সাংবাদিককে আত্মহত্যার পরামর্শ ও সচিবের দায়!

জহির উদ্দিন বাবর ।।

সাংবাদিককে আত্মহত্যার পরামর্শ দিলেন রেলসচিব’ এমন একটি সংবাদ গত কয়েক দিন ধরে বেশ আলোচিত হচ্ছে। মূল ঘটনা হলো, বেসরকারি চ্যানেল সময় টিভির প্রতিবেদক নাজমুস সালেহী ট্রেনের অনিয়ম নিয়ে একটি প্রতিবেদন করতে চেয়ে বক্তব্য জানতে গিয়েছিলেন রেলসচিব মোফাজ্জল হোসেনের কাছে। সচিব প্রথমে সাংবাদিককে তথ্য দিতে না চাইলেও এক পর্যায়ে তার অধঃস্তন এক কর্মকর্তাকে ডেকে পাঠান। ওই কর্মকর্তা পরদিন সাংবাদিককে তথ্য দেবেন এমনটা জানিয়েছিলেন। তবে পরদিন যখন সাংবাদিক ওই কর্মকর্তার কাছে গিয়ে কোনো তথ্য পাননি সে বিষয়টিই জানাতে গিয়েছিলেন সচিবকে। কিন্তু সচিব রেগে গিয়ে সাংবাদিককে আত্মহত্যার পরামর্শ দেন।

সাংবাদিক সালেহী বলেন, ‘আমি সচিবকে বলতে গেলাম- ‘দুদিন ধরে স্যার ঘুরলাম। আপনি যাকে বলে দিয়েছেন তিনি কথা বলেননি। এখন আমি কী করব?’ তিনি বললেন, ‘আপনি এখন আত্মহত্যা করেন। একটা স্টেটমেন্ট লিখে যান যে, রেলের লোকেরা আমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না- এ মর্মে ঘোষণা দিলাম যে তারা কথা না বলার কারণে আমি আত্মহত্যা করলাম।’

সচিব অবশ্য পরবর্তী সময়ে তার এ কথার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি এটা তামাশাচ্ছলে বলেছেন। উল্টো সাংবাদিকের ওপর ‘ইস্যু বানানোর’ দায়ভার চাপিয়েছেন। সচিব যত ব্যাখ্যাই দিন না কেন,তার এই বক্তব্যটি যে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও খামখেয়ালিপনামূলক সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ সচিব পদটি ঠুনকো কোনো পদ নয় যেখানে বসে তামাশা করা যায়। অত্যন্ত দায়িত্বশীল একটি পদ। অনেক ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর চেয়েও গুরুত্ব বেশি রাখে সচিব পদটি। এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে এধরনের বাজে আচরণ যিনি করতে পারেন তার যোগ্যতা এবং পদে থাকার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তুমুল সমালোচনা হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থার দায়িত্বশীল ব্যক্তি সেই প্রতিষ্ঠানের তথ্য দিতে বাধ্য। সেটা যদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তাসংক্রান্ত হয় তাহলে ভিন্ন কথা। বর্তমান সরকারই তথ্য অধিকার আইনে তথ্য পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি তথ্য সরবরাহ না করলে আইনে জেল-জরিমানার দণ্ডের বিধানও রাখা হয়েছে। গণমাধ্যম কর্মীরা তাদের সাংবাদিকতার প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্য চাইতে যান এটা নতুন কিছু নয়। রাষ্ট্রের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি না হলে সেই তথ্য দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বাধ্য। কেউ সেই তথ্য গোপন করে উল্টো সাংবাদিককে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলে সেটা নিঃসন্দেহে অস্বচ্ছতা এবং আইনত দণ্ডনীয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন,তিনি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বেও নন। কোথাও কোনো অনিয়ম বা ঘাপলা থাকলে তাকে অবশ্যই জবাব দিতে হবে।

ওই সাংবাদিকের প্রতিবেদনটি ছিল ঢাকা-কলকাতা রুটে চলাচলকারী মৈত্রী এক্সপ্রেস টেনে বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে। সেই ট্রেনে প্রতিটি চেয়ার আসনের জন্য যাত্রীরা ৬৮ টাকা করে বাড়তি দিচ্ছেন। টিকিটের গায়ে যে খাতের কথা উল্লেখ আছে তাতে মোট ভাড়া আসে ২৪৩২ টাকা। অথচ মোট সংখ্যায় লেখা হয়েছে ২৫০০ টাকা। অতিরিক্ত ৬৮ টাকা কেন নেয়া হচ্ছে বা টাকাটি কে পাচ্ছে সেটাই ছিল প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য। প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে ৬৮ টাকা করে অতিরিক্ত নিলে বছরে প্রায় ৪২ লাখ টাকার অনিয়ম হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তবে সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তাই সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। বরং প্রথম দিন সাংবাদিক যখন বিষয়টি নিয়ে তার কাছে যান তখন তিনি ক্ষেপে যান। সাংবাদিককে উদ্দেশ করে বলেন,‘এই বিষয়ে আপনার এতো উৎসাহ কেন? নিয়মিত কলকাতা যে যায় সে জানতে চাইতে পারে। সে জানতে চাইলে আমরা বলে দেব। কারণ এই জন্য আমাদের কাছে একটা ব্যাখ্যা আছে। তবে আপনাকে আমরা কেন ব্যাখ্যা দেব। আপনার কি কোনো প্রয়োজন আছে! আপনি তো যাত্রীরা না।’ পরে অবশ্য সচিব ডেকে পাঠান রেলের অপারেশন বিভাগের উপ-পরিচালক মিয়া জাহানকে। তার কাছেও মেলেনি কোনো ব্যাখ্যা। পরদিন সাংবাদিককে যেতে বলেছিলেন মিয়া জাহান। কিন্তু সাংবাদিককে দেখে কৌশলে তিনি পালিয়ে যান। এ ব্যাপারটিই সাংবাদিক জানাতে গিয়েছিলেন সচিবের কাছে। তখনই তিনি সাংবাদিককে আত্মহত্যার পরামর্শ দেন।

একজন সচিবের ঔদ্ধত্যপূর্ণ এই আচরণই বলে দেয় প্রশাসনের হালচাল। শুধু রেলসচিবই নন,প্রশাসনের নানা স্তরে এমন স্বেচ্ছাচারী কর্তারা দোর্দণ্ড প্রতাপ নিয়ে বসে আছেন,যারা কাউকেই পরোয়া করেন না। সরকারপ্রধান যখন নতুন করে ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন তখনও সেই কর্তাব্যক্তিরা অনিয়মকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। এতে এক শ্রেণির সরকারি চাকুরে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়ার খবর আমরা অহরহ পাচ্ছি। একজন সাধারণ পিয়ন কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছেন সেই খবরগুলোও সংবাদ মাধ্যমের বদৌলতে আমাদের কাছে পৌঁছছে।

বর্তমানে গণমাধ্যমের হাত-পা বাঁধা; সরকারি হস্তক্ষেপের চেয়ে সেলফ সেন্সরশিপই বেশি। এর মধ্যেও ফাঁকফোঁকর দিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের যে চিত্র চলে আসছে তা রীতিমতো আতঙ্কিত হওয়ার মতো। এবারও বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণা সূচকে আমাদের কয়েক ধাপ অবনতি হয়েছে। অর্থাৎ গত এক বছরে দেশে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। আর এই দুর্নীতি বাড়ার পেছনে একটি বড় ভূমিকা সরকারি চাকুরেদের। সরকারি নীতিনির্ধারকেরা যতই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথিত জিহাদ ঘোষণা করুক আমলারা আন্তরিক না হলে তা কখনোই সম্ভব নয়।

সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে বসে থাকা দুর্নীতিবাজদের প্রধান শত্রু গণমাধ্যম। তাদের অপকর্মের ছিঁটেফোঁটা জনসম্মুখে চলে আসে গণমাধ্যমের কল্যাণেই। এজন্য তাদের মূল ক্ষোভটা মিডিয়ার ওপর। সুযোগ পেলেই মিডিয়া সংশ্লিষ্টদের ওপর সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটান। সাংবাদিকের সঙ্গে রেলসচিবের এই আচরণও সেই ক্ষোভের অংশ। সরকার সত্যিকার অর্থে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চাইলে এ ধরনের পদে বসে থেকে যারা দুর্নীতি ও অনিয়মকে প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। না হলে দুর্নীতিবিরোধী কথিত হুঙ্কার কোনো কাজে আসবে না। বরং সরকারের আন্তরিকতা নিয়েই জনমনে প্রশ্ন উঠবে।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, ঢাকা টাইমস

পূর্ববর্তি সংবাদপ্রমোদ ভ্রমণের আড়ালে… পিকনিকের বাসে বিপুল পরিমাণে ইয়াবা
পরবর্তি সংবাদনওগাঁয় বঞ্চিত কৃষক, ফুল কপির দাম দুই টাকা