ইসরাইলের সঙ্গে আরব শাসকদের আপোষ আর মালয়শিয়ার লড়াই-এর রহস্য

মুসাল্লাম ইমরান ।।

মালয়শিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহথির মুহাম্মাদ জুলাইতে মালয়শিয়ার অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক সাতার প্রতিযোগিতায় কোন ইসরাইলি সাতারুকে ভিসা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। এরপর গত কয়েক সপ্তাহে মালয়শিয়ায় নজিরবিহীনভাবে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকরণের বিরুদ্ধে আওয়াজ বেশ জোরালো হয়েছে।

মালয়শিয়ার মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে। তারা আরও জানিয়েছেন, আগামীতে ইসরাইলের অংশগ্রহণের শর্ত রয়েছে, এমন যে কোন আন্তর্জাতিক সন্মেলন বা প্রতিযোগিতা আয়োজন করবেন না।

মালয়শিয়ার যুব ও ক্রিয়া মন্ত্রী জনাব সাইয়েদ সাদিক বলেন, ‘একটি ক্রীড়া চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য যদি আমরা আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইদের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যার্থ হই, তবে বিবেকবোধ ও নৈতিকতার কোন সূচকে আমরা আমাদের রাখতে পারবো না।’

মালয়শিয়ায় সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে প্রশাসন-রাজনৈতিক নেতা সবাই মাহাথিরের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সোচ্চার অবস্থানের কারণে তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে দখলদার ইসরাইলের বর্ণবাদী আচরণের জোর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, যখন চাপের মুখে আরবের কোনো কোনো শাসক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্থা দখলদার শক্তির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে প্রয়াসী, তখন মালয়শিয়ার সর্বস্তরের মানুষের নিন্দা ও প্রতিবাদের পেছনে রয়েছে প্রশাসনের উপর মালয়শিয়ান সমাজের প্রভাব, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্ব এবং দেশটির মজবুত অর্থনৈতিক অবস্থা।

মালয়শিয়ার সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে হাজার হাজার স্থানীয় সংগঠন বেশ সক্রিয়। তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতি সমর্থন এবং এ ইস্যুতে জনমত তৈরির জন্য কাজ করছে। বহু মানবাধিকার, ধর্মীয় ও ত্রানসংস্থা এ লক্ষ্যে কাজ করছে।

মালয়েশিয়া উদার গণতান্ত্রিক দেশ হওয়াতে ফিলিস্তিনি ইস্যুতে সম্পৃক্ত বুদ্ধিজীবীদের, রাজনৈতিক দল ও সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করতে পারেন। ইসরাইলি সাতারুদের দেশে প্রবেশ করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত মূলত জনদাবির প্রেক্ষিতেই হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরাইলকে বয়কট করতে মালয়শিয়া যেন আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে –সে দাবিতে বিক্ষোভ করছে মালয়শিয়ার সামাজিক সংগঠন।

এমনিতেই ব্যাপক সাংবিধানিক ক্ষমতা ভোগ করার কারণে মালয়শিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ দেশের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তদাতা। ব্যতিক্রমধর্মী ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বড়-বড় শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে দ্বিধা করেননি। এমন স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষটি এজন্যই অবসর থেকে সরকারের বিরোধী আন্দোলন সফল করে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন।

তার এ চারিত্রিক দৃঢ়তা ইসরাইলি সাতারুদের মালয়শিয়ায় প্রবেশ নিষেধাজ্ঞাতেও বেশ স্পষ্টাভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষত যখন কোনো কোনো আরব মুসলিম দেশে ইসরাইলি খেলোয়াড় ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের বেশ উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, তখন মাহাথিরের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাহসী।

এমনকি ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাহাথির মুহাম্মাদকে ইহুদিবিরোধী তকমা দেওয়ার পরও মাহথির ইসরাইলকে অপরাধী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাল্টা বর্তমান স্পর্শকাতর সময়ে ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ সংগ্রাম(হামাস) এর রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়ার সাথে যোগাযোগ করে দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন।

বিশ্ব অর্থনীতিতে মালয়শিয়ার অর্থনীতির একটি অবস্থান রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম ও ইসলামি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি মালয়েশিয়া। গত শতাব্দীর নব্বই-এর দশকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও কয়েক বছরে বেশ কিছু সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতির ভিতকে বেশ পাকাপোক্ত করেছে দেশটি। এমনকি সম্প্রতিক ভয়াবহ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে তারা তাদের দক্ষ জনশক্তি, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে মোকাবেলায় সক্ষম হয়েছে।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহত জোরদার উপস্থিতি ও ব্যবসায়িক কোম্পানির বহুমুখীকরণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে চলেছে তারা। এ অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণেই মালয়শিয়ার কোন এক মন্ত্রী বলতে পেরেছেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা পাশ্চাত্যের কোন ব্যাংক হতে লোন গ্রহণ করিনি, তাদের কোন চাপের কাছে আমরা নত হবো না।’

ইসরাইলের বিরুদ্ধাচারণে তাদের সাহসিকতার অন্যতম কারণ হয়তো তাদের এই এই মজবুত অর্থনৈতিক ভিত এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সক্ষমতা। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকাসহ কিছু তল্পিবাহক রাষ্ট্র কর্তৃক তুর্কি অর্থনীতির ওপর আক্রমণ করেছে। মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও এমন হওয়ার আশংকা রয়েছে। কিন্তু মালয়শিয়া তাদের অর্থনীতিকে পশ্চিমা আক্রমণ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তাছাড়া আন্তর্জতিক পরিমণ্ডলে ইসরাইলকে কোণঠাসা করার জন্য এমনই এক সময় মালয়শিয়া কূটনৈতিকভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপে আরব ও ইসলামিক অনেক দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে চলছে। আগামীতেও তাদের মাঝে সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলেই অভিজ্ঞ মহল ধারণা করছে।

সূত্র : আল জাজিরা থেকে মুজাহিদুল ইসলামের অনুবাদ

পূর্ববর্তি সংবাদসিলেট দরগা মাদরাসার মুহাদ্দিস হাজী সাহেব হুযুরের ইনতেকাল
পরবর্তি সংবাদসিসির মতো লোকের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই না : এরদোগান