চুড়িহাট্টার কান্না : কীভাবে এড়াবেন দায়?

জহির উদ্দিন বাবর ।।

কিছু কিছু বিয়োগান্ত ঘটনা পুরো জাতিকে ছুঁয়ে যায়। এমনই একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে। সবাই যখন একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহর উদযাপনের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত তখন পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, একটি ভবনে আগুন লেগেছে। তবে পরে জানা গেছে, একটি গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর ওই গাড়িতে থাকা আরও সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটে এই ভয়াবহ ঘটনা। পরে গ্যাসের কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশের রেস্তোরাঁ, একটি বহুতল ভবনসহ আশপাশের এলাকায়। পুরো ঘটনাটির সূচনাটা ছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। কিন্তু সেটি যে কী ভয়াবহ ছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সেখানে ওই মুহূর্তে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের কাছে এটা কেয়ামতের ভয়াবহতার মতোই মনে হয়েছে।

পুরান ঢাকা এমনিতেই ঘিঞ্জি এলাকা। সেখানে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে অন্য যেকোনো এলাকার চেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওইদিনের ঘটনায়ও হয়েছে তাই। সরকারি ভাষ্যমতেই মৃতের সংখ্যা প্রায় ৭০। যদিও ফায়ার সার্ভিস ও হাসপাতাল সূত্রের খবরে সংখ্যাটা আরও বেশি। সংখ্যাটি যদি সত্তরও হয় সেটাও অনেক বড় ঘটনা। একটি মৃত্যুও অপূরণীয়। যার স্বজন মারা যায় সেই কেবল বোঝে হারানোর বেদনা কতটা নির্মম! চুড়িহাট্টার এই ট্রাজেডিতে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েকশ পরিবার। কিন্তু এটা ছুঁয়ে গেছে পুরো জাতিকে।

আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা আগেও বিভিন্ন সময় ঘটেছে। রানা প্লাজা, তাজরীন কিংবা নিমতলীর ভয়াবহ সেই ট্রাজেডি আজও রক্তক্ষরণ ঘটায়। এর সঙ্গে যুক্ত হলো চকবাজারের এই ট্রাজেডি। যদিও এটি বাহ্যত একটি দুর্ঘটনা; তবুও এর পেছনে অনেক কথা থেকে যায়। আসলেই কি এটা দুর্ঘটনা, নাকি একটু সচেতন হলে তা এড়ানো যেত! কর্তৃপক্ষ কি এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে সত্যিকার অর্থে আন্তরিক ছিল! এই দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি কাউকে দায়ী করা না গেলেও সামগ্রিক অর্থে সরকার এর দায় এড়াতে পারে না।

২০১০ সালে যখন নিমতলীর ভয়াবহ ট্রাজেডি ঘটে তখন পুরান ঢাকাকে কেমিক্যালের গোডাউনমুক্ত করার একটা উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। সেই ঘটনায় শতাধিক লোকের প্রাণহানি হয়েছিল। আর এর মূল কারণ ছিল কেমিক্যালের গুদাম। একটি আলাদা পল্লী করে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সেখানে পাঠানোর কথা বলেছিল সরকার। সেই সরকার এখনও ক্ষমতায়। কিন্তু গত নয় বছরেও সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা এতে সম্মত নন। তারা আলাদা পল্লীতে যেতে চাচ্ছেন না। কিন্তু এটা কি আসলেই সমর্থন করার মতো কোনো কারণ?

সরকার প্রকৃত অর্থে উদ্যোগ নিলে এটা বাস্তবায়ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি পল্লী সরাতে পেরেছে এই সরকারই। সম্প্রতি বুড়িগঙ্গাকে অবৈধ দখলদারমুক্ত করতে সরকার যে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছে সেখানে কি স্থানীয়দের সম্মতি আছে! যারা বছরের পর বছর ধরে নদী দখল করে আছে তারা কি এটা সহজে মেনে নিচ্ছে! কিন্তু তবুও করার কিছু নেই; জনকল্যাণে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা যে কেউ মেনে নিতে বাধ্য। যে যত ক্ষমতাবানই হন রাষ্ট্রযন্ত্রের চেয়ে বেশি ক্ষমতা আর কারও নেই।

কেমিক্যালের গোডাউন সরানো ছাড়াও পুরান ঢাকাকে ঢেলে সাজানোর একটি কথাও দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। সেখানকার পুরোনো ভবনগুলো ভেঙে সরকারি খরচে ফ্ল্যাট নির্মাণ, রাস্তা প্রশস্ত করা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করা, নাগরিক সুবিধা আরও বাড়ানো এ ধরনের একটি প্রকল্প রাজউক নিয়েছিল। কিন্তু তা কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না সেটা জানা নেই। সরকার চাইলে কোনো বাধাই বাধা নয়। কারণ এই সরকার এতটাই শক্তিশালী যে, যে কোনো উদ্যোগ নিলে কেউ তাতে বাঁধ সাধার মতো সাহস রাখে না। চকবাজারের সেই দুর্ঘটনাস্থলে যদি ফায়ার সার্ভিস যথাসময়ে পৌঁছতে পারত, সেখানে যদি আগুন নেভানোর মতো পর্যাপ্ত উপকরণ থাকত তবে হয়ত এতগুলো প্রাণহানি ঘটত না।

চুড়িহাট্টা ট্রাজেডির পর কর্তৃপক্ষের দায় এড়ানোর একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। পরদিন পুলিশপ্রধান ও ফায়ার সার্ভিসের কর্তা ব্যক্তিরা জানালেন, কেমিক্যালের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া শিল্পমন্ত্রী পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, ওই এলাকাতেই কোনো কেমিক্যালের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু পরদিন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানশনের বেইজমেন্টে গিয়ে পাওয়া গেল কেমিক্যালের বিশাল গুদাম। যদিও সেই কেমিক্যাল পর্যন্ত আগুন বিস্তৃত না হওয়ায় কিছুটা রক্ষা হয়েছে।

আর সিটি করপোরেশনের মেয়র এতদিনেও কেমিক্যালের গুদাম সরাতে না পারার দায়ভার নিজের ওপর না নিয়ে চাপিয়েছেন সেখানকার ব্যবসায়ীদের ওপর। বলেছেন, তাদের অসহযোগিতার কারণেই তা সম্ভব হয়নি। আর দুই মেয়াদ আগের শিল্পমন্ত্রী ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এর জন্য দায়ী করেছেন তার পরের শিল্পমন্ত্রীকে। এর দ্বারা পরিষ্কার যে, কেউ দায় নিতে চান না। সবার মধ্যে দায় এড়ানোর একটি প্রবণতা লক্ষ্য করার মতো। মূলত এটা নতুন নয়, অনেক পুরোনো কালচার। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ধাক্কা দিয়ে’ ভবন ফেলে দেয়ার মতো হাস্যকর থিউরি আজও মুখে মুখে প্রচলিত।

শুধু এই সরকার নয়, কোনো সরকারের আমলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কোনো ঘটনার দায় নিজের কাঁধে নিতে রাজি নন। তিনি যত ব্যর্থই হন না কেন পদ ছাড়তে প্রস্তুত নন। অথচ অন্যান্য দেশে এ ধরনের নজির অহরহ আছে। ২০১৩ সালে আমাদের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর লাটভিয়ায়ও এ ধরনের একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। কয়েক বছর আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি ফেরিডুবিতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পর সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। পাশের দেশ ভারতে পর্যন্ত ছোটখাট ঘটনার পর দায় নিয়ে মন্ত্রীদের পদত্যাগের খবর আমরা প্রায়ই পাই। অথচ বাংলাদেশে সর্বোচ্চ আদালত থেকে মন্ত্রী পদে অযোগ্য ঘোষণার পরও নির্লজ্জের মতো পদ আঁকড়ে থাকার ঘটনা আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে।

চুড়িহাট্টার সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা গোটা জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়ে গেছে। সেখানকার হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমের কল্যাণে সামনে চলে আসায় তা আমাদেরকে অনেক বেশি পীড়িত করেছে। এই দুর্ঘটনা নিয়েও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করছে। এটা একটি জাতির জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যের। এই মুহূর্তে সবার উচিত নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। অগ্নিদগ্ধ হয়ে যারা হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তাদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করা। তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো। সবচেয়ে বড় হলো, এ ধরনের দুর্ঘটনা থেকে যেন আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করেন সেজন্য বিশেষভাবে দোয়া করা। আর কর্তৃপক্ষের উচিত এ ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করা।

লেখক: সাংবাদিক, গ্রন্থকার

পূর্ববর্তি সংবাদপরকীয়ায় জড়িত স্ত্রীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হাইকোর্টে রিট, শুনানি ৫ মার্চ
পরবর্তি সংবাদঢাকায় ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রতিষ্ঠায় মধ্যপন্থার ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত