মাওলানা আবুল ফাতাহ রহ. ও তাঁর এক অসামান্য রচনা

মাওলানা তাহমীদুল মাওলা ।।

মাওলানা আবুল ফাতাহ রহ. রচিত ‘ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা’ গ্রন্থটি নিয়ে সামান্য পর্যালোচনা করবার উদ্দেশ্যে তাঁর লেখা বইগুলো উল্টে-পাল্টে দেখে মনে হল সামগ্রিকভাবে তাঁর রচনাবলীর বেশ কিছু স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। যা আগ্রহী পাঠক ও লেখক গবেষককেও আকর্ষণ করবে। তাই এখানে এর কিছুটা ইঙ্গিত করা হল।
১.বিষয় নির্বাচন : রচনার ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচনের সময় তিনি সব সময় এমন বিষয়কেই প্রাধান্য দিয়েছেন যার প্রয়োজন বেশি। এক্ষেত্রে কঠিন এবং দীর্ঘ সময় ও শ্রমসাধ্য বিষয় হলেও তিনি তা নির্বাচনে কার্পণ্য করেননি।
২. বিস্তর অধ্যয়ন : আমার ব্যক্তিগত জানাশুনা থেকে বলছি, তিনি যে বিষয়ে কাজ করার ইচ্ছা করতেন সে বিষয়ে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে সাধ্যমত সর্বোচ্চ পড়াশুনার চেষ্টা করতেন। যে কোন সচেতন পাঠকও বিষয়টি আঁচ করতে পারবেন সহজেই।
৩. তুলনামূলক বিশ্লেষণ : তাঁর রচনায় আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইসলামী ভাবধারার বাইরের জগতের লেখকদের বই-পুস্তকও সামনে রেখেছেন। দুয়ের মাঝে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে ইসলামী ধর্ম-দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এজন্য তিনি ইংরেজি ভাষায় রচিত বই-পুস্তকেরও যথেষ্ট সহযোগিতা নিয়েছেন।
৪. শাস্ত্রীয় লোকদের সহযোগিতা : তাঁর প্রায় রচনাতেই তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ সহযোগিতা ও মতামত নিয়েই প্রস্তুত করেছেন। বিশেষ করে আধুনিক বিষয়ের ক্ষেত্রে জাগতিক দিক থেকে উচ্চশিক্ষিত প্রাজ্ঞ লোকদের সামনেও সহসের সাথে নিজের কর্ম তুলে ধরেছেন এবং তাদের উচ্চ প্রশংসাও কুড়িয়েছেন।
৫. সহজ উপস্থাপন : ইতিহাস, ধর্ম-দর্শনের মত কঠিন কঠিন বিষয়গুলোও তিনি অত্যন্ত সহজ ও সাবলীলতার সাথে তুলে ধরেছেন।

ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা
‘ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা’ আমার উস্তায মাওলানা আবুল ফাতাহ রহ. রচিত একটি সময়োচিত শ্রেষ্ঠ কর্ম।২০০১ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশের হাইকোর্ট থেকে সব ধরণের ফতোয়া নিষিদ্ধ করে একটি রায় প্রকাশ পায়। সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম এ রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। গঠিত হয় ‘ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি’। এ আন্দোলনে তৎকালীন সরকার বেকায়দায় পড়ে যায় এবং পরবর্তী নির্বাচনে তাদের চরম ভারাডুবি হয়। কিন্তু তার পরও প্রায় দশ বছর পর ২০১১ সালের ১৯ মে আদালত ফতোয়া বিরোধী এ রায় বাতিল ঘোষণা করে।

এ সময়টার মধ্যে আমাদের দেশে ফতোয়া ইসলামী আইন ও বিচার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনা চলতে থাকে। তখন সাধারণ উচ্চশিক্ষিত ও পড়াশুনামুখী ধার্মিক লোকদেরকেও দেখা যায় ইসলামী আইন ও বিচার বিষয় নিয়ে এমন এমন মন্তব্য করতে যা তাদের থেকে কখনোই কাম্য ছিল না। তাদের এ ধরণের উক্তির প্রধান কারণ হল সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের অভাব।

২০১১ সালে ফতোয়া বিরোধী রায় বাতিলের সময় ফতোয়া বিরোধী রায়ের বিচার বিশ্লেষণ ও এর দলিল প্রমাণ সরবরাহ করে আইনজীবিদের সহযোগিতা করা হয় ঢাকার গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার পক্ষ থেকে। তখনো দেখা যায় আইন ও বিচার ব্যবস্থার সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট অনেকের কাছে ইসলামী আইন ও বিচার বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেই। এরও মৌলিক কারণ হচ্ছে ইসলামী বিষয়াসয় সম্পর্কে জানার জন্য সাধারণ শিক্ষিতদের পশ্চিমা লেখকদের উপর নির্ভর করা আর বাংলা ভাষায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বই-পুস্তকের অপ্রতুলতা।

সঙ্গত কারণেই লম্বা সময় জুড়েই আইন ও বিচার ব্যবস্থা বিষয়ে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরে পর্যাপ্ত পরিমাণে এ ধরণের বই-পুস্তকের প্রয়োজন অনুভব হয় সুতীব্রভাবে। ঠিক এ সময়টিতেই মাওলানা আবুল ফাতাহ (রহ.) ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা নামে দুই খ-ে প্রায় আট শত পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ প্রস্তুত করেন। যা ২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসে প্রথম প্রকাশের মুখ দেখে।
অপর দিকে বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই যখন মানুষ ভোগবাদি জীবন দর্শনে অতিষ্ট হয়ে মুক্তির পথের সন্ধানে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দিকে আকৃষ্ট হতে চলেছিল। একটি ইসলামী জাগরণের আভাস স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছিল। ঠিক এ সময়ে পশ্চিমারা ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী জীবন ব্যবস্থা, আইন ও বিচার ব্যবস্থার উপর প্রচার প্রোপাগা-ার যে ঝড় তোলেছে তাতে অমুসলিমরাত বটেই মুসলিম সামাজেও ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্নের দানা বাধতে শুরু করেছে। ইসলামের ব্যক্তিগত ইবাদত বন্দেগী ও জীবন ব্যবস্থা নিয়ে তাদের যতটা না আপত্তি তারচে বহুগুণ বেশি আপত্তি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা, আইন ও বিচার ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক ও আন্তঃধর্মীয় নীতিমালা নিয়ে। কিছু কিছু প্রশ্নত মুখে মুখে ছাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে যার সমাধান বিষয়ে মুসলিম প্রজন্মকে সন্দিহান করে তোলা হচ্ছে।

রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হল আইন ও বিচার বিভাগ। ইসলামে কি আদৌ কোন সুসংহত আইন ও বিচার ব্যবস্থা ছিল? যদি থেকেও থাকে তাহলেওত তা চৌদ্দশ বছর আগের। একবিংশ শতকের এযুগেও কি তার কার্যকারিতা অবশিষ্ট রয়েছে? যদি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়ও তাহলে এ যুগে তার আইন ও বিচারের রূপরেখা কি হবে? নাকি তাদেরকেও পশ্চিমাদের অনুকরণের দিকেই যেতে হবে? এজাতীয় প্রশ্নগুলোই বড় করে দেখানো হচ্ছে।

কথাগুলো মাওলানা আবুল ফাতাহ তাঁর ভূমিকায় এভাবে তুলে ধরেছেন Ñ“বর্তমানে অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, নতুন প্রজন্মের মুসলিম সন্তানেরা ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থার নাম শুনলে আতঙ্কে ভোগে। অথচ তাদের অনেকেই ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে এবং ইসলামী আইনের তত্ত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখে না। যেন না দেখা এক জুজু বুড়ির ভয়ে সবাই আতঙ্কগ্রস্থ। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে নামায রোযা যথাযথভাবে আদায় করলেও ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে লড়াইয়ে নিরত একশ্রেণী। এই আত্মঘাতী অবস্থানের জন্য ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতাই দায়ী নিঃসন্দেহে।”

সুতরাং এ সময়ে ইসলামী আইন ও বিচারের গৌরবোজ্জল ইতিহাস, এর ঐতিহাসিক সুফল, এর ব্যাপ্তি চিরঞ্জিবতা, বর্তমান পৃথিবীতে এর উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বরং সময় হয়েছে প্রমাণ করে দেখানোর যে, ভোগবাদিতা ও স্বর্থবাদিতা, সাম্রাজ্যবাদিতা ও পুঁজিবাদীদের দাপট ও ত্রাসের এ কালে ইসলামী আইনই পারে শান্তির হাওয়া বহাতে। একথা অভিসন্দর্ভে-গবেষণাপত্রে, প্রবন্ধ-রচনায়, গল্প-কবিতায়, আলোচনা-বক্তৃতায় এমনভাবে বাজাতে থাকতে হবে যাতে মানুষের মনে ইসলামী আইনের প্রতি তৈরী করা ভীতি বিদূরিত হয়ে এর প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্ম নেয়। কিন্তু শত দুঃখ এখানে যে, এ বিষয়ে যেখানে আমাদের মাতৃভাষায় প্রচুর বই-পুস্তক ও রচনা-পর্যালোচনা থাকার কথা সেখানে আগ্রহী পাঠক ও শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়ার মত নির্ভরযোগ্য ও পূর্ণাঙ্গ একটি বইও নেই।

লেখকের ভাষায় এ আফসোসের কথা এভাবে উঠে এসেছে, ‘বাংলা ভাষায় ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা সম্বলিত কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ অদ্যাবধি রচিত হয়নি। ফলে কেউ এ বিষয়ে জানতে চাইলেও যাথার্থ বই পুস্তক ও উপকরণের অভাবে তা জানা সম্ভব হয় না।’

এসব প্রয়োজনকে সামনে রেখে একজন মাওলানা আবুল ফাতাহ নিজের পরিবার-পরিজন, মসজিদ-মাদরাসার শত ব্যস্ততার ফাঁকে সাহস করে এমন সুকঠিন কাজ শুরু করে দেন এবং মাত্র দুই বছরের মধ্যেই এক পর্যায়ের একটা সমাপ্তিতে পৌঁছে যান। তাঁর ব্যস্ততা ছিল এমনই যে অবস্থায় এ ধরণের গবেষণামূলক কাজ করা সত্যিই কঠিন। অথচ এ অবস্থায় থেকেও তাঁর সবগুলো কাজই ছিল গবেষণাধর্মী সুকঠিন।

ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থা : বিষয়বস্তু ও সাফল্য
মাওলনা আবুল ফাতাহ রহ. তাঁর ‘ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থা’ গ্রন্থকে দুই খ-ে ভাগ করেছেন। প্রথম খ-কে তিনি একটি ভূমিকা ও তেরটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। এতে তিনি আইন ও ইসলামী আইনের বিষয়টির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছেন। যার শিরোনামগুলো যথাক্রমেÑ ইসলামপূর্ব যুগে আইন ও বিচারব্যবস্থা, আইন ও ইসলাম, আইনের সংজ্ঞা ও পরিচিতি, ইসলামী আইনের উৎস, ইজতিহাদ, আইনের বৈশিষ্ট্য, আইনের প্রকারভদ, আইন ও অপরাধ, আইন ও স্বাধীনতা, আইন ও অধিকার, রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নের পদ্ধতি, আইন রহিত বা বাতিলকরণ, আন্তর্জাতিক আইন।

ভূমিকা অংশটির মধ্যে রয়েছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শিরোনামগুলো হলো, বিজ্ঞান কি ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যসীমা নির্ধারণ করতে পারবে? ধর্মই পারে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যসীমা নির্ধারণ করতে, অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী, ইসলামী আইনের বৈশিষ্ট্য, ইসলাম কি আধুনিক পৃথিবীর আইনী প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম, পাশ্চাত্যে মানুষের ধর্মের প্রতি বৈরিতার কারণ, যুগচাহিদা পুরণের ব্যাপকতা ইসলামী আইনে রয়েছে, ইসলামী আইন সর্বকালেই প্রযোজ্য, ইসলামী আইন অমুসলিমদের জন্যও কল্যাণকর। ভূমিকা অংশেরউপরিউক্ত শিরুনামগুলোকে আমার কাছে এ বইয়ের প্রাণ মনে হয়েছে। এগুলোই একজন পাঠককে এ বই এবং এ বিষয়ের আরো বই পড়তে উৎসুক করে তুলবে। এ বিষয়গুলোকেই বিশ্লেষণপূর্বক সরল ও যৌক্তিক উপস্থাপনায় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠকের উপযুক্ত করে তাদের হাতে হাতে পৌঁছে দেয়াই হল সময়ের দাবি।
দ্বিতীয় খ-ে তিনি ষোলটি শিরোনামে বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যদি বিচারব্যবস্থা একটি দীর্ঘ আলোচনাসাপেক্ষ বিষয় তথাপি তিনি এ বিষয়েরও একটি মৌলিক কাঠামো দাড় করতে সক্ষম হয়েছেন। শিরোনামগুলো যথাক্রমেন, বিচার ব্যবস্থার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, ইসলামপূর্ব যুগে বিচারব্যবস্থা, আল-কুরআনে উল্লিখিত কতিপয় ঐতিহাসিক বিচার, ইসলামী

বিচারব্যবস্থার মৌলিক উপাদানসমূহ, বিচারক, বিচারালয়, বিচারের আরযী, মামলারশুনানী, বিবাদীর স্বীকারুক্তি, সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ, আলামত, লিখিত ডকুমেন্ট, ইলেট্রনিক ডকুমেন্ট, পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট, বিচারকের রায়, রায় কার্যকর করার প্রক্রিয়া সালিসীব্যবস্থা ও ইসলাম। তিনি শিরোনামগুলোকে যথাসাধ্য তথ্যনির্ভর করার চেষ্টা করেছেন।

এ মূল্যবান গ্রন্থ রচনায় তিনি কতটা সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তা নির্ভর করে বোদ্ধা পাঠক-সমালোচকদের মতামতের উপর। আরো সহজ করে বলতে গেলে বলা যায়, ইসলামী শিক্ষাধারার প-িত ব্যক্তিদের স্বীকৃতির পাশাপাশি আমাদের দেশে যারা আইন ও বিচারের চর্চা করেন, আইনের শিক্ষার্থী শিক্ষক গবেষক ও বিচারক তাদের কাছে বইটি ইসলামী আইন ও বিচারকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে সেটাই এখানে বিশেষভাবে বিবেচ্য হবে। অবশ্য এজন্য আমাদেরকে বেশি দূরে যেতে হবে না। গ্রন্থকার নিজেই বইটি প্রস্তুতপূর্বক দেশের সনামধন্য ও শীর্ষস্থানীয় আইন ও বিচারে বিশেষজ্ঞ দুইজন ব্যক্তির কাছে পেশ করেছেন গ্রন্থটির সমালোচনা ও স্বাধীন মতামত তুলে ধরার জন্য। তন্মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহম্মদ আবদুর রউফ। অপরজন হলেন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি জনাব এ,বি,এম নূরুল ইসলাম।

জনাব নূরুল ইসলাম তার দেয়া অভিমতে লেখককে অভিনন্দনপূর্বক লেখেনত ‘এই পুস্তকখানা শুধু বাংলাদেশের নয় গোটা বিশে^র সকল ধর্মের শিক্ষিত লোকদের জন্য পথ প্রদর্শক হিসাবে কাজ করবে। কারণ, ইসলামী আইন ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক লোকেরই সঠিক ধারণা নেই।’

শেষে তিনি উচ্ছসিত হয়েই লেখেন, ‘আমি পুস্তকখানার পাণ্ডুলিপি পড়ার পর মনে করছি যে, ভবিষ্যতে গোটা মুসলিম সমাজের জন্য এই গবেষণামূলক পুস্তকখানা বিশেষ করে আইনজীবী ও বিচারকদের জন্য এটি একটি মূল্যবান রেফারেন্স গ্রন্থ হয়ে থাকবে।’ সাধারণ আইনের একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির মুখ থেকে এভাবে স্বতঃস্ফূর্ত মতামত ও স্বীকৃতি আদায় করে নেয়াটা তাঁর রচনার সাফল্যের একটি প্রমাণ।

বিচারপতি আব্দুর রউফ তাঁর প্রদত্ত অভিমতের সূচনা করেন এভাবে, ‘সুসাহিত্যিক ও প্রাজ্ঞ লেখক মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া প্রণীত ‘ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা’ গ্রন্থটির ১ম ও ২য় খণ্ডের পাণ্ডুলিপিদ্বয় পড়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম’।

পাশ্চাত্যধারার আইন ও বিচার বিষয়ের এ পণ্ডিত ব্যক্তিকে এ গ্রন্থের যে বিষয়টি আকর্ষণ করতে পেরেছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সুবিজ্ঞ লেখক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানুষের চিন্তাধারার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে এমর্মে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে প্রয়াস চালিয়েছেন যে, কেবলমাত্র ইসলামিক চিন্তাধারার প্রতিফলনের মাধ্যমেই অসাম্প্রদায়িক কল্যাণমুখী সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব’।

গ্রন্থটি পাঠ করে যেন তিনি পরিতৃপ্ত হয়েই তার সংক্ষিপ্ত অভিমতের পরিসমাপ্তি টেনেছেন এভাবে, ‘ধর্ম-বিজ্ঞান, জীবন-দর্শন, স্রষ্টা ও সৃষ্টির নিগূঢ় সম্পর্কই মানব সমাজে আইন প্রণয়নের মৌলিক উপাদান। আইনের প্রকৃষ্ট প্রয়োগের মানদ- কুরআন সুন্নাহর আইন এবং সে আইনের আলোকে গড়ে ওঠা বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান আহরণের পথে সুধী পাঠকম-লী তাদের অনুসন্ধিৎসু মনের অনেক খোরাক পাবেন এ বইটিতে ইনশাআল্লাহ’।

উত্তরসুরীদের দায়িত্ব
শাস্ত্রীয় ও গবেষণামূলক যে কোন বিষয়ে একেক জনের কাজের সাথে বহুজনের কাজ একত্রিত হলেই তবে ব্যাপক সুফল বয়ে আনতে পারে। কিছুটা ‘বিন্দু বিন্দু জলে সাগর’ হবার মত। আধুনিক আবিস্কারের জগতে সাফল্যের ক্ষেত্রে তো বিষয়টি অনিবার্য। ধর্মীয় গ্রন্থাবলীর ক্ষেত্রে এ বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। একজন একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারপর শতশত মনীষী তার সহায়িকা প্রস্তুত করেছেন। এতে একজনের লেখায় যে অপূর্ণতা, অস্পষ্টতা, কাঠিন্য-দুর্বোধ্যতা ও ভূল-ভ্রান্তি থেকে যায় পরবর্তীজন তা দূর করে দেন। তাকে আরো সহজ-সরল পাঠকউপযোগী ও পাঠকপ্রিয় করে তোলেন। আমার খোব মনে হয়েছে মাওলানা আবুল ফাতাহ রহ. রচিত প্রায় প্রতিটি গ্রন্থই এমন যার উপর বিভিন্ন দিক থেকে কাজ হওয়া প্রয়োজন। সফলভাবে তাঁর বইগুলোর যথাযথ খেদমত হলে তা দীর্ঘদিন পাঠকের চাহিদা পুরণে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

নমুনাস্বরূপ বলা যায়, ‘দেওবন্দ আন্দোলন’ বইটি তাঁর সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। এতে তিনি ভারতে মুসলিমদের আগমন, রাজ্যবিস্তার ও সুশাসনের ইতিহাস আলোচনা করেছেন। স¤্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন শোষণ ও জুলুম-নির্যাতনের বিভীষিকার চিত্র অঙ্কন করেছেন। সর্বোপরি দারুল উলূম দেওবন্দের সূচনা ইতিহাস ঐতিহ্য ও অবদান মেলে ধরেছেন। এ ধরণের চার পাঁচটি ইতিহাসের জটিল গ্রন্থির উন্মোচনের প্রয়াস চালানো হয়েছে বইটিতে। গুরুত্বের বিবেচনায় বইটি বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মৌলিক সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু গ্রন্থকারের ভূমিকামুলক বক্তব্য থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেবইটিকে তাঁর লেখা গ্রন্থ বলার চাইতে ধারাবাহিক ক্লাসের লেকচার সংকলন বলাই বেশি যুক্তযুক্ত হবে বলে মনে হয়। যদিও একে পাঠ্য বইয়ের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা তিনি করেছেন। তথাপি এটি ছিল তাঁর গবেষণামূলক রচনার প্রাথমিক কর্ম।

সুতরাং এ বইয়ে ইতিহাসের এমন জটিল জটিল অধ্যায়েল উপস্থাপন, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনায় বিভিন্ন রকমের ফাঁক-ফোকর থেকে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮ খৃষ্টাব্দ থেকে বর্তমানে ২০১৮ পর্যন্ত বিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও এ বইয়ের উপর কোন কাজ হয়নি। এমনকি বাংলা ভাষায় এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আমার অনুসন্ধান অনুযায়ী উল্লেখযোগ্য কোন কাজই হয়নি। দেওবন্দী মাদরাসায় দেওবন্দের ইতিহাস পড়ার জন্যও সিলেবাসের উপযুক্ত করে অথবা সহায়ক হিসেবে পড়ার জন্যও কেউ দুই একটি গ্রন্থ রচনায় এগিয়ে আসেননি। আমার মনে হয় উত্তরসুরীদের কাছে এ ধরণের কাজ মাওলানা আবুল ফাতাহ রহ.-এর মত অগ্রজদের পাওনা হয়ে রয়েছে। এ দায় শোধ করা আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য বলেই আমি মনে করি। শুরু ও শেষে সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার।

লেখক: মুহাদ্দিস, জাময়িাতুল উলুমিল ইসলাময়িা, ঢাকা।

পূর্ববর্তি সংবাদবুড়িগঙ্গা থেকে অজ্ঞাত দুই যুবকের লাশ উদ্ধার
পরবর্তি সংবাদবেশি সময় ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা