংবাদভারতের হামলায় ৩০০ জন নিহত হলে তাদের লাশ কই : পাকিস্তান