শাহ মুহাম্মাদ খালিদ ।।
বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ঢাকার পথঘাটে থাকে অফিস ফেরত মানুষজনের ভিড়। এই ভিড় যখন শুরু হয় তখন নগরীর ফুটপাতজুড়ে এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। মূল সড়কে সারি সারি গাড়ি স্থির দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকা শহরের যে চিরকালীন চিত্র, সন্ধ্যার ওই সময়টাতে ফুটপাতও তাতে যোগ হয়। দোকানপাট এর ভিড়ে ফুটপাতে পায়ে হাঁটা লোকজনের পর্যন্ত জ্যাম বেধে যায়। ইংরেজি Footpath অর্থই হলো পায়ে হাঁটা পথ। যেখান দিয়ে মানুষ পায়ে হেঁটে আপন গন্তব্যে পথে যেতে পারেন। কিন্তু আমাদের ঢাকা শহরের নাগরিকেরা পড়েছেন উভয় সংকটে। রাস্তায় গাড়িতে করে যাত্রা করলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় জ্যামে নষ্ট হয়।
কত কাজ কত অনুষ্ঠান, আগ থেকে ঠিক করে রাখা কত আয়োজন, এক জ্যামের কারণে সব নষ্ট হয়ে যায়। জ্যাম অতিক্রম এর জন্য পায়ে হেঁটে যদি কেউ গন্তব্যে রওয়ানা করেন ফুটপাতে তাকে পড়তে হয় আরেক সংকটে। এ যেন আরেক পুলসিরাত। সারি সারি দোকান। সেই দোকানের সামনে টুল পেতে বসে থাকা হকার এবং সেখানে কেনাকাটার জন্য দাঁড়ানো ক্রেতা। এত মানুষ অতি সংক্ষিপ্ত জায়গায় যদি হাঁটাচলা বাদ দিয়ে এসব কাজ করেন তাহলে মূলত যাদের হাঁটাচলার জন্য ফুটপাত বানানো হয়েছে তাদের জন্য এ রাস্তাটা বড় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এর গায়ে ধাক্কা লাগে ওর কনুইয়ে গুঁতা লাগে। কখনো হকারের পাতা টুল এর সাথে পা ফসকে চিৎপটাং হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে পিছন থেকে পিপ পিপ শব্দ করে আসতে থাকে একের পর এক মোটরসাইকেল। এসব মোটরসাইকেল ফুটপাতে চলাচলকারি সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে। সব সময় তারা আতঙ্কে থাকে কোন্ সময় যেন পিছন থেকে মোটরসাইকেল গায়ের উপর তুলে দেয়। পাশাপাশি এত কাছ থেকে তাদের এ ধরনের পিপ পিপ আওয়াজ মারাত্মক বিরক্তি ও শব্দদূষণ উৎপাদন করে। ‘শর্টকার্টে কাজ সেরে ফেলার’ ধান্দায় এভাবে যারা ফুটপাতের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল তুলে দেন তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেকের।
২০১৭ সালে মন্ত্রিসভায় একটি খসড়া আইন পাস হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছে ফুটপাতে মোটরসাইকেল চালালে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল এবং ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কিন্তু এ ধরনের আইনকে আমাদের চালকেরা থোড়াই কেয়ার করেন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ঢাকা শহরের ৫০ ভাগ কেনাকাটা হয় ফুটপাত থেকে। সকালে যেখানে বসে মাছ ও তরিতরকারির বাজার বিকালে সেখানেই পসরা সাজিয়ে বসে হালিম-চটপটি থেকে শুরু করে জামাকাপড়, লুঙ্গি, হাড়ি-পাতিলসহ প্রায় সমস্ত জিনিসের। ফুটপাতে কী পাওয়া যায় না সেটাই ভেবে পাওয়া যায় না।
ফুটপাতের ব্যবসা জমজমাট হওয়ার বেশকিছু কারণ আছে। প্রথমত সহজেই পণ্যগুলো চলাচলকারী মানুষের নজরে পড়ে। দ্বিতীয়ত মার্কেট বা বাজারের চেয়ে দামও তুলনামূলক কম। কারণ মার্কেটে দোকানদারকে মাসিক বড় অংকের একটা ভাড়া গুণতে হয়। বিপরীতে স্থানীয় চাঁদাবাজ ও প্রভাবশালীদের দৈনিক হারে চাঁদা দিতে হয় ফুটপাতে। যা মূল মার্কেটের চেয়ে কম। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে ক্রেতাদের কাছে কিছুটা কম মূল্যে পণ্যটা বিক্রি করা যায়। এই কম মূল্যই ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে ফুটপাতের দোকানগুলোতে, যা সেখানকার ভিড়ের প্রধানতম কারণ। ঢাকায় এমন অসংখ্য হোটেল দেখা যায় যারা রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে কাস্টমারদের জন্য চেয়ার টেবিল পাতেন, আর পরোটা ভাজি, ডিম ভাজি থেকে শুরু করে সব ধরনের রান্নাবান্না হয় ঠিক ফুটপাতের ওপর চূলো বসিয়ে। রডের দোকানের রডগুলো পিটিয়ে সোজা করা হয় ফুটপাতে রেখেই।
এভাবে ঢাকাসহ দেশের শহরাঞ্চলে রাস্তার পাশে থাকা যে কোন দোকানদারই চেষ্টা করে দোকানের সম্মুখস্থ ফুটপাতের অ্যাডভান্টেজ নেয়ার। কখনো পথ চলতে গিয়ে কোন পথিক সমস্যায় পড়ে কিছু বললে তারা যে ধরনের আচরণ করেন তাতে মনে হয় এই ফুটপাত তাদের পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকার। এখানে কারো কিছু বলার নেই।
পত্রপত্রিকায় কিছু দিন পরপরই ফুটপাতের হকার উচ্ছেদের সংবাদ আসে। কিন্তু পরদিনই দেখা যায় সবকিছু আবারও আগের মত দখল হয়ে আছে। এর পেছনে কাদের হাত আছে, কাদের ছত্রছায়ায় হচ্ছে এসব, সেটা সবাই জানে। কিন্তু সমাধানে এগিয়ে আসে না কেউ।
এগুলোর দেখভাল করার জন্য জনগণের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয় যাদের পেছনে তারাও ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছাতে। মাঝখানে নাভিশ্বাস উঠে জনগণের, অবৈধ দখলদার আর তাদের শেল্টারদাতাদের মধ্যখানে চিড়েচ্যাপ্টা হয় নিরীহ পথচারী মানুষ। তারা তো এদেশে আছে এভাবে চিড়েচ্যাপ্টা হওয়ার জন্যই!