ইতিহাস ভুলেনি: ইতালির শাসক বেনিতো মুসোলিনি

তাকে বলা হয় ফ্যাসিবাদের জনক। একনায়কতন্ত্র এবং স্বৈরশাসনকে তিনি সাংবিধানিক ভিত্তি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তিনি ইতালির স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনি। ইউরোপের আরেক একনায়ক এডলফ হিটলারের সঙ্গে তার ছিল দারুণ সখ্য। দুজন মিলে পুরো ইউরোপ কব্জা করার ফন্দি করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে মুসোলিনির ইতালিও। সেই যুদ্ধই কাল হয় মুসোলিনির জীবনের। মুসোলিনির জীবনের এক ঝলক পাঠকের সামনে নিয়ে এসেছেন সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর ।

জন্ম ও বেড়ে উঠা: ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুলাই ইতালির ফোরলি শহরের ডোভিয়া ডি প্রিদাপ্পিয়ো গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেন বেনিতো এমিলকেয়ার আন্দ্রে মুসোলিনি। বাবা আলেসান্দ্রো মুসোলিনি সামান্য কামার। মা রোজা সংসার চালাতে শিক্ষিকার কাজ করতেন গির্জার ধর্মীয় স্কুলে। তিন সন্তানের মধ্যে বেনিতো মুসোলিনি সবার বড়।

পশ্চিম ইউরোপজুড়ে তখন সমাজতন্ত্রের জয় জয়কার। মুসোলিনির বাবা নিজেও ছিলেন বামপন্থী আন্দোলনের সমর্থক। যে কারণে ধর্ম নিয়ে মুসোলিনির ধার্মিক মায়ের সঙ্গে বাবার ঝগড়া হতো প্রায়ই। এ কারণে মা মুসোলিনিকে সেলাসিয়ান পাদ্রীদের দ্বারা পরিচালিত একটা বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেন শৈশবেই। পড়ালেখায় একদম মন্দ ছিলেন না, ১৯০১ সালে বেশ ভালো গ্রেড নিয়েই ওই স্কুল থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন তিনি। শিক্ষকতাকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে নেন।

সমাজতন্ত্রে দীক্ষা: ধার্মিক স্কুলে এতদিন পড়াশোনা করলেও বাবার কাছ থেকে পাওয়া সমাজতন্ত্রের দীক্ষা মনের মধ্যে গেঁথেই ছিল এতদিন। ফলে ১৯০২ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি সমাজতন্ত্রের তালিম নিতে চলে যান সুইজারল্যান্ড। সেখানে বামপন্থী বিভিন্ন দর্শন ও নেতার সংস্পর্শে আসেন। তবে নির্দিষ্ট কোনো কাজ না পাওয়ায় বেশ কষ্টে কাটতে থাকে জীবন। এর মধ্যে ১৯০৩ সালে এক মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে দুই সপ্তাহ জেলেও থাকতে হয়।

সুইজারল্যান্ডে সুবিধা করতে না পেরে মুসোলিনি আবার চলে আসেন ইতালিতে। কিন্তু বাম আন্দোলনের কারণে ইতালিতে এসেই পড়ে যান সরকারের কুনজরে। প্রশাসন থেকে শর্ত দেওয়া হয়, দুই বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করলে তার অপরাধ ক্ষমা করা হবে। অগত্যা ১৯০৬ সাল পর্যন্ত ইতালি সেনাবাহিনীতে কাজ করেন তিনি।

সুইজারল্যান্ডে গ্রেফতার হওয়া সময়ের ছবি

রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ: সেনাবাহিনী থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে যান শিক্ষকতা পেশায়। এ সময় তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু করেন। ১৯১০ সালে তিনি প্রথম একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন ‘লোট্টা ডি ক্লাসে’ নামে। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘শ্রেণি সংগ্রাম’। এরপর তিনি বিভিন্ন নামে একাধিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। লেখালেখির পাশাপাশি যোগ দেন ইতালিয়ান সোস্যালিস্ট পার্টিতে।

এর মধ্যে ১৯১৪ সালে ইউরোপজুড়ে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইতালি তখন যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স নিয়ন্ত্রিত মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। ইতালির এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় মুসোলিনির সোস্যালিস্ট পার্টি। কিন্তু মুসোলিনি মিত্রশক্তিকে সমর্থন জানিয়ে ইতালির হয়ে সরাসরি যুদ্ধে চলে যান। যুদ্ধে যাওয়ার কারণে সোস্যালিস্ট পার্টি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

ফ্যাসিবাদের উত্থান: যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইতালি এবং পুরো ইউরোপে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব। অধিকাংশ রাষ্ট্রের শাসকরা রাষ্ট্র চালাতে হিমশিম খেতে থাকেন। তখন মুসোলিনি চিন্তা করেন, একনায়কন্ত্র ছাড়া কোনোভাবেই কোনো রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে শক্তিশালী করা যাবে না। এই ভাবনা থেকেই তিনি ১৯১৯ সালের ২৩ মার্চ তার কিছু সঙ্গী-সাথী এবং রাজনৈতিক ও সামরিক চিন্তকদের নিয়ে গড়ে তোলেন নতুন দল ‘ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি’।

এ পার্টি থেকেই শুরু হয় মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ আন্দোলন। যার অর্থ হলো স্বৈরশাসন বা একনায়কতন্ত্র। ইতালিতে খুব দ্রুত এই আন্দোলন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালি ঋণের দায়ে এবং বেকারত্বের ভারে দেউলিয়া তখন। এমন মুহূর্তে মানুষ একজন কঠিন একনায়কন্ত্রী শাসকের প্রয়োজন বোধ করছিল।

রোমে ব্ল্যাকশার্ট আন্দোলনের নেতৃত্বে

অপরদিকে মুসোলিনির ছিল মানুষকে প্রভাবিত করার দারুণ ক্ষমতা। মাত্র তিন বছরের মাথায় তিনি এমন জনমত গঠন করেন যে ১৯২২ সালের ২২ অক্টোবর ইতালির মানুষ ক্ষমতা দখলের জন্য রাজধানী রোমের দিকে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। এই আন্দোলনকে বলা হয় ব্ল্যাকশার্ট আন্দোলন। ইতালির তখনকার সম্রাট ভিক্টর ইমানুয়েল কোনো উপায়ন্তর না দেখে ২৩ অক্টোবর মুসোলিনির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

মুসোলিনির স্বৈরশাসন: শুরু হলো মুসোলিনির ২৩ বছরের স্বৈরশাসন। শাসনগ্রহণের পর তিনি ইতালিকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেন। কেড়ে নেন মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তার বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ হিসেবে গন্য করা হতো। অর্থনীতি কেন্দ্রীভূত করে ফেলেন।

বৈদেশিক নীতিতে মুসোলিনি মনে করতেন, আন্তর্জাতিক শান্তি হল কাপুরুষের স্বপ্ন, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধনীতি হল জাতির প্রাণশক্তির প্রাচুর্যের প্রমাণ। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল—সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইতালিকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।

হিটলারের সঙ্গে মুসোলিনি

এ সময় তিনি জার্মানির আরেক স্বৈরশাসক এডলফ হিটলারের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। যেহেতু রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে তাদের দুজনের নীতি ছিল প্রায় অভিন্ন, এ কারণে তাদের বন্ধুত্ব হতে দেরি হয়নি।

পতন ও মৃত্যু: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪০ সালে মুসোলিনি বিনাদ্বিধায় হিটলারের জার্মানিকে সমর্থন করেন। তারা উভয়ে মিলে ইউরোপ ও আফ্রিকা শাসনের স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু তাদের এ স্বপ্ন খুব জলদিই দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।

১৯৪৩ সালে মুসোলিনি একদল ইতালীয় সেনার হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং তাকে বন্দী করা হয়। তবে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে হিটলারের জার্মান সেনাদের কারসাজিতে মুক্তি পান মুসোলিনি। তবে তার এ মুক্তি বেশি সময় স্থায়ী হয়নি।

১৯৪৫ সালের ২৭ এপ্রিল ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ডে পালানোর সময় ইতালির একটি ছোট্ট গ্রামে মিত্রবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি।

এর পরদিন ১৫ সহযোগীসহ তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরই সঙ্গে পতন ঘটে পৃথিবীর ইতিহাসে ফ্যাসিবাদ জন্ম দেয়া স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনির।

পূর্ববর্তি সংবাদ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে খালেদা জিয়ার কুমিল্লা মামলার জামিন নিষ্পত্তির নির্দেশ
পরবর্তি সংবাদফেব্রুয়ারিতে অভিন্ন ইজতেমা, আসছেন না মাওলানা সাদ