বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে পিছিয়ে ডানপন্থী দলগুলো

সৈয়দ শামছুল হুদা ।।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। তারা মাঠে-ময়দানে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি ব্যর্থ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনেও। ডানপন্থী ইসলামী এবং অনৈসলামিক উভয় দলেরই এ ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা চোখে পড়ছে।

বাংলাদেশে ডানপন্থী দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী দল বিএনপিকে সবসময়ই মনে করা হতো। একসময় তাদের দলে জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে কাজ করতো জিয়া পরিষদ নামে একটি সংগঠন। দীর্ঘদিন হলো, সেই সংগঠনটির কোনো নামও শোনা যায় না। তাদের কোনো অস্তিত্ব আছে কি না তাও জানা যায় না। কবির মুরাদের নেতৃত্বে দলটি মাঝে মাঝেই বিএনপিকে পরামর্শ দিতো কিংবা প্রকাশ্যে দিতো বিবৃতি।

বিএনপি যে সব সিদ্ধান্ত নেয়, তার যৌক্তিকতা কী? কেন তারা এমন করছে? তাদের কী করা উচিত? তাদের কোন সিদ্ধান্তটি ভুল, কেন ভুল? এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার কাউকে এখন দেখা যায় না। আমারদেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান স্বপ্রণোদিত হয়ে বিএনপিকে কিছু উপদেশ দিতেন। সেটাকেও তারা সহ্য করতে পারছে না। এটা মাহমুদুর রহমান বিভিন্ন লেখা থেকেই প্রতীয়মান হয়।

এই যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেলো। বিএনপি জনগণের মধ্যে বিপুল আশা জাগিয়ে তুলতে পারলেও ফলাফল পর্যন্ত তারা মাঠ দখলে রাখতে পারলো না। কেন পারলো না? সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? নির্বাচনে কী কী ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা করার মতো দল, টিম বা সংগঠন এখন বিএনপিতে নেই। এই মুহূর্তেই উচিত ছিল নির্বাচনী ডকুমেন্টগুলো সংরক্ষন করা। সারাদেশে তাদের যে সব প্রার্থী যে যে ধরণের সহিংসতার শিকার হয়েছে, তাদের দলীয় নেতা-কর্মী যে সব হামলা-মামলার শিকার হয়েছে, কী কী কৌশল বিভিন্ন বিভাগ নিয়েছে তা খুব ভালোভাবে যাচাই বাছাই করে এখনই লিপিবদ্ধ করে রাখা। এবং সময় ও সুযোগ মতো জনগণের কাছে তুলে ধরা। এসব নিয়ে বিএনপির মধ্যে কোন কার্যক্রম আছে কি না জানা নেই।

নির্বাচন পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর যৌক্তিকতা নিয়েও একটি বিভাগ থাকা দরকার ছিল যারা এসব বিষয় বিচার বিশ্লেষণ করবে। শুধু রাজনৈতিক নেতারা যা খুশি করবে, সেটা কর্মীদের ওপর চাপিয়ে দিবে, ব্যর্থতার দায়ভার নিবে না তা বিএনপির জন্য মানানসই না। বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এমন একটি গবেষণা বিভাগ থাকা দরকার। রাজনৈতিক নেতারা ভুল করলে তাৎক্ষণিক তারা সতর্ক করবে । দলকে করবে, জাতিকে করবে। এটা করা হচ্ছে না।

আর এসব কারণেই বিএনপি বারবার জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। তারা জিয়ার আদর্শ থেকেও ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে বলে একটি আওয়াজ উঠেছে। ভারতীয় লবিকে খুশি করতে এখন বিএনপি নিজেদেরকে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল বলে না। এর খারাপ পরিনতি সম্পর্কে বিএনপি নেতাদের ধারণা আছে কী না আমার সন্দেহ হয়। বিএনপি যদি ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাস না করে, আর ‘ভারত তোষণ’ নীতি গ্রহণ করে তাহলে বিএনপি হারিয়ে যাবে এটা বলা যায়। যেমন এদেশে মুসলিম লীগের পরিণতি হয়েছে।

এছাড়াও অন্য যে দলগুলো আছে যেমন জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এসব দলগুলোতেও বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম খুবই কম লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে জামায়াত এক সময় অনেক বেশি অগ্রগামী ছিল। তাদের ওপরে যাওয়া রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক চাপে হয়তো কিছুটা ভাটা পড়েছে। কিন্তু অন্য দলগুলোর ক্ষেত্রেতো এটা বলা যায় না যে, তারা খুব কঠিন চাপে আছে বলেই তারা এসব নিয়ে ভাবতে পারছে না।

সম্প্রতি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ভালো আলোচনায় চলে এসেছে। সারা দেশেই তাদের একটি ভালো সমর্থকগোষ্ঠীও তৈরী হয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যেও গবেষণাক্ষেত্রে কার্যক্রম খুব কম লক্ষ্য করা যায়। দলটির নায়েবে আমীর ফয়জুল করীমের বক্তব্য ভালো লাগে। তার অসাধারণ সাহসী বক্তব্যের প্রশংসা করতেই হয়। কিন্তু তাদের কর্মসূচী, তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, তাদের রাষ্টদর্শন নিয়ে খুব একটা প্রচার-প্রচারণা দেখা যায় না। খুব সীমিত আকারে দলীয় গন্ডিতে হয়তো হয়, এটা দল হিসেবে মানানসই নয়। দল যেহেতু এখন অনেক বড় হয়েছে, সেহেতু তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল কী হবে, তাদের অর্থনৈতিক দর্শন কী হবে, তারা প্রশাসনকে কীভাবে ব্যবহার করবে, তারা আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সাথে কীভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলবে, তারা দেশের অন্যান্য দল, জাতিগোষ্ঠীর সাথে কী আচরণ করবে এসব বিষয় নিয়ে ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নেওয়া দরকার।

আলোচিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারাই এককভাবে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী দেয়। সুতরাং নির্বাচনী অভিজ্ঞতাগুলো সংরক্ষণ করা তাদেরও দরকার। তাদের প্রার্থীদের পরিচয়, তাদের থেকে নির্বাচনী অভিজ্ঞতা, সহিংসতা, নির্বাচনের আগে-পরে তাদের দলীয় বক্তব্য কী ছিল, এসব বিষয় সংরক্ষণ করতে এখনই উদ্যোগ নিতে পারে দলটি। এই নির্বাচনী অভিজ্ঞতা থেকে তারা যা অর্জন করলো, সেটা আগামীতে কীভাবে কাজে লাগাবে? তারাও কোন জোটের সাথে যাবে কী না? গেলেই বা তার পক্ষে যুক্তি কী? না গেলেই বা যুক্তি কী? এসব বিষয়ে জাতিকে লিখিত বা মৌখিকভাবে অবহিত করা দরকার।

রাজনৈতিকভাবে অনেক পুরনো দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। তারা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের ক্ষেত্রে তারাও পিছিয়ে। সাধারণ মানুষ তাদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। কিছু আলেমের মধ্যেই তাদের রাজনীতি সীমিত। এছাড়া দলীয় কোন্দল, দুদিন পরপর দল ভেঙ্গে যাওয়া, নেতৃত্বের অপরিপক্কতা সবসময়ই যেন তাদের মধ্যে লেগে আছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক চাওয়া-পাওয়া নিয়ে এভাবে দল ভেঙ্গে যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক। তাদের দলীয় টার্গেটই বা কী? এটা কি শুধু আলেমদের সংগঠন হিসেবেই থাকবে, নাকি ইসলামী চিন্তাধারার সাধারণ মানুষকেও সম্পৃক্ত করবে তা বুঝা যায় না। সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত না করলে কীভাবে দেশ চালাবে? কীভাবে প্রশাসন চালাবে? এসব বিষয় পরিস্কার না হলে মানুষ কেন জমিয়তকে সমর্থন করবে?

আর অন্যান্য ডানপন্থী দলগুলোর অবস্থা আরো করুণ। তারা এদিক- সেদিক ছুটোছুটি করছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে গবেষণা বিভাগ না থাকায় দলগুলো বারবার ভেঙ্গে যায়। যখন যার খুশি, তখন সে দল ভেঙ্গে দিচ্ছে, কর্মী, সমর্থকদের কথা একবারও ভাবে না।

কিন্তু বিপরীতে দেখুন আওয়ামীলীগ দলে অসংখ্য বুদ্ধিজীবি আছে, তারা দলীয়ভাবেই এসব বুদ্ধিজীবিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। একাদশ জাতীয় সংসদে লক্ষ করুন, তারা ইসলামী কয়েকটি দলকে কীভাবে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে। তারা রাজনৈতিক মূলা তো দেখিয়েছে ঠিকই , কিন্তুএকজনকেও নির্বাচনে নমিনেশন দেয় নাই। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নীতিগতভাবে একবার আওয়ামীলীগের সাথে তথাকথিত ৫দফা লিখিত চুক্তি করলো। চুক্তি করার কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের দলীয় বুদ্ধিজীবিদের প্রেসারে এসব চুক্তিকে ছিড়ে ফেলতে বাধ্য হলো আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস আবারও জাতীয় পার্টির সাথে সঙ্গ দিলো। জাতীয় পার্টি যার কোন নিজস্ব স্বকীয়তা নেই, সেই দলের সাথে জোট করতে একাবরও তাদের বিবেচনায় বাধলো না। রাজনৈতিক লালসা তাদেরকে সীমাহীন লজ্জায় ফেলে দিলো।

আওয়ামীলীগের কর্মসূচী প্রণয়নে শত শত বুদ্ধিজীবী রয়েছেন। অসংখ্য স্বতন্ত্র সংগঠন রয়েছে। শিল্পী গোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু ডানপন্থী কোন দলেরই এসব নেই। এসব নিয়ে ভাবনাও নেই। আওয়ামীলীগ মাশরাফিদের এমপি বানিয়ে আনলো, অসংখ্য শিল্পীদের কাজে লাগালো। কিন্তু বিএনপি! তারা নিজেদের এ শ্রেণির লোকদেরকেও সামান্য মূল্যায়ন করতে শিখলো না।
দল যদি কখনো ভুল করে, বা মূল আদর্শ ও নীতি থেকে বিচ্যুত হতে থাকে তখন বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনগুলো মূল দলকে সাপোর্ট করে, সাহায্য করে, শক্তি যোগায়। এটা যেন ডানপন্থী দলগুলো বুঝেই না। ডানপন্থী দলগুলো এ জন্য বুদ্ধিজীবিদের পৃষ্ঠপোষকতাও দেয় না, যদি আবার তারা তাদের খামখেয়ালীগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরে, তাহলে তাদের আর ইজ্জত থাকবে না এই ভয়ে। যারা গবেষণা করেন, যারা চিন্তাশীল মানুষ, তারা সবসময়ই রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্ধ সমর্থন করবে না। যেমনটা আওয়ামীলীগকে খেলাফত মজলিসের সাথে করা চুক্তির সময় করতে দেয়নি তাদের বুদ্ধিজীবীরা।

ডানপন্থিরা যদি এসবের প্রতি এখনো গুরুত্ব না দেয়, তাহলে তারা সকলেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। প্রশ্ন আসবে, যারা চিন্তাশীল মানুষ তারা তো সব বুঝেই, তাহলে কেন তারা তাদের পক্ষের দলগুলোকে নিয়মিত সাপোর্ট দেয় না। এর কারণ হলো, আওয়ামী লীগ সুসময়ে তাদের বুদ্ধিজীবীদের মুল্যায়ণ করে। দুঃসময়ে বুদ্ধিজীবীরা জীবনবাজি রেখে তাদের পক্ষে লড়াই করে। কিন্তু বিএনপিসহ অন্য ইসলামীদলগুলো সুসময়ে তাদের কোন মূল্যায়ন করে না। ব্যতিক্রম শুধু জামায়াত। তারা তাদের চিন্তাশীল মানুষদের সম্মান করে। অন্যরা কেউ করে না। বিএনপি করে না, জমিয়ত করে না, ইসলামী আন্দোলন করে না, মজলিস করে না, নেজামে ইসলামও করে না।

যারা দেশকে ভালোবাসেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ভালোবাসেন তাদের সকলের উচিত বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের জায়গাটিকে বড় করা। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর উচিত এদেরকে উৎসাহিত করা, এদেরকে সমর্থন করা, এদেরকে সাপোর্ট দেওয়া। নতুবা সামনে আরো বিপদ রয়েছে তাদের।

লেখক : সম্পাদক, নুরবিডি ডটকম ও বিআইএম

পূর্ববর্তি সংবাদএকাদশ সংসদ নির্বাচন বাঙালির ইতিহাসে একটি কল‌ঙ্কিত নির্বাচন: কাদের সিদ্দিকী
পরবর্তি সংবাদসাতক্ষীরার সফরে দেখে এলাম কাদিয়ানি পল্লী