চকবাজারে লাশের মিছিল, দায় কার?

আতাউর রহমান খসরু ।।

গত বুধবার রাতে চকবাজারের যে এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটলো তার মাত্র দেঢ় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নিমতলীতে একই বিপর্যয় ঘটেছিলো ২০১০ সালে ৩ জুন। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারায় ১২৪ জন মানুষ।

দুর্ঘটনার ধরন ও এলাকার বৈশিষ্ট্য সবকিছুতেই মিল রয়েছে এই দুই ট্রাজেডির মধ্যে। উভয় এলাকায় ঘনবসতিপূর্ণ, রাস্তা-ঘাট সংকীর্ণ, একই ভবনে হোটেল, প্লাস্টিকের দোকান, রাসায়নিকের গোডাউন ও কারখানার উপস্থিতি। নিমতলীর ঘটনা ভয়াবহ রূপ নেয় রাসায়নিকের কারণে, চকবাজারে রাসায়নিকের সাথে যোগ হয়েছে প্লাস্টিক ও সুগন্ধির দাহ্য পদার্থ।

মিল রয়েছে ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়-ও। একদিকে ভয়াবহতায় শোকাহত ও স্তম্ভিত এলাকাবাসী, অন্যদিকে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিতে ব্যস্ত রাজনৈতিক নেতারা। নিমতলীর ঘটনার পর স্থানীয় অধিবাসীরাই দাবি তুলেছিলো আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিকের গোডাউন সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রশাসনও রাসায়নিকের গোডাউন, ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা পুরান ঢাকা ছাড়া করবে বলে অঙ্গীকার করে। এ সময় স্থানান্তর করা প্রয়োজন এমন আটশো রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা চিহ্নিতও করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সরানো যায়নি। স্থানীয়রাও কয়েকদিন পর ভুলে গেছেন তাদের দাবির কথা।

চুড়িহাট্টা শাহী জামে মসজিদের মুফাসসির, উর্দু রোড জামে মসজিদের খতিব, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার মুহাদ্দিস ও থানবী লাইব্রেরীর সত্ত্বাধিকারী মাওলানা এনামুল হক নূর –যিনি পারিবারিক আবাস ও ব্যবসার সূত্রে শৈশব থেকেই পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় যাতায়াত করেন- তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বারবার কেন এমন দুর্ঘটনা ঘটছে? তার মতে, একই রকম দুর্ঘটনার জন্য এলাকার পরিবেশই বেশি দায়ী। তারপর এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও বাড়িওয়ালার অর্থলোভ ও সরকারের দায়িত্বে অবহেলা।

বিষয়টিকে তিনি এভাবে বিশ্লেষণ করেন, এই চকবাজারে প্রতিদিন নানা কারণে লাখ লাখ মানুষের যাতায়াত। অথচ সেখানে শত মানুষের চলাচলের উপযোগী রাস্তা নেই। একই সঙ্গে প্লাস্টিক, কসমেটিকস, সুগন্ধি, কেমিক্যালের ব্যবসা হচ্ছে। বলা যায়, একটা বারুদের কারখানা। কারখানা ও বিবণী কেন্দ্র অনেক বেশি হওয়ায় যানজটও এতো বেশি থাকে যে, দুর্ঘটনার সময় দৌঁড়ে বাঁচবে বা অন্যরা সহযোগিতা সম্ভব হয় না।

যখন একটা দুর্ঘটনা ঘটে তখন মানুষের ভেতর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং কয়েকদিন পর সব ভুলে যায়। অন্যদিকে বাড়িওয়ালা ও ব্যবসায়ীরা আর্থিক চিন্তা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন বা তোলার সুযোগ দিচ্ছেন। আর সরকার তা দেখেও দেখছে না।

আপনার কথা বোঝা যাচ্ছে, এসব দুর্ঘটনার পেছনে অনেকেরই দায় রয়েছে। কিন্তু দায়টা বেশি কার? মাওলানা এনামুল হক নূর উত্তর দেন, দায়টা অবশ্যই সরকারের বেশি। জনগণের পক্ষে সবদিক বিবেচনা করা সম্ভব হয় না। সরকারের দায়িত্ব হলো সার্বিক বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা বাস্তবায়ন করা। দুর্ঘটনার পর যে প্রতিক্রিয়া হয় তা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাইরেই হয়। স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট চুপ থাকেন এবং সুযোগের অপেক্ষা করেন। প্রশাসন কেন তাদেরকে সুযোগ দিবে?

দেশের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আলেম, খতিবে আজম সিদ্দিক আহমদ রহ.-এর জামাতা ও চট্টগ্রাম ওমর গণি এমইএস কলেজের সাবেক অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসাইনও মনে করেন, সরকারের আরও কঠোর হওয়া দরকার। যে কোনো মূল্যে বাস্তবায়ন করতে হবে এমন। মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, গোডাউন রাখবেন না। এটা আগে করলে মানুষকে জীবন দিতে হতো না।

সরকারের চেষ্টা ছিলো এবং এখনও আছে -সরকারি মহলের এমন বক্তব্যের উত্তরে তিনি বলেন, সরকার বলছে, চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটা শুধু প্রস্তাবে শেষ হলে মানুষের জীবন বাঁচানো যাবে না। সরকারের উচিৎ ছিলো জননিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরাতে বাধ্য করা।

অধ্যাপক খালিদ আরও বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের দেশে একই রকম ঘটনা বার বার ঘটতে থাকে অথচ তার কোনো প্রতিকার হয় না। শুধু চকবাজার ও নিমতলী নয় এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। ঢাকার আশুলিয়া ও গাজীপুরের গার্মেন্টেসেও আগুন লেগে শত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।

মাওলানা এনামুল হক নূরও প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, আমি ছোট থেকে এই এলাকায় রয়েছি, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি কারো কোনো উদ্যোগ আমি দেখিনি। অথচ দীর্ঘদিন থেকেই এটা একটা অগ্নিগর্ভ এলাকা।

চকবাজারের মর্মান্তিক ঘটনায় নিজের ব্যথা, ক্ষোভ, দুঃখ ও হতাশা আড়াল করতে পারেননি ড. খালিদ হোসাইন। প্রচণ্ড রকমের ব্যথা নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে জীবন ও জীবনের নিরাপত্তার কোনো মূল্য নেই। মানুষকে রক্ষার জন্য আইন করা হয়। কিন্তু উল্টো দুর্বৃত্তরা আইনের আশ্রয় নেয়। আদালতে মামলা করে প্রশাসনের সিদ্ধান্ত ঠেকিয়ে দেয়। আবার রহস্যজনকভাবে আদালতের রায়ে কখনও সরকার বা প্রশাসনের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা যায় আবার কোনোটাতে দেখা যায় না। তারা আদালতের কাছে অসহায় ভাব প্রকাশ করে। মূলত এখানে শিক্ষা-সচেতনতার অভাব, আইনের অপব্যবহার, প্রশাসনের দুর্নীতি, কায়েমি স্বার্থ অনেক কিছু কাজ করছে।

উভয় ইসলামি চিন্তাবিদ পরিকল্পিত নগরব্যবস্থা ও জননিরাপত্তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা বলেন, পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা গড়ে তোলা সময়ের অপরিহার্য দাবি। জননিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে। যার প্রধান দিক হবে, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকা ভিন্ন করা।

পুরান ঢাকাকে ঢেলে সাজাতে অনেকেই এই এলাকা থেকে ব্যবসায়িক কেন্দ্র সরিয়ে ফেলার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে কী সম্ভব? মাওলানা এনামুল হক নূর –যার পরিবার এই এলাকায় দীর্ঘদিন ব্যবসা করছে এবং যিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী- বলেন, চকবাজার থেকে ব্যবসা হয়তো পুরোপুরি সরানো সম্ভব হবে না। তবে এখান থেকে অন্তত কারখানা ও গুদাম সরাতে হবে। শো-রুম বা বিক্রয় কেন্দ্র থাকতে পারে। কুলি ভাড়া ও যাওয়া-আসার সময় বাঁচানো ইত্যাদি চিন্তা করে একই এলাকায় কারখানা ও বিক্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। চকবাজারের এমন ভবন অসংখ্য যার একেক তলায় একেক রকম কারখানা। এবং এর কোনোটাই নিয়ম মেনে করা হয় না। নিরাপত্তার ব্যবস্থা বলতে কিছুই থাকে না এসব কারখানায়। এই প্রবণতা রোধ করতে হবে। মানুষের জীবন বাঁচাতে এতোটুকু প্রশাসনকেই করতে হবে। তাতে শক্তি প্রয়োগের প্রশ্ন উঠলেও।

পূর্ববর্তি সংবাদচকবাজারে হতাহতদের স্মরণে বিএনপির দোয়া ও শোকের কর্মসূচি
পরবর্তি সংবাদআগুনে পুড়ে ছাই সিলেটের ‘বিগবাজার’