মালয়েশিয়ায় আরব মুসলিমরা কেমন আছেন?

মুকিম আহমাদ ।। মালয়েশিয়া থেকে

মালয়েশিয়ায় আরবদের আগমনের সূচনা বহুকাল আগে থেকেই । আরব বণিকেরা সপ্তম এবং  অষ্টম শতাব্দীতে মালয়শিয়ায় প্রবেশ করেন। বাণিজ্যের পাশাপাশি ধর্ম প্রচারেও ব্রত হন। সময়ের আবর্তনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলোতে আরব-মালয় বা আরব-ইন্দো মিশ্র বংশধারা বৃদ্ধি পেতে থাকে।  যদিও তারা নিজেদের মালায় বলেই পরিচয় দিয়ে থাকে। এই আরব জনগোষ্ঠীর প্রধান অংশটা মূলত ইয়েমেনের ‘হাদরামাওত’ অঞ্চল থেকে আগত। তাদেরকে সংক্ষেপে  ‘হাদরামী’ও বলা হয়। মালয়েশিয়ার কেডাহ, সাবাহ, সারওয়াক,  কেলান্তান,  জোহর প্রদেশেই হাদরামী-মালয়দের বসবাস বেশি।

ধর্মীয় আবেগ থেকেই মালয়েশিয়ার সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে আরবের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ও ভালবাসা বিদ্যমান। যা আমরা দেখতে পাই তাদের সামাজিক বিভিন্ন রীতিনীতি ও সংস্কৃতিতে । যেহেতু ইয়ামেনী আরবদের মাধ্যমে তারা ইসলামের দাওয়াত পেয়েছেন ও গ্রহণ করেছেন, তাই ইয়ামেনী আলেমদের সঙ্গে রয়েছে এদের গভীর হৃদ্যতা। ধর্মীয় উচ্চশিক্ষার জন্যও মালায় মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রচুর সংখ্যক সানআ এবং হাদরামাওতে গিয়ে থাকেন। তবে এই শিক্ষা –দীক্ষা  যতোটা না প্রাতিষ্ঠানিক তারচেয়ে বেশি খানকাহ্ ভিত্তিক।

শায়েখ হাবীব উমর বিন হাফিজ

মালয়েশিয়ার সাধারণ মুসলমানগণ ইয়ামেনী তাসাওউফ দ্বারা ভীষণ প্রভাবিত। মাগরিবী তাসাওউফও  (মরক্বো)চর্চিত হয় এখানে ব্যাপকভাবে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয় নানান অনুষ্ঠান। “ইহতিফাল মাওলিদুর রাসূল” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইয়ামেনী পীরসাহেদের এখানে  ‘হাবীব শেখ’ নামে সম্বোধন করা হয়। মালয়েশিয়াতে এই হাবীব শেখদের নিজস্ব মানহাজের মাদ্রাসাও রয়েছে প্রচুর। শিক্ষকদের বেশিরভাগই ইয়ামেনী বা ইয়ামেন ফেরত শিক্ষার্থী।  হাবীবদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আল হাবীব উমর বিন হাফিজ, যিনি ইয়ামেনের বিখ্যাত মাদ্রাসা ‘দারুল মুস্তফার’ প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল।  মালয়দের মধ্যে তার ভক্তের সংখ্যাই বেশি। আরও আছেন আল হাবীব আলী আল জিফরী।  হেজাযের শায়খ মুহাম্মাদ আলাবী আল মাক্কী রহ.-এরও অনেক ভক্ত রয়েছেন মালয়েশিয়ায়।

শায়খ আব্দুর রাজ্জাক আল মাসরী

ভিসার সহজলভ্যতা ও কর্মক্ষেত্রের চাহিদার কারণে মালয়শিয়ায় প্রচুর মিশরীয় প্রবাসী আছেন। যাদের উল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যা শিক্ষকতা করেন বিভিন্ন মাহাদে, বিশ্ববিদ্যালয়ে।আবার ব্যবসাও করেন অনেকে। ইলমে ক্বেরাআতে তাদের বিশেষ পাণ্ডিত্যের কারণে যুগযুগ ধরে তারা ব্যক্তিগতভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইজাযাহ ও সনদ দিয়ে আসছেন,  যা শায়খ পরম্পরায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত প্রলম্বিত। তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হলেন শায়খ আব্দুর রাজ্জাক আল মাসরী।  তাছাড়া রমজানে বড় বড় মসজিদগুলোতে আরবের ক্বারীসাহেবগণ তারাবীহর নামাজ পড়িয়ে থাকেন। আরবদের দীর্ঘ  সংস্পর্শ ও সংমিশ্রণের কারণে অতি সাধারণ থেকে সাধারণ পর্যায়ের মুসল্লীও কুরআন শোনায় এবং তেলাওয়াতে আরবীয়  ধারা ও মেজাজ ধারণ করেন।  ফলে রমজানে কুরআন নিয়ে নানাবিধ আয়োজন করা হয় স্থানীয় মসজিদগুলোতে।

আরবদের দীর্ঘ সহাবস্থানের কারণে মালয়েশিয়ার নাশীদ-শিল্পও অনেক সমৃদ্ধ। আশ্চর্যের বিষয় এই যে,  মালয়েশিয়ার মুসলিমগণ যতটা না মালায় না’ত-হামদ শোনেন তার চেয়ে অনেক বেশী শোনেন আরবী নাশীদ। আয়োজন করে আরবী নাশীদ, ক্বাসীদাহ ও শে’র-আশআ’র শোনা হয় মালয়েশিয়ায়।  ইয়ামেনী গায়ক যারা অনেকেই নাগরিকত্ব নিয়ে থাকেন তারা এইসব আসরগুলোর মধ্যমণি।অন্যান্য আরবের মুনশিদগণও আসেন বড় বড় নাশীদ -কনসার্টগুলেতে।  বলা যেতে পারে আরবী নাশীদ এখন মালয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে এখানকার বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগ -উৎকণ্ঠার অন্ত নেই। তারা বিভিন্ন সেমিনার করছে এই শ্লোগান নিয়ে “ to be a muslim, no need to be Arabian”। কিন্তু ফলাফল শূন্য।

আরব প্রবাসী মুসলিমগণ গত ত্রিশ বছরে মালয়শিয়ার রীতিনীতিতে এতটাই প্রভাব ফেলেছেন যে,  তাদের স্হানীয় পোশাক সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে আরবীয় পোশাক-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

লেখক : মুকিম আহমাদ

বেশিরভাগ প্রবাসী আরব মালয়শিয়াতে দ্বিতীয় বিয়ে করে থিতু হচ্ছেন আবার অনেক ইরাকী এবং সিরিয়ান হিজরত করে মালয়দের বিয়ে করে স্হায়ী হচ্ছেন। মালয় ধার্মিক মেয়েরাও আরব আলেমদের দ্বিতীয় পত্নী হতে উৎসাহী । ফলে আরব-মালয় মিশ্র প্রজন্ম দিনদিন বেড়ে চলছে মালয়েশিয়ায়।

তাছাড়াও সুদান, মরক্বো, সিরিয়ার অনেক আরবই আছেন মালয়শিয়াতে। শরণার্থী বা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী আছেন ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার অনেক আলেম উলামাও। কৃষি এবং গবাদিপশুর খামার প্রকল্পের বিশাল অংশই ধীরে ধীরে আরবদের অধীনে চলে যাচ্ছে।

এছাড়াও গোটা মালয়শিয়াতে এ্যারাবিয়ান রেস্টুরেন্টগুলোর আধিক্য চোখে পড়ার মতো। রেস্টুরেন্ট বাণিজ্যে থাইফুডের পর আরবদের আধিপত্য বিস্তৃত হচ্ছে।

মালয়েশিয়ার ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতির  নানা অঙ্গনে আরবদের প্রভাব এখন চোখে পড়ার মতো। এ প্রভাবের বিষয়টি এখানে সহজাত ও দৃঢ়মূল।

পূর্ববর্তি সংবাদকুমিল্লায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৮
পরবর্তি সংবাদমেক্সিকোতে তেলের পাইপলাইন বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ড: নিহত ৬৬