কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের আসল রূপ

মাওলানা আবু সালমান ।।

গত কয়েক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘আহমদীয়া মুসলিম জামাত’ নামধারী একটি সম্পূর্ণ ‘অমুসলিম সম্প্রদায়’ পবিত্র ইসলাম ধর্মের অবমাননা, অপব্যাখ্যা এবং সরলমনা মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টায় মেতে আছে।

আবহমানকাল থেকেই আমাদের বাংলাদেশে বহুধর্মের অনুসারী মানুষজন শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছেন। দেশের প্রচলিত আইনেও সকল ধর্মাবলম্বী নাগরিকের নিজ নিজ ধর্মপরিচয় নিয়ে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কিন্তু কোথাও কারো ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করা, কারো ধর্মপরিচয়কে বিকৃত বা অবমাননা করার কোনো রূপ বৈধতা নেই।

এ দেশে যুগ যুগ ধরে হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীরা মুসলমানদের পাশাপাশি বাস করে আসছেন। কোনো হিন্দু কখনো এ কথা বলেনি যে, তাদের ‘শ্রীকৃষ্ণ’ মুসলমানদের নবী মুহাম্মদের অবতার! কোনো বৌদ্ধ কখনো দাবি তোলেনি যে, মুসলিমদের পবিত্র কালেমায় ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর’ অর্থ ‘গৌতম বুদ্ধ’! কিন্তু আহমদীয়া তথা ‘কাদিয়ানী সম্প্রদায়’ এ জাতীয় অন্যায় দাবি করেছে!

এই সম্প্রদায়টির সৃষ্টিই হয় পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসকদের চাটুকারিতা ও গোলামীর সবক শেখানোর জন্য। এদের মাধ্যমেই ইংরেজ বেনিয়ারা এ দেশে মুসলমানদের মধ্যে ‘ডিভাইড এন্ড রূলের’ প্রতারণাপূর্ণ কূটকৌশল বাস্তবায়ন করেছিল। এদের প্রতিষ্ঠাতা ভারতের পাঞ্জাবনিবাসী নবুয়তের দাবিদার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (মৃত্যু: ১৯০৮ ঈ.) নিজেকে ইংরেজদের ‘রোপিত চারা’ বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত গর্ববোধ করত।

এরা সেই গোষ্ঠী যারা উপমহাদেশের সর্বভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম অর্থাৎ ‘ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের’ ঘোর বিরোধী ছিল। তার চোখে ‘অত্যাচারী বৃটিশের শাসন মহান আল্লাহর রহমত।’ অথচ দু’শো বছরব্যাপী সেসব রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ-সংগ্রাম না হলে আমাদের আজকের স্বাধীন বাংলাদেশেরও জন্ম হত না। দেশবাসী অবগত আছেন,ইতিহাসখ্যাত সেসব আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী ছিলেন শেরে বাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর মতো বিখ্যাত নেতৃবর্গ।

ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত এই চক্রটির আজো ইংরেজের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক রয়ে গেছে। আজো তাদের পঞ্চম খলীফা (!) মির্যা মাসরুরকে যুক্তরাজ্যের ‘ক্যাপিটাল হিলে’ ইংরেজ ম্যাডামদের সামনে অশুদ্ধ উচ্চারণে (!) কোরআন তেলাওয়াত করতে দেখা যায়। আজো তাদের বিরুদ্ধে যে কোন ‘শান্তিপূর্ণ’- সচেতনতামূলক কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হলেও সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে আমাদের স্থানীয় প্রশাসনের ফোনে ‘নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের’ (!) কল চলে আসে।

চরম বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কাদিয়ানী সম্প্রদায় তাদের নেতা মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী, মুহাম্মদ সা. এমনকি হিন্দুদের দেবতা কৃষ্ণ হিসেবে বিশ্বাস করা সত্তেও নিজেদের খাঁটি মুসলিম বলে পরিচয় দিচ্ছে। এমনকি সাধারণ মুসলমানদেরকে নিজেদের বিকৃত বিশ্বাসের দিকে প্রতারণাপূর্ণ দাওয়াত দেয়াকেও ‘বিশুদ্ধ ইসলামের প্রচার’ বলে দাবি করছে। শুধু তা-ই নয়, তারা মুসলিমদের ন্যায় নামায, রোযা ও সকল ইসলামি প্রতীক অবৈধভাবে ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত সরলমনা মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রতারণা করছে।

এহেন পরিস্থিতিতে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের কোটি মুসলিমের দাবি, কাদিয়ানীদেরকে ‘নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার রক্ষা আইনে’ রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম সংখ্যালঘু ঘোষণা করা হোক। তাদের জন্য ইসলাম ধর্মের সকল প্রতীক ও নিদর্শন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হোক। যাতে তারা নিজেদের কাদিয়ানী নবী ও নিজস্ব ধর্মপরিচয় নিয়ে অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ন্যায় স্বতন্ত্র জীবন যাপন করতে পারে এবং যেন এদেশের বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠী নিজেদের অবিকৃত ধর্মবিশ্বাস সুরক্ষিত ধর্মপরিচয় ও আইডেন্টিটি নিয়ে স্বাধীনভাবে বসবাসের অধিকার লাভ করেন।

প্রসঙ্গত, কেউ নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করলেই সে প্রকৃত মুসলিম হয়ে যায় না। ইসলামের সুনির্ধারিত ও প্রমাণিত সংজ্ঞা রয়েছে। কাদিয়ানী সম্প্রদায় মুসলিম কি অমুসলিম- সে প্রশ্ন অনেক আগেই মীমাংসিত হয়ে আছে। বিষয়টি সর্বস্বীকৃত ও সর্বজনবিদিত। (এখন শুধু সরকারি পদক্ষেপের অপেক্ষা! )

পবিত্র কোরআন, সুন্নাহ, ইজমায়ে উম্মত তথা ইসলামের মৌলিক নীতিমালার ভিত্তিতে এ সম্প্রদায়টি প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই অমুসলিম ও কাফের। এদের অনৈসলামিক আকীদা-বিশ্বাস সংক্রান্ত তথ্যাদি একত্র করলে দলিল-প্রমাণের পাহাড় জমে যাবে।

এদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে অবগত কোনো মুসলমানই তাদের মুসলিম মনে করে না। পৃথিবীর সকল আলেম তাদেরকে কাফের বলেন। ১৯৭৪ সনে মুসলিম বিশ্বের ১৪৪টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের উপস্থিতিতে ‘রাবেতা আলমে ইসলামীর’ উদ্যোগে ইসলামের পুণ্যভূমি পবিত্র মক্কা নগরীতে কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ অমুসলিম ঘোষণা করা হয়।

পুনঃবিবেচনার জন্য বিষয়টি আলোচনায় আনার কোন প্রয়োজন বা অবকাশ নেই। তবে সম্প্রতি পঞ্চগড়ে ‘জাতীয় ইজতেমা’ নামে তাদের বাৎসরিক জলসাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী যে উত্তেজনা বিরাজ করছে সে প্রেক্ষিতে অনেককেই তাদের মুখরোচক কথায় বিভ্রান্ত হয়ে এ ধরণের প্রশ্নও করতে দেখা যাচ্ছে যে, তারা কেন কাফের! তাদের কুফুরীগুলো কী?

তাই এ সম্প্রদায়ের মুখোশ উন্মোচনের লক্ষ্যে আমরা তাদের কাফের হওয়ার কারণসমূহ আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
কাদিয়ানীরা কেন কাফের?

এক. আকীদায়ে খতমে নবুওতের ( মুহাম্মাদ সা. শেষ নবী হওয়া) অস্বীকার
কুরআন-সুন্নাহ ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমতে আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সা. সর্বশেষ নবী। তাঁর পর আল্লাহ তাআলা আর কাউকে কোনো প্রকারের নবুওতে ভূষিত করবেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا }
অর্থ: “মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।”( সূরা আহযাব: ৪০)

সকল মুফাসসির এ ব্যাপারে একমত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। তাঁর পর কোনোভাবেই আর কেউ নবী হতে পারবে না। বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা হাফেয ইবনে কাছীর রহ. এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, এ আয়াত থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর আর কোনো নবী নেই। রাসূল হওয়া তো দূরের কথা। আর এ বিষয়ে সাহাবা কেরাম এর সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ ‘মুতাওয়াতির’ (অকাট্য) পর্যায়ের। -তাফসীরে ইবনে কাছীর- খণ্ড ৩,পৃ: ৫৪২)

নবী করীম সা. স্পষ্টভাবে বলেছেন যে তিনি শেষ নবী।
“বনী ইসরাঈলদের নেতৃত্ব দিতেন স্বয়ং তাদের নবীগণ। যখনই কোন নবী ইন্তিকাল তখন আল্লাহ তায়ালা অন্য কোন নবীকে তার স্থলাভিষিক্ত করে দিতেন। কিন্ত আমার পরে কোন নবী নেই, তবে খলীফা থাকবে, তাদের সংখ্যা অনেক হবে। – বুখারী, হাদীস নং: ৩৪৫০)

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত অন্য এক হাদীসে রাসূল সা. বলেন- “আমার পূর্ববর্তী নবীদের তুলনায় আমার দৃষ্টান্ত এরূপ, যেমন- কোন ব্যক্তি একটি ঘর তৈরি করেছে এবং সে ঘরটি সৌন্দর্য-মণ্ডিত ও চাকচিক্যময় করেছে। কিন্তু একটি কোণে নির্মাণের সময় একটি ইটের জায়গা শূন্য রেখেছে। লোকজন আনন্দে উৎসাহে তা দেখতে আসে এবং সন্তুষ্ট ও বিস্মিত হয়ে বলতে থাকে যে, এই একটি ইট কেন সংযোজন করা হয়নি (তাহলে ঘরের নির্মাণ কাজ পূর্ণাঙ্গ হতো)। সুতরাং আমি সেই শূণ্যস্থান পূর্ণকারী (আমার দ্বারা নবুওতের ইমারত পূর্ণ হয়েছে) আমিই শেষ নবী। (বুখারী-মুসলিম)

উপরোক্ত হাদিসটিতে রাসূল সা. অত্যন্ত সহজভাবে উদাহরণের মাধ্যমে তাঁর শেষ নবী হওয়ার আকীদা বুঝিয়েছেন। যার পরে আর কোনো অস্পষ্টতা থাকতে পারে না।

হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- “সকল নবীর উপর আমাকে ছয়টি বিষয়ে অধিক সম্মান প্রদান করা হয়েছে। এক. আমাকে অল্প শব্দে বিপুল তাৎপর্য বোঝাবার যোগ্যতা প্রদান করা হয়েছে। দুই. শত্রু পক্ষের মনে ভীতির সৃষ্টি করে আমাকে সাহায্য করা হয়েছে। তিন. আমার জন্য গণীমতের মাল-দৌলত হালাল করা হয়েছে। চার. আমার জন্য সমস্ত ভূখণ্ড মসজিদ ও পবিত্রস্থান, অন্য কথায় নামাযের স্থান করা হয়েছে। পাচ. সমস্ত সৃষ্টির নিকট আমাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। ছয়. আমার দ্বারা নবুওতের সমাপ্তি করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম)

এছাড়া আরো অনেক আয়াত-হাদীসে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খতমে নবুয়ত অত্যন্ত সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে। তাই প্রায় দেড় হাজার বছর যাবত গোটা মুসলিম উম্মাহ্ ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ অকাট্য ও অবিচ্ছিন্ন সূত্রপরম্পরায় প্রাপ্ত ‘খতমে নবুওতের’ এ বিশ্বাস মনেপ্রাণে লালন করে আসছে। খতমে নবুওতের আকীদা ইসলামের অন্যতম প্রধান আকীদা। এর অস্বীকারকারী কাফের। কাদিয়ানী সম্প্রদায় এ আকীদা অস্বীকার করে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীকে নবী বিশ্বাস করে কীভাবে মুসলমান থাকতে পারে?

মির্যা কাদিয়ানী বলেছে, যে ধর্মে ওহী জারি নেই সে ধর্ম মৃত। এর মানে সে খতমে নবুয়তের আকীদাকে বাতিল করে এবং ইসলামকে মৃতধর্ম আখ্যা দিয়ে নিজ প্রবর্তিত মতবাদকে জীবিত আখ্যা দিতে চায়!

অন্যস্থানে কাদিয়ানী বলেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে নবুয়ত পেতে হলে তাঁর অনুগত হতে হবে। এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে নবুয়তের দরজা খোলা রয়েছে। (?)

কাদিয়ানী সম্প্রদায়ে দ্বিতীয় খলীফা, মির্যা কাদিয়ানীর বড় ছেলে মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদ বলেছে, “রাসূল সা. এর পরে একজন কেন, আমার দাবি, তাঁর পরে হাজারো নবী আসতে পারে”। -আনোয়ারে খেলাফত : ৬২

মির্যা মাহমুদ আরো বলেছে- “যদি আমার গরদানের দুইপাশে তরবারী রেখে আমাকে বলা হয় যে, বলো, রাসূল সা.-এর পরে কোনো নবী আসবে না তাহলে আমি তাকে এ কথাই বলবো যে, তুই মিথ্যাবাদী। -আনোয়ারে খেলাফত ৬৫

প্রিয় পাঠক, যেখানে স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, তাঁর পর কোনো নবী নেই; সেখানে কাদিয়ানীদের স্পর্ধিত আকীদা হলো, তাঁর পর হাজারও নবী হতে পারে!! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এ কত বড় ধৃষ্টতা!!

মির্যা মাহমুদ বলেছে, “গোটা জগতকে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দাও, কাদিয়ানে একজন নবী আবির্ভূত হয়েছেন, তার নাম মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী।” -বদর পত্রিকা ১৯/১/১৯১১ঈ., নবুওত ও খিলাফত পৃ: ৭৭

সে আরো বলেছে, “আল্লাহ আমাকে এক কাশফে মুখোমুখি বা সামনা সামনি বলেছেন,প্রতিশ্রুত মাসীহ একজন নবী।” -(আল ফযল, ২৩ /৯/ ১৯১৫ ঈ.। -নবুওত ও খিলাফত, পৃ: ৭৮)

প্রত্যেক আহমদীর বিশ্বাস: “শোনো, প্রত্যেক আহমদী এ বিশ্বাসে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, সেই পবিত্র, মহৎ ও ধর্মভীরু ব্যক্তিত্ব যাকে অনেকে মির্যা কাদিয়ানী বলে থাকে তিনি আল্লাহর মনোনীত একজন নবী। -নবুওত ও খিলাফত, পৃ: ১৭

দুই. মির্যা কাদিয়ানীর নবুয়ত দাবি
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টরূপে ঘোষণা দিয়েছেন,‘আমিই শেষ নবী। আমার পর আর কেউ নবী হবে না।’ (সহীহ বুখারী, ৩৪৫৫,৩৫৩২, ৪৪১৬) উম্মতে মুসলিমা চৌদ্দশ’ বছর যাবত এ অকাট্য আকীদা লালন করে আসছে। অপরদিকে মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে নবী বলে দাবি করে। আমরা তার নবুয়ত দাবি প্রসঙ্গে কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরছি :

“আল্লাহর আদেশ মোতাবেক আমি একজন নবী। আমি এই দাবি অস্বীকার করলে আমার পাপ হবে।” (মির্যার মৃত্যুর দু’দিন আগে ‘আখবারে আম’ পত্রিকায় তার এই চিঠি ছাপা হয়। -নবুওত ও খিলাফত, পৃ: ৭৬

“পৃথিবীতে একজন নবী এসেছেন। এরূপে বারাহীনে আহমাদীয়াতে আরও বহু স্থানে আমাকে রসূল বলে সম্বোধন করা হয়েছে।” -এক গলতি কা ইযালা : পৃ. ৪

“সুতরাং আমি যখন আজ পর্যন্ত খোদার নিকট থেকে প্রায় দেড়শত ভবিষ্যদ্বাণী লাভ করে স্বচক্ষে পূর্ণ হতে দেখেছি। তখন আমার নবী ও রসূল হওয়া আমি কীরূপে অস্বীকার করতে পারি।” -এক গলতি কা ইযালা : পৃ. ৮

“আমি ঐ খোদার কসম করে বলছি যার হাতে আমার জীবন, তিনিই আমাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আমার নাম ‘নবী’ রেখেছেন।” -তাতিম্মায়ে হাকিকতুল ওহী, রূহানী খাযায়েন খণ্ড: ২২, পৃ. ৫০৩

তিন. মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ হওয়ার দাবি করেছে মির্জা কাদিয়ানি !
মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর নবুয়ত দাবির বিষয়টি তার স্বলিখিত উদ্ধৃতির বরাতে আমরা পূর্বে উল্লেখ করে এসেছি। যেগুলো পড়ার পর কোনো ন্যায়নিষ্ঠাবান ব্যক্তির এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে নবী দাবি করেনি।

কিন্তু অত্যন্ত আফসোসের বিষয় হলো, সে শুধু নবী হওয়ার দাবি করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং সকল মুসলমানের হৃদয় ও ঈমানী চেতনায় আঘাত হেনে এমন এক জঘন্য দাবি করেছে, যা কল্পনা করলেও ঈমানদার মুসলমানের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। যার অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের প্রতি ন্যূনতম ভালোবাসাও রয়েছে, সেও এমন অবমাননাকর বক্তব্য শুনে স্থির থাকতে পারবে না। কী সেই দাবি ? তা হলো, মির্র্যা কাদিয়ানী নবুওত দাবির পাশাপাশি স্বয়ং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ হওয়ার দাবি করেছে।(নাউযুবিল্লাহ!)

আল্লাহ তায়ালা রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সাহাবায়ে কেরামের প্রশংসা করতে গিয়ে ‘সূরা ফাত্হ’ এ বলেন,
مُحَمَّدٌرَسُولُاللَّهِوَالَّذِينَمَعَهُأَشِدَّاءُعَلَىالْكُفَّارِرُحَمَاءُبَيْنَهُمْ
“মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামআল্লাহ তায়ালার রাসূল। আর যারা তার সঙ্গে আছে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র।” (সূরা ফাত্হ, আয়াত-২৯)

উল্লেখিত আয়াতটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁর ও তাঁর সাহাবাদের সম্পর্কেই আলোচনা হয়েছে আয়াতটিতে। কিন্তু মির্যা কাদিয়ানী হুবহু এই আয়াত নিজের উপর অবতীর্ণ হওয়ার দাবি করে বলেছে, এখানে আল্লাহ আমাকে “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” বলেছেন। লক্ষ করুন, “আবার এ পুস্তকেই উক্ত ওহীর সাথে এ ওহীও আছে, مُحَمَّدٌرَسُولُاللَّهِوَالَّذِينَمَعَهُأَشِدَّاءُعَلَىالْكُفَّارِرُحَمَاءُبَيْنَهُمْ
“মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহে ওয়াল্লাযীনা মাআহু আশিদ্দউ আলাল কুফফারে রুহামাউ বাইনাহুম” ”এ ঐশী বাণীতে আমার নাম “মুহাম্মাদ রাখা হয়েছে এবং রসূলও।” -এক গলতি কা ইযালা, রূহানী খাযায়েন, খণ্ড: ১৮, পৃ. ২০৭

কাদিয়ানী সম্প্রদায় মির্যা কাদিয়ানীকে ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-ই মনে করে থাকে। তাই মির্যা কাদিয়ানীর মেজ ছেলে মির্যা বশীর আহমাদ এম এ বলেছে- এ বিষয়ে কি কোনো ধরনের সন্দেহ থাকতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা কাদিয়ানে পুনরায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই অবতীর্ণ করেছেন? -কালিমাতুল ফছল পৃ: ১৫, লেখক, মির্যাপুত্র বশীর আহমাদ এম এ

সে আরো বলেছে- “সুতরাং মাসীহে মাওউদ (মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী) স্বয়ং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। যিনি ইসলাম প্রচারের জন্য পুনরায় দুনিয়াতে তাশরিফ এনেছেন।” -কালিমাতুল ফছল, পৃ. ৬৮

উপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি খুব ভালোভাবেই প্রমাণিত হয়ে গেল যে, মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ হওয়ার দাবি করেছে এবং তার অনুসারীরা সে দাবি মেনে নিয়েছে।

এখান থেকে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে,কাদিয়ানী সম্প্রদায় যখন ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ পাঠ করে নিজেদেরকে মুসলিম বলে জাহির করে তখন এর অর্থ কী হয়। এ বিষয়টিই মির্যা বশীর আহমদ এম এ-র বক্তব্যে এভাবে ব্যক্ত হয়েছে, “মাসীহে মাওউদ (তথা মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর) আগমনের পূর্বে (কালিমায় উল্লেখিত) মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর অর্থের মধ্যে শুধুমাত্র তাঁর পূর্বের নবীগণ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুত মাসীহের আগমনের পরে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর অর্থের মধ্যে নতুন আরেকজন রাসূলের সংযোজন ঘটেছে। … মোটকথা এখনও ইসলামে প্রবেশ করার জন্য কালিমা এটিই। তবে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে,প্রতিশ্রুত মাসীহের আগমনে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর অর্থের মধ্যে আরেকজন নবীর সংযোজন ঘটেছে।” -কালিমাতুল ফছল, পৃ. ৬৮

প্রিয় পাঠক, বক্তব্য একেবারেই পরিষ্কার। আমরা এর কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যেতে চাই না। তারা কালেমায় উল্লেখিত ‘মুহাম্মাদ’ এর মধ্যে মির্যা কাদিয়ানীকেও অন্তর্ভুক্ত বিশ্বাস করে। (নাউযুবিল্লাহ।) যদিও আজকাল এ সম্প্রদায়ের অনেকে এ বিষয়টি স্বীকারই করতে চায় না। বরং নিজেদের চিরাচরিত অভ্যাসানুযায়ী এ কথাকেও যথারীতি ওলামায়ে কেরামের অপপ্রচার বলে চালিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে।

আমরা কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে অনুরোধ জানাবো, উদ্ধৃতিটি আরেকবার পাঠ করে বলুন, এটা মুসলিম ওলামায়ে কেরামের অপপ্রচার না কি আপনাদেরই মির্যা বশীর আহমদের বক্তব্য!! তদ্রুপ যারা কাদিয়ানীদের মুখে ইসলামের কালেমা শুনে নরম হয়ে যান তারাও এদের শঠতা ও ধূর্ততা বুঝতে পারবেন।

পূর্ববর্তি সংবাদকাদিয়ানিদের পক্ষ-নেওয়া মন্ত্রী মুসলমানের জন্য কল্যাণকামী হতে পারেন না : মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া
পরবর্তি সংবাদআ.লীগের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ইসি সচিব