মালয়শিয়ায় যেমন আছেন প্রবাসী বাংলাদেশি

মুকিম আহমাদ ।। মালয়েশিয়া থেকে

জীবিকার সন্ধানে, উন্নত জীবন-ব্যবস্হার আশায়, পরিবারের ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা ভেবে যুগ যুগ ধরে মানুষ একদেশ থেকে  অন্যদেশে পাড়ি জমায়। বাঙলি জনগোষ্ঠি বৃটিশ শাসনামল থেকেই মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর নানাপ্রান্তের নানাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মালয়েশিয়াও সে সময় থেকেই বাঙালিদের আগমন। ধারণা করা হয়, মালয়শিয়ায় সর্বপ্রথম অভিবাসী বাঙালির আগমন ঘটে ১৮০৩সালের দিকে। পেনাং অঞ্চলের শত বছরের পুরনো মসজিদ  ‘মসজিদ জামেক বাংলা’র স্থাপনকাল দেখে তাই মনে করা হয়।

পেনাংয়ের জর্জ টাউনে অবস্হিত এই মসজিদটির নির্মাণকাল ১৮০৩ খ্রি.। জনশ্রুতি রয়েছে, ইস্ট-ইন্ডিয়ার শাসনামলে তৎকালীন বাঙালি মুসলিমরা এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৮৬ সালে ৫০০ বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়শিয়ায় প্রবেশ করেন বৃক্ষরোপণ প্রকল্পে। পরবর্তীতে ১৯৯২ সনে মালয়শিয়া সরকার বাংলাদেশসহ আরও পাঁচটি দেশের সঙ্গে জনশক্তি রিক্রুট করার কল্পে চুক্তিবদ্ধ হয়। বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা আর কর্মনিষ্ঠায় মুগ্ধ ও আশ্বস্ত হয়ে মালয়শিয়ার বিভিন্ন কোম্পানি এবং সরাসরি সরকারি সহায়তায়  ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়শিয়ায় প্রবেশ করে।

IOM (International Organization of migration)-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ৩,৮৫,৪৯৬ জন বাংলাদেশি মালয়শিয়ায় বৈধ কাগজপত্র নিয়ে কাজ করছেন । বাংলাদেশি শ্রমিকরা শুরু দিকে নিষ্ঠা আর শ্রম দিয়ে মালয়শিয়ানদের মন জয় করে নিয়েছিলেন । সময়ানুবর্তিতা আর সততায় স্হানীয় লোকদের কাছে বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিলেন ।  তাই অতি অল্প সময়ে (১৯৯৯) মালয়েশিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিরা ৫৭ মিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিটেন্স দেশে পাঠাতে সক্ষম হন ।

বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকগণ সাধারণত যেসব পেশাতে কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন সেগুলো হলো, বৃক্ষরোপণ, পামওয়েল ও রাবার বাগান পরিচর্যা, ভবন-নির্মাণ, সড়কবৃদ্ধি (মেট্রোরেল পথ, এলআরটি, ফ্লাইওভার ) বিভিন্ন কারখানা (এ্যালুমিনিয়াম, কাঠের ফার্নিচার ইত্যাদি) হোটেল-রেস্টুরেন্ট।

এই পেশাগুলোতে সাধারণত ৯ ঘণ্টা বেসিক আওয়ারে কাজ করেন এক ঘণ্টার বিরতিসহ। প্রায় সবগুলো পেশাতেই অতিরিক্ত কাজের সুযোগ থাকে যা মূল সময়ের ‘দ্বিগুণ’ মূল্যে  পরিগণিত হয়।

ঘণ্টা হিসেবে নির্ধারণ করা হয় মূল বেতন। ৪৫-৭০ রিঙ্গিত পর্যন্ত হয়ে থাকে মূল বেতন। তবে অতিরিক্ত কাজের মাধ্যমে তা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু অনেক নির্মাণ-শ্রমিকরা তার প্রাপ্য বেতনটুকু পান না। যারা সরাসরি কোম্পানির মাধ্যমে কাজ করেন তারা শুধু মূল বেতন পেয়ে থাকেন কিন্তু যারা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে কাজ করেন তারা তাদের শ্রমের সবটুকু মূ্ল্য ভোগ করতে পারেন না।

তৃতীয়পক্ষ ভাল একটা অংশ রেখে দেয় । চলে শ্রমিক বেচাকেনা, চলে কর্মবিক্রি। বিশেষত নবাগত শ্রমিকেরা পুরনো শ্রমিকদের দ্বারা নানাভাবে প্রতারণার শিকার হয়। এই ক্ষেত্রে বিশেষ একটি সংঘবদ্ধ দল সক্রীয় রয়েছে মালয়েশিয়ায়। যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশী। তবে বিপরীতে সহযোগিতার মানসিকতা পোষণ করেন এমন অনেক বাংলাদেশিও রয়েছেন।

প্রায় সব পেশাতেই আবাসনের ব্যবস্হা থাকে। খাবারের আয়োজন করতে হয় নিজেদের। কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত আবাসন কখনও হয় নামমাত্র। বিভিন্ন পুরাতন কন্টেইনার, কখনও অস্হায়ী ক্যাম্পে শ্রমিকদের থাকতে দেওয়া হয়। দিনভর রোদে পুড়ে, হাড়ভাঙ্গা শ্রমে-ঘামে যখন ফেরেন এই কন্টেইনারগুলোতে, পুরনো ভাঙ্গা এসির অনিয়ন্ত্রিত তাপে অসুস্হ হয়ে পড়েন অনেকেই। থাকে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা। কোমল পানীয় ‘হান্ড্রেড প্লাস’ই হয়ে উঠে একমাত্র পথ্য। যদিও হেলথ কার্ডের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা শ্রমিকগণ পেতে পারেন সবকারি হাসপাতালে কিন্তু দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিড়ম্বনায় সবাই এড়িয়ে চলেন। তাই অনেকেই ভাগ হয়ে আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন। তবে কিছু কিছু কোম্পানি অভিজাত এলাকায় শ্রমিকদের জন্য বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে দেয়। সারাদিন কাজের ভারে নিস্তেজ শরীরে সন্ধ্যায় রান্নার আয়োজনের ঝামেলা এড়াতে নিকটবর্তী বাঙালি রেস্টুরেন্টেই হয়ে ওঠে একমাত্র ভরসা। আবার অনেকেই দলবেঁধে রুটিন করে রান্নার কাজ সারেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয় মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হলেও অর্থনীতিতে চায়নিজদের রয়েছে আধিপত্য। পরিতাপের বিষয় হলো বেতন-বোনাসের ব্যাপারে মালয় মালিকের তুলনায় ক্ষেত্রবিশেষ প্রবাসীরা চায়নিজ বসকেই পছন্দ করেন। তবে নামাজের অসুবিধার কারণে অনেকেই মুসলিম মালয় মালিকদের অধীনে কাজ করেন। কর্মবিরতির জন্য সাপ্তাহিক রোববার ছাড়াও  বছরজুড়ে রয়েছে সরকারি ছুটির দীর্ঘ তালিকা। বিশেষত ফেব্রুয়ারি মাসে চায়নিজদের নববর্ষ উপলক্ষে প্রায় এক সপ্তাহ ছুটি পান শ্রমিকরা। পান বারতি বেতন-বোনাস। কিন্তু দুই ঈদে ছুটি থাকে শুধু একদিন করে। কখনও একদিনও থাকে না ছুটি।

বর্তমানে মালয়শিয়াতে প্রায় দশ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন। চার লাখেরও বেশি শ্রমিকের বৈধ কাগজপত্র নেই। যাদের অধিকাংশই দেশি দালালদের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন এবং নিজেদের বৈধতা কাগজপত্র হারিয়েছেন। গত ২২ জুনের মালায়শিয়ান  ‘দ্য স্টার’ পত্রিকার  এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মালয়শিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রভাব খাটিয়ে এক লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের কাছ থেকে চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মাত্র দুই বছরে।  অগ্রণী এবং এনবিএল-এর তথ্যানুযায়ী গত ১৮ জুন পর্যন্ত মালয়শিয়া থেকে বাংলাদেশি প্রবাসীগণ প্রায় ৮১৩ কোটি ৭৬ লাখ ৪ হাজার ৫১১ টাকা পাঠিয়েছেন । যা মালয়শিয়ায় অবস্হিত অন্যান্য দেশের প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

পূর্ববর্তি সংবাদভয়াবহ বন্যার কবলে অস্ট্রেলিয়া
পরবর্তি সংবাদকলম্বিয়ায় ১০ ফার্ক বিদ্রোহী নিহত