যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়েমেনে কেমন আছেন আলেমরা?

শায়খ মুনির ইয়েমেনি ।।

শায়খ মুনির যুদ্ধকবলিত ইয়েমেনের তাইজের অধিবাসী। তাইজ ইয়েমেনের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। একজন বিদগ্ধ আলেম। যুদ্ধ যখন ধংসাত্মক ও ভয়াবহ হতে থাকে তখন তিনি মালয়শিয়ায় চলে আসেন। ফিকহের দরস প্রদান করেন। যুদ্ধ পরিস্হিতির উন্নতি হওয়ায় ঘুরে আসেন স্বদেশ এবং জানালেন ইয়েমেনের সার্বিক পরিস্হিতির কথা।

১৯৬২ সাল পর্যন্ত উত্তর ইয়েমেন শাসন করছিল যায়েদি মুতাওয়াক্কিলি শিয়া সম্প্রদায়। উত্তর আর দক্ষিণ ইয়েমেন একত্রিত হয়ে বর্তমান ইয়েমেনের প্রতিষ্ঠা হয ১৯৯০ সালে। প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহ-এর অধীনে ভালোই চলছিলো আমাদের দেশটি। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে শাসন করতে থাকা মানুষগুলোর মাঝে একনায়কতন্ত্রের মনোভাব চলে আসে। ফলে ক্ষেত্রবিশেষ তার প্রতি সাধারণ জনগণ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছিল, যা প্রকাশ হয় আরব বসন্তের সময়।

ইয়েমেনে আমরা দীর্ঘকাল যায়েদি হুতিদের সঙ্গেই বসবাস করে আসছিলাম। জনসাধারণের ভেতর তেমন কোন সহিংসতা বা সংঘাতপূর্ণ মনোভাব ছিল না। দীর্ঘ সহাবস্হানে সুন্নি মুসলমানরা শিয়াদের বিষয়ে সু-ধারণাবশত উদাসীন থাকে। সুযোগে তারা সংগঠিত ও সজ্জিত হয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অধিষ্ঠিত হতে থাকে।

ইরানের পরোক্ষ সমর্থনে তারা ততোদিনে অভ্যুত্থান ঘটানোর মতো শক্তি সঞ্চয় করে ফেলে। ২০১১ সাল থেকেই তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষ। হুতি মিলিশিয়া আনসারুল্লাহ, রাষ্ট্রীয় মুসলিম সেনাবাহিনী এবং আল কায়েদা। ত্রিমুখী সংঘর্ষ আর প্রেসিডেন্ট সালেহর ঘনিষ্টতার সুযোগে হুতি মিলিশিয়া সেপ্টেম্বর ২০১৪ তে রাজধানী সানা দখল করে ফেলে। সেনাবাহিনী প্রতিহত করতে চাইলেও অদৃশ্য কোন ইশারায় সালেহ সে নির্দেশ দেননি।

হুতিদের সানা দখলে অনেক সাধারণ মুসলিমও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তবে তাদের মোহ ভেঙ্গে যায়। শুরুতে হুতি মিলিশিয়ারা প্রতারণার আশ্রয় নেয়। মুসলিম উলামাদের অভয় দেয়। ইয়েমেনের ঐক্যের কথা বলে। আমাদের মাদরাসাগুলোতে দরস অব্যাহত রাখতে বলে।

কিন্তু তারা মূলত ভেতরে ভেতরে ইরানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছিল। আর প্রতিহত করতে শুরু হয় সৌদি-আরব আমিরাতের যৌথ আক্রমণ। প্রথমদিকে আক্রমণ ছিল লক্ষ্যভ্রষ্ট। সাধারণ মানুষ নিহত হয় অনেক। ভিটে-মাটি হারা মানুষগুলো গ্রামে ছুটতে থাকে।

সুন্নি জনসাধারণের মধ্যে একটি প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে যায়, ইয়েমেনে বহিরাগতরা ইয়েমেনের দুশমন। কোন মতবাদ নয় রাষ্ট্রের স্বার্বভৌমত্বের দুশমন। এই যুদ্ধ ইয়েমেনের বিরুদ্ধে, শিয়াদের বিরুদ্ধে নয়। প্রোপাগান্ডায় বিভক্ত হতে থাকে সুন্নি নেতারা। এমনকি আলেমদের মধ্যেও মতানৈক্য দেখা দেয়। বেঁধে যায় যুদ্ধ নিজেদের মাঝে। হুতি মিলিশিয়ারা আদানের দিকে অগ্রসর হয় । তাইজও দখল করে। তাইজ থেকে হুতি মিলিশিয়ারা তাদের সামরিক রসদ পেতে থাকে । ফলে সানাতে তাদের দখল দৃঢ় হয়।

উপশহর আর গ্রামগুলোতে উদ্বাস্তু মানুষের উপচে পড়া ভীড়। বাস্তুহারা মানুষগুলো জিবুতি আর সোমালিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। সৌদি শুধু ভিআইপি লোকদের আশ্রয় দিয়েছে। সালাফি আলেম-উলামারাও সৌদিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। শায়খ আব্দুল মাজিদ ঝানদানি তাদের অন্যতম।

তবে তাসাউফপন্হী আলেমগণ হাদরামাউতে নিরাপদেই আছেন । শায়খ হাবিব আলি আল জিফরিও হাদরামাউতেই নিরাপদে আছেন। তিনি সুফি আলেমদের তাজ। হুতিরাও তাদের শ্রদ্ধা করে।

মূলত সংকটে আছি আমরা। হুতি মিলিশিয়া আমাদের তাইজ সিজ করে রেখেছে। ফলে খাদ্য-সংকট এতোটাই তীব্র যে মানুষ এখন জীবন্ত কংকাল হয়ে বেঁচে আছে। চেনা মানুষদেরও চেনা যায় না। সৌদি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় খাদ্য-সংকট নেই। চিকিৎসা-সেবাও মিলছে। হুতি মিলিশিয়া নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ইরান থেকে খাদ্য সরবরাহ চলছে।

গত বছরে (২০১৮) পনের হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে ইয়েমেনে। শিশুরা নিহত হচ্ছে প্রতিদিন। এই যুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজার শিশু নিহত হয়। বেশিরভাগই হুতি আক্রমণের শিকার। ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ নানাভাবে বিকলাঙ্গ হয়েছে। এখন সবাই যুদ্ধবিরতি চায়। কারণ এই যুদ্ধ এখন সৌদি-ইরানের যুদ্ধ। এর কোন নিষ্পত্তি হবে না । তাই মানুষ কোয়ালিশন সরকার চায়। তবু যুদ্ধ থেমে যাক। সুস্হ নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠুক।

অনুলিখন : মুকিম আহমাদ, শিক্ষক, মাহাদ তারবিয়্যাহ ইসলামিয়্যাহ আস সফা, হুলু লাঙ্গাত, সেলাঙ্গর, মালয়শিয়া ।

পূর্ববর্তি সংবাদবেইলি সেতু ভেঙে শরীয়তপুর-চাঁদপুর যান চলাচল বন্ধ
পরবর্তি সংবাদজরুরি রক্ষণা‌বেক্ষণ : রাজধানীর কিছু এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বি‌ঘ্নিত