প্রকৃতির স্বর্গ কাশ্মীর: পেছনের সুখদুঃখ

শাহ মুহাম্মাদ খালিদ ।।

ভূস্বর্গ কাশ্মীর। বিশাল বিশাল পাহাড়, তাতে তুষারের মুকুট, তার কোল বেয়ে বেয়ে আসে ঝর্ণা। হরেক রকম ফলফলাদি আর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। সব মিলিয়ে পৃথিবীর স্বর্গ বলা চলে। এমন একটি জায়গায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে চলছে নিরীহ মানুষের রক্তপাত। কাশ্মীর ভারতের নাকি পাকিস্তানের তার আগের একটি কথা হচ্ছে কাশ্মীর মুসলমানদের। এত নিয়ন্ত্রণ এবং নির্যাতনের পরে এখনো কাশ্মীরে ৭০ শতাংশের উপরে মানুষ মুসলমান। সুতরাং স্বয়ং ভারতকেও এটা মানতে হবে— কাশ্মীর মুসলমানদের।

একটু পেছন ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব, কাশ্মীরের সর্বশেষ রাজা ছিলেন হরি সিং। তিনি এমন এক সময়ে কাশ্মীরের রাজা হয়েছিলেন যখন এই সুবিশাল ভারতবর্ষ ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সময়টা ছিল ১৯২৫ ঈসায়ী।
প্রশ্ন উঠতে পারে, মুসলিম প্রধান একটা অঞ্চলে একজন শিখ রাজা হয় কী করে? ওই অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শিখদের আধিপত্য অনেক পুরনো। ১৮৩১ সালে শিখদের সাথে সাইয়েদ আহমদ শহীদ (রহ) -এর যে যুদ্ধ হয়েছিল, বালাকোটের সেই প্রান্তর এ অঞ্চল থেকে বেশি দূরে নয়। যদিও তা পাকিস্তান সীমান্তের ভিতরে পড়েছে। (গত রোববার এই বালাকোটে ভারতীয় বিমান বাহিনী কথিত একটি হামলা চালিয়েছে ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান নিহত হওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে।)

১৯২৫ সালে হরি সিং কাশ্মীরের ক্ষমতায় বসলেও সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর মত সময় কিংবা সুযোগ মুসলিম নেতাদের ছিল না। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত স্বাধীনতার যেসব ধারা-উপধারা তৈরি করেছিল সেখানে একটা ধারা এটাও ছিল যে, ভারতবর্ষের অন্তর্গত বিভিন্ন অঞ্চলের যেসব রাজা রয়েছেন তারা চাইলে স্বাধীন থাকতে পারেন, আবার ভারত কিংবা পাকিস্তান যে কোন দেশের সাথে যুক্ত হয়েও যেতে পারেন। হরি সিং প্রথমে আলাদা থাকলেও পাকিস্তান সমর্থিত বিদ্রোহীদের ক্রমাগত হামলার শিকার হন। নিজের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবেন না এটা নিশ্চিত হওয়ার পর পাকিস্তানের বদলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি ভারতের সাথে যোগ দেন। দিনট ছিল ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর।

এরপর ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের দমন করতে শুরু করে।
সেই থেকে কাশ্মীরের মুসলমানদের রক্তপাত শুরু যা অব্যাহত রয়েছে অদ্যাবধি।

কিছুদিন আগে শেষ হলো আলমি শুরার তত্ত্বাবধানে তাবলীগের বিশ্ব ইজতেমা। ইসলাম টাইমস- এর হয়ে কাজ করার সুবাদে সুযোগ হয়েছিল বিদেশী কামরায় প্রবেশের। সেখানে ভারতের দুটি জামাতের সাথে আমার বিশেষ ভাবে দেখা হয়েছিল। একটি জামাত ছিল যারা ভারতের গুজরাট থেকে এসেছেন, আরেকটি হচ্ছে কাশ্মীরের।

গুজরাট এমন একটি রাজ্য, স্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে- যেখানকার মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত। ২০০২ সালে গুজরাটের গোধরায় একটি ট্রেনে হামলায় এবং পরবর্তীতে আকসারধাম মন্দিরে আত্মঘাতী হামলায় বেশ কিছু মানুষ নিহত হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে সংঘটিত দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। সেই দাঙ্গায় উগ্রবাদী হিন্দুদেরকে সবরকম সহযোগিতা ও উসকানি দিয়েছিলেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গুজরাটের জামাতটির সামনে এই ঘটনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করার পর বেদনার্ত চেহারা নিয়ে তারা কতক্ষণ চুপ করে রইলেন। একজন কেবল এতটুকু বললেন, ভারতের মুসলমানরা ভালো নেই। রক্তপ্রিয় উগ্র হিন্দুরা যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্ররোচনা ও পৃষ্ঠপোষকতা পায় তখন মজলুম মুসলমানদের ফরিয়াদ জানানোর আর কোনো জায়গা থাকে না।

কাশ্মীরের যাদের সাথে আমার দেখা হয়েছিল তারা ঢাকা খেকে দূরে চিকিৎসা বিষয়ক  একটি বিশেষায়িত উচ্চতর বিদ্যাপিঠে পড়ালেখা করেন। গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের একটি এলাকায় তাদের বাড়ি।

যে দু’টি প্রশ্ন তাদেরকে আমি করেছিলাম তার একটি হচ্ছে বর্তমানে কাশ্মীরের জনগণ কেমন আছে, তাদের ওপর ভারতীয়দের জুলুম অত্যাচারের মাত্রা কতটুকু? জবাবে আকিল (ছদ্মনামের) এক নওজোয়ান বললেন, আপনি তো ভাই এমন জিনিস জিজ্ঞেস করছেন যা পুরো দুনিয়া জানে। আমাদের জীবন কীভাবে চলছে তা কারো অজানা নেই। খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, জমি দখল, ইবাদতে বাধা প্রদান, চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা— সবদিক দিয়েই কঠিন জালে আমরা বন্দী। সেনাবাহিনী, বিএসএফ এবং আধাসামরিক বাহিনী মিলিয়ে ছয় লাখের ওপরে হিন্দু সৈন্য পুরো কাশ্মীর উপত্যকাকে নাপাক করে রেখেছে। সত্তর বছর ধরে তারা এই অঞ্চলে জেঁকে বসে আছে।
আসল প্রশ্ন ছিল এর পরেরটা। ‘কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কী হবে? কীভাবে হবে?’

আমার হাতে একটা কমলা তুলে দিতে দিতে কাশ্মীরের আরেক যুবক বললেন, এই সমস্যার সমাধান তো ভাই আমাদের একার হাতে না। মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো যদি কাশ্মীরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে তাহলে কাশ্মীরি জনগণের একার পক্ষে ভারতের হিন্দুদের বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ কিছু করা কঠিন। এর বাইরে কাশ্মীরী জনগণের হাতে শুধু আরেকটি উপায় বাকি থাকে। সেটি হচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রাম। কিন্তু কাশ্মীরীরা যদি জাতিগতভাবে একত্র হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তাহলে তার পরিণতি কোন দিকে যেতে পারে সেটা পরিষ্কার নয়। কাশ্মীরের জনসাধারণ যদি যুদ্ধের পথ বেছে নেয় তাহলে পাকিস্তান যে অবধারিতভাবে তাদেরকে সহযোগিতা করবে এটা পরিষ্কার। যেমনটা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত করেছিল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। সেটার প্রতিশোধ নেয়ার একটা সুযোগ পাকিস্তানের সামনে চলে আসবে। কিন্তু এখানে রাশিয়া, চীন এবং আমেরিকার মতো পরাশক্তিগুলো সেই মুহূর্তে কোন দিকে অবস্থান নেয় এবং তাদের ক্রীড়নক জাতিসংঘ কোন পথে অগ্রসর হয় এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিবেচ্য বিষয়।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যদি ভবিষ্যতে ভারতের জুলুম অত্যাচার আরও বৃদ্ধি পায় এবং অন্য মুসলিম দেশগুলো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে তাহলে আপনারা কী করবেন?’ কিছুক্ষণ ভেবে তিনি বললেন- এটা আসলে ভবিষ্যতের ওপর নির্ভর করে। তবে যদি বাস্তবতা তেমনই হয় তাহলে অন্য দেশগুলোর সহযোগিতা না পেলেও কাশ্মীরি জনগণ হয়তো যুদ্ধে নেমে যাবে। যদি পাকিস্তানও একটু ভাল করে সহযোগিতা করে তাহলেও সেটা কাশ্মীরেদের জন্য অনেক ফলপ্রসূ হবে।

চিকিৎসা শাস্ত্রের শিক্ষার্থী কাশ্মীরি ওই ছেলেদেরকে আরেকটা প্রশ্ন ছিলো, কাশ্মীরে মাওলানা সাদ- এর বিষয়টি তাবলীগের কাজে কোন প্রভাব তৈরি করছে কিনা। তারা বললেন মাওলানা সাদকে কেন্দ্র করে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে কাশ্মীরের অনেক এলাকার মানুষ তা জানেই না। তারা স্বাভাবিকভাবে তাবলীগের কাজের সাথে যুক্ত আছেন এবং সরল মনে এই কাজ করে যাচ্ছেন।

কথা প্রসঙ্গে জানা গেল ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে কাশ্মীরে তাবলীগ জামাত যেতে পারে। কিন্তু বাইরের দেশের কোন তাবলীগ জামাত বিরল কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া কাশ্মীরে প্রবেশের অনুমতি পায় না।

পূর্ববর্তি সংবাদসিটি নির্বাচনে সব দল অংশ না নেওয়া অস্বস্তিকর: সিইসি
পরবর্তি সংবাদজমির খতিয়ানের কপি পাওয়া যাবে ৫ মিনিটে