এক জাহালমের ঘটনায় পুরো রাষ্ট্রের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের গায়ে দাগ লেগে গেছে : মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ

[জাহালম এক মজলুম কারানির্যাতিত ব্যক্তি। দুদকের মামলায় তিন বছর অন্যায়ভাবে-ভুলভাবে কারাবন্দি থেকে সম্প্রতি উচ্চ আদালতের ঘোষণায় দায়মুক্তি লাভ করে কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন। অন্য এক দোষীর বদলে তাকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। এই ভুয়া শাস্তি ও ভুল ‘অপরাধী’ সনাক্তের বিষয় নিয়েই এখন আলোচনা দেশজুড়ে। এই মজলুম জাহালমের জুলুমের ঘটনা নিয়ে মতামত ও বিশ্লেষণ জানতে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার রঈস, মাসিক আলকাউসার-সম্পাদক মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহর সামনাসামনি হয়েছিল ইসলাম টাইমস। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আবু তাশরীফ]


 

ইসলাম টাইমস : জাহালাম এখন মুক্ত। দুদকের মামলায় তাকে বিনা দোষে কারাগারে কাটাতে হয়েছে তিন বছর। অন্য একজনের বদলে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তাকে। মজলুম এই মানুষটি এখন সংবাদ শিরোনাম। তার সঙ্গে যে আচরণ হয়েছে, ভুল তদন্ত, ভুল শাস্তি- এ সম্পর্কে আপনার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ : জাহালামের ঘটনাটি সম্পর্কে শুরুতেই যে কথাটি বলতে হয়- এ জাতীয় ঘটনা স্বাভাবিক জ্ঞানবুদ্ধি থেকে গ্রহণ করা যায় না। নিরীহ ও নির্দোষ কোনো লোককে কারাগারে পাঠানোর অর্থ শুধু তাকেই শাস্তি দেওয়া নয়, তার সঙ্গে আরো অনেক দুর্ভোগ যুক্ত হয়। এ এক জঘন্য অপরাধ। কোনো মানুষকে এভাবে কারাগারে পাঠানোর পর তার ইমেজের ক্ষতি হয়, তার আয়-রোজগার বন্ধ হয়, পরিবারে দুর্দশা নেমে আসে। আর এটি শুধু তার একার পরিবারে ঘটে না, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরো কয়েকটি পরিবারে দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসে। পরিবারগুলো বিপর্যস্ত হয়ে যায়। জামিনের চেষ্টা, আদালত, কারাগার- এসবের পেছনে তাদের দৌঁড়াতে হয়, অর্থ-সময় ও সম্মান নষ্ট হয়। আর এই ঘাঁটিগুলোও যে কত কষ্টের, কত নির্মমতার- ভুক্তভোগী মাত্রই তা জানেন।

ইসলামের বিধান হচ্ছে- ‘একজনের বোঝা অপর জন বহন করে না।’ (لا تزر وازرة وزر اخرى)ইসলামের চোখে ও কোনো সভ্য সমাজের বিবেচনায় এ জাতীয় ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ইসলাম টাইমস : তাকে ভুলভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করা হলো, গ্রেফতার করা হলো, বারবার আদালতে হাজির করা হলো, জাহালম নিজেকে নিরপরাধ দাবি করলেন- তার পরও দুদক তার দিকে কর্নপাত করল না। এ ব্যাপারগুলোকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ : সংবাদপত্র থেকে জানা গেছে, মূল আসামির নাম আবু সালেক। তার সাথে জাহালামের নামেরও মিল নেই। জাহালম নিজেকে নির্দোষ হিসেবে দাবি করেছেন। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা শোনেননি তার কথা। দুদক তার পেছনেই লেগে ছিল। এখানে অন্য একটি ব্যাপার সামনে চলে আসে। অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে- এটা ঠিক আছে। জাহালম যদি অপরাধ করতেন তাকে শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ ঠিক ছিল। দুদক একটি বড় প্রতিষ্ঠান। জাতীয় প্রতিষ্ঠান। সততা ও আস্থার কেন্দ্রে থাকার কথা ছিল এই প্রতিষ্ঠানটির। ব্যাংকিং খাতে কয়েক কোটি টাকার জালিয়াতির অপরাধে জুটমিলের একজন কর্মীকে ভুলভাবে ধরার জন্য তারা এত উদ্যম ব্যয় করলেন, খোঁজ করলেন, গ্রেফতার করলেন, কিন্তু শত শত কোটি টাকার ব্যাংক ঋণখেলাপি তো এদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা কত কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। ঝামেলায় পড়লে এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আরেক ব্যাংকে ঋণ পুনঃতফসিল করে থাকে। সেসব খেলাপিরা ব্যবসা, বাণিজ্য ও ক্ষমতায় বড় জায়গায় আছে বলে সেদিকে দুদকের চোখ যায় না অথবা এত সক্রিয় থাকে না। এটা তো দুঃখজনক।

দেখুন, ৯ ডিসেম্বর-১৮ তারিখের পত্রপত্রিকায় একটি খবর এসেছে- ১০ বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকখাতে লোপাট হয়েছে। সেদিকে দুদকের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের চোখ গেলে জাতির উপকার হতো। জাহালম মফস্বলের একজন মানুষ, আসল অপরাধী হলেও কথা ছিল, তাকে ভুলভাবে হয়রানি করা হলো, শাস্তি দেওয়া হলো। অথচ রাজধানীর বুকে বসবাসকারী রাঘব-বোয়ালদের দিকে তাদের চোখ এত সক্রিয়ভাবে যায় না। বড় প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা কীভাবে অটুট থাকবে!

ইসলাম টাইমস : দুদকের তো ভুল ছিলই, পরে তাকে আদালতে উঠানো হয়েছে, সেখানেও তাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। বারবার হাজিরা হয়েছে, তিনি তার নির্দোষিতার আবেদন জানিয়েছেন। তারপরও তাকে আরো মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ : এটা আসলেই বেদনাদায়ক। দুদকের তদন্তে ভুল হলো, মামলা হলো, আদালতে উঠানো হলো, বারবার আদালতে আনা-নেওয়া হলো, এতগুলো ধাপ বা স্তর পার হলো- তারপরও তারা কীভাবে আবু সালেকের জায়গায় জাহালমকে জেলে ঢুকাতে পারল? দুদকের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত বিবরণ বা অভিযোগের ব্যাপারে আদালতের প্রশ্নহীনভাবে আস্থা রাখার অভিযোগ জোরালো হয়েছে এতে। আমার মনে হয়, এক জাহালমের ঘটনায় পুরো রাষ্ট্রের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের গায়ে দাগ লেগে গেছে। দুদক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, তদন্ত, আদালত, কারাগার- এ সবগুলো প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা এ ঘটনায় সামনে চলে এসেছে।

ইসলাম টাইমস : আপনি কি জাহালমের ঘটনাকেই এধরনের প্রথম ঘটনা মনে করেন?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ : না, এটা প্রথম ঘটনা নয়, শেষ ঘটনাও নয়। এখনও হয়তো অনেক ঘটনা এ রকম পাওয়া যাবে। লোকে আগে বলত- ‘নামে নামে যমে টানে’। একজন অপরাধীর সঙ্গে নামের মিল থাকার কারণে আরেকজন আটকে যায়। কিন্তু এখানে তো নামেরও কোনো মিল ছিল না। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনকে আটক করে নিয়ে যায়। বিভিন্ন বিশেষ পরিস্থিতিতে এ ব্যাপারটা ঘটে। বহু নির্দোষ লোক তখন আটক হয়- অনেকের শাস্তি হয়।

ইসলাম টাইমস : জাহালমের ঘটনাকে অবিচার বলি আর জুলুম বলি- এসবের ফলে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় কী কী ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করেন?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ : এসব অবিচারের ঘটনা নাগরিকদের মনে ভীতি ও অনাস্থা তৈরি করে। তদন্ত, বিচার- এসব জায়গায় গিয়েও যদি নির্দোষ মানুষ নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে না পারে, নিজের অবস্থান তুলে ধরতে না পারে- তাহলে তাদের প্রতি মানুষের আস্থা কতটা তলানিতে গিয়ে ঠেকতে পারে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

দুর্নীতি দমন কমিশন আগে ছিল না। ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরো। তখন বলা হতো- সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় এই ব্যুরোতে। আস্থা সৃষ্টির জন্য কমিশন গঠন করা হলো। সেই কমিশনের মামলায় ভুয়াভাবে ও ভুল ব্যক্তিকে জেল খাটালে এই কমিশনের প্রতি আস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারে! সভ্য সমাজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এজাতীয় আচরণ। সর্বশেষ স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পূর্ণ হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় কাঠামো, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মজবুত ও দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারল না- এ ঘটনা আরেকবার সে আক্ষেপ ছড়িয়ে দিল।

ইসলাম টাইমস : দীনি দৃষ্টিকোণ থেকে এ জাতীয় অবিচার ও জুলুমের ফলে কী কী ক্ষতি হতে পারে?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ : হাদিস শরিফে আছে, মজলুমের বদদোয়াকে ভয় করো (اتق دعوة المظلوم)। জাহালমের মায়ের কথা সংবাদপত্রে এসেছে। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ যেন এই অবিচারকারীদের বিচার করেন।’ দুনিয়াতে অবিচারকারী-জালেমরা ভয় পায় না। কারণ, আল্লাহ তাআলা ঢিল দেন, অবকাশ দেন। অথচ এসবের শাস্তি ও ক্ষতি মারাত্মক। দুনিয়াতেও ভুগতে হয়। খবরের কাগজে দেখা যায়, বিভিন্ন গায়েবি মামলায় যারা হয়রানির শিকার হয়ে আদালতে আসছেন, তারা বলছেন- ‘ওপরওয়ালা একজন আছেন, তিনি সব দেখছেন।’ এগুলো হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সুরাহা বা সমাধা না হওয়ায় অবিচারের শিকার মানুষের দীর্ঘশ্বাস। স্বাভাবিক ইনসাফ পেলে এই আহাজারি তাদের মাঝে হয়তো থাকত না। মজলুমের এই আহ্ বা হাহাকারের প্রভাব অনেক। যখন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই দীর্ঘশ্বাস ও আহ্ উচ্চারিত হয়- তখন ওই ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যখন কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের গোড়ার বিরুদ্ধে এই আহাজারি উচ্চারিত হয় তখন সেই আহাজারির তাপ থেকে কেউ বাঁচতে পারে না। পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর তার চাপ ও তাপ ছড়িয়ে পড়ে।

ইসলাম টাইমস : এসব অবিচার থেকে বাঁচার পথ বা উপায় কী?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ : রাষ্ট্র তার কাঠামোগুলোকে যদি দৃঢ় ও মজবুত করে তাহলে এসব থেকে বাঁচা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু একশ্রেণির আমলাতন্ত্রের অনীহার কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সেই দৃঢ়তা তৈরি হয় না। যারা এমন অবিচার করেন- তাদের নিজেদের ওপর আর্থিক জরিমানা ও শাস্তি কার্যকর করার ব্যবস্থা থাকা দরকার। জাহালমের ঘটনায় কেউ কেউ বলছেন, দুদকের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া দরকার। আমি মনে করি, দুদক ক্ষতিপূরণ দিলে সেটা জনগণের ওপরই যায়, রাষ্ট্রের ওপরই যায়। বরং ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত ওই কর্মকর্তাদের- ব্যক্তিগত তহবিল থেকে, রাষ্ট্রীয় ফান্ড থেকে নয়।

ইসলাম টাইমস : আপনি আমলাতন্ত্রকে দায়ী করে তাদের শাস্তির কথা বললেন। এ বিষয়টি যদি আরো স্বচ্ছ করতেন?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ : আমলাদের সবাই খারাপ নন। আমলাদের মধ্যেও অনেক সৎ ও কাজের মানুষ আছেন। কিন্তু যারা অবিচার করেন- তাদের প্রভাবটা সামনে আসে। আরেকটা ব্যাপার হলো, আমলাদের কারো দ্বারা অবিচার সংঘটিত হলে- তাদের বিরুদ্ধে সহজেই মামলা করার বা প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা নেই। নতুন আইনে রাষ্ট্রের আমলাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে অনুমতি নেওয়ার বিধান জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর অনুমতি নিতে হলে তো তাদের কাছ থেকেই নিতে হবে। তখন আর মামলা করা, প্রতিকার পাওয়ার সহজ পথ খোলা থাকে না। এ জন্যই রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের চেয়ারে বসে যারা অবিচারমূলক কাজ করেন এবং সেটা প্রমাণিত হয়- তাদের কঠোর জবাবদিহির মধ্যে আনা দরকার। তাদের অবিচারের শিকার যেসব মানুষ ভুক্তভোগী হন- সেসব মানুষের ক্ষতিপূরণ ওইসব আমলার পকেট থেকে দেওয়া উচিত। ব্যক্তিগত তরফ থেকে দেওয়া উচিত। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে তাদের পক্ষে দাঁড় করানো উচিত নয়।

পূর্ববর্তি সংবাদকারাগারে খালেদা জিয়ার এক বছর, বিএনপির দেশব্যাপী কর্মসূচি
পরবর্তি সংবাদখালেদা জিয়ার জেলে থাকা আইনি বিষয় : ওবায়দুল কাদের