জাপার এমপিদের বাইরের মাঠে খেলার কী দরকার!

আবুন নুর ।।

নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির এমপিরা প্রথমে ছিলেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। ২২ টি আসন নিয়ে তারা সরকারের সঙ্গে থাকবেন, না কি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবেন। দুদিন পর মিটিং করে জানানো হলো, না – তারা বিরোধীদলে যাচ্ছেন না, সরকারের সঙ্গেই থাকছেন। তাদের মুখপাত্র নতুন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বললেন, ‘দেশের মানুষ চায় না – সংসদে বিরোধী দল থাকুক। জাতীয় পার্টি মাহজোটোর সঙ্গেই থাকছে।’ কিন্তু নির্বাচনের আগে আগে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আসা পার্টির চেয়ারম্যান মুখ খুলেই উল্টো কথা বললেন। নির্বাচনের পর ৬ দিনের মাথায় জানালেন, জাপা বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে।

জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ শপথ নিলেন আজ। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তার আগেই বিরোধী দলে থাকার সিদ্ধান্ত তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, জাপার কেউ এবার মন্ত্রী হবে না। দৃশ্যত তিনি জাপার এমপিদের নেওয়া সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এককভাবে এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন।তিনি কতক্ষণ তার এ সিদ্ধান্তের উপর অটল থাকবেন- এটা অবশ্য দেখার ব্যাপার। তার সিদ্ধান্তগুলো সাধারণত নড়াচড়া করতেই থাকে।

খবর বের হয়েছে, চেয়ারম্যান এরশাদের এমন একক সিদ্ধান্তে  পার্টির এমপিদের বড় অংশটিই নাখোশ। তাদের একটি অংশের প্রায় সবাই ভাবছেন, সরকারের সঙ্গে থাকলে মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ তারও থাকতে পারে। বিরোধী দলে গেলে তো আর সে সুযোগেরও কোনো ‘সুযোগ’ নেই। যাক, এটা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ‍সুযোগ-অসুযোগের ব্যাপার।

আমি বলতে চাই অন্য কথা। জাতীয় পার্টি বা জাপার এমপিরা বিরোধী দলের আসনে বসলে সেটা আসলে কতোটা সঠিক ঘটনা হয়? তারা কি আসলে সরকারের বিরোধী? তারা কি প্রকৃতই বিরোধী দলের ভূমিকায় আছেন? মহাজোটের হয়ে একই সঙ্গে ভোটের রায় নিলেন যারা, প্রতীক ভাগাভাগি করে ভোটে দাঁড়ালেন যারা– তারা সংসদে এসে উল্টো দিকে বসলেই কী এমন বিরোধিতা করবেন বা করতে যাবেন? বিরোধীদল তো বিরোধী দলের মতোই হওয়া উচিত। আসল বিরোধীদল না হয়ে বিরোধী দলের পোশাক গায়ে চড়ালে সেটা কি সুন্দর দেখাবে? অপরদিকে তারা যদি সরকারে থাকেন তবে তাদের দু-চারজন মন্ত্রী হবেন। এতে বেতন-ভাতা হিসেবে রাষ্ট্রের কিছু বাড়তি টাকা খরচ হবে। এইটুকু খরচকে বড় করে না দেখে তারা তাদের আসল রূপটি নিয়ে সংসদে বসলে তাদের অবস্থানটা তো অন্তত পরিষ্কার থাকে। সেটার গুরুত্ব কোনো দিক থেকেই কম না।

আরেকটি ব্যাপারও আছে ভেবে দেখার মতো। যে জোটের পক্ষে প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৮৫/৯০ ভাগের চেয়েও বেশি পড়েছে বলে হিসাব এসেছে, তার বিরুদ্ধে বিরোধীদল বলে কি কিছু থাকার দরকার আছে? জাপা নেতা রাঙ্গার কথা একদিক থেকে সঠিক। ভোটাররা চায় না– সংসদে কোনো বিরোধীদল থাকুক। তারা তো প্রতীক ভাগাভাগি করেই নির্বাচন করেছেন। যেখানে নৌকা সেখানে লাঙ্গল ছিল না, যেখানে লাঙ্গল সেখানে নৌকা ছিল না। একপক্ষীয় সারিতে দাঁড়িয়ে ভোট করেছেন। এখন তাদেরই একটি ক্ষুদ্র অংশের মুখোমুখি সারিতে দাঁড়ানোর পেছনে কী যুক্তি থাকে?

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জাপা থেকে কয়েকজন মন্ত্রী হয়েছেন। জাপা চেয়ারম্যান মন্ত্রীর মর্যাদায় প্র্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছেন।  সেজন্য সেই সংসদের সরকারি ও বিরোধীদলকে  বলা হতো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পৃথিবীতে সংসদীয় গণতন্ত্রের এক অদ্ভুত রীতি চালু হয়েছে তখন থেকে। এক পর্যায়ে জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ পর্যন্ত প্রকাশ্য সভায় বলেছেন- ‘মানুষ আমাদের গৃহপালিত বিরোধী দল’ বলে ডাকে। আরেকবার তো এরশাদ সাহেবের স্ত্রী (বিরোধী দলীয় নেতা) রওশন এরশাদ সংসদে দাঁড়িয়েই আকুতি প্রকাশ করেছেন- প্রধানমন্ত্রী যেন ঠিক করে দেন তারা বিরোধী দল না কি সরকারি দল। তারা বিদেশীদের সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেন না। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না।

কেউ কেউ বলে থাকেন, সংসদীয় গণতন্ত্রের রেওয়াজ হলো, বিরোধী দলের অন্তত ১০% ভোট পেতে হয়, ১০% এমপি থাকতে হয়। এই দিকটি বিবেচনা করলেও জাপার এমপিদের বিরোধী দলে গিয়ে বাসার পক্ষে কোনো যুক্তি থাকে না। কারণ তারা দলগতভাবে সে পরিমাণ ভোট পাননি। তাদের ৩০ জন এমপি নির্বাচিত হননি। অযথাই তারা কেন বিরোধী দলের আসনে গিয়ে বসবেন? তারা সরকারের সাথে আছেন, সেটাই তো ভালো। সাজানো বিরোধী দলের খেলায় তাদের নামানোর কী দরকার! এমপিদের বড় অংশও তো চাচ্ছেন না সেটা। তাই এরশাদ সাহেবের উচিত, সিদ্ধান্তটাকে আরেকবার নড়চড় করানোর চিন্তা করা।

মজার ব্যাপার হলো, এরশাদ সাহেবের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই ঠিক থাকে না। আশা করা যায়- জাপার এমপিদের বিরোধী দলের আসনে বসার সিদ্ধান্তটাও ঠিক থাকবে না। মন্ত্রী হতে চাওয়া এমপিদের মনটা তখন আর ভাঙ্গবে না। এরই মধ্যে খবর এসেছে, এরশাদ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হয়তো হাসপাতাল থেকে সিদ্ধান্তের নতুন কোনো কপি গণমাধ্যমে চলেও আসতে পারে। সেটা এলেই ভালো । জাপার এমপি সাহেবদের চাওয়া–পাওয়াও পূরণ হয়। আবার সরকারের ভেতর-বাহির, সঙ্গী-সাথীরাও একসঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়ে যান। ভেতরের লোক হয়ে বাইরের মাঠে তাদের খেলার কী দরকার!

পূর্ববর্তি সংবাদশপথ নেবেন না গণফোরামের দুই এমপি : মোস্তফা মহসীন মন্টু
পরবর্তি সংবাদবাদ আসর বনানী কবরস্থানে সৈয়দ আশরাফের দাফন