ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি: প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা আমাদের যে বার্তা দিয়ে গেল

ইসলাম টাইমস ডেস্ক: অতিসম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় ঘটে যাওয়া সুনামিতে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে। সে সাথে বিভিন্ন জন বিভিন্ন কারণ বিশ্লেষণ করছেন, বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিমাণ কেন এত বৃদ্ধি পাচ্ছে? কেন এ সুনামি হয়েছে? সুনামিতে কেন এত মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে?

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ভিন্নধর্মী মতও ব্যক্ত করেছেন। তারা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পেছনে মানুষের নৈতিক অবক্ষয়, অসামাজিক কার্যকলাপ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ও দায়ী। এ সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয় মূলত মানুষকে একটি বার্তা দিতে চায়, মানুষ যেন সত্যিকারের মানুষ হয়ে যায়।

এধরণের একটি বার্তা বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যাতে প্রত্যক্ষদর্শীরা সুনামিতে তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার হওয়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একটি সমুদ্রসৈকতের তাঁবুতে বিশাল আকারের ঢেউ আঘাত হানছে।

ঐ তাঁবুতে এক অনুষ্ঠানে গান গাইছিল ইন্দোনেশিয়ার বেশ জনপ্রিয় একটি রক ব্যান্ড ‘সেভেনটিন।’

ঢেউয়ের আঘাতে মঞ্চ তছনছ হওয়ার ভিডিও চিত্রে দেখা যায় ব্যান্ডদলের কয়েকজন সদস্যের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটি।
হৃদয়বিদারক এক ইনস্টাগ্রাম ভিডিওতে গায়ক রিয়েফিয়ান ফাযারসিয়াহ জানান যে, ব্যান্ডের বেসিস্ট এবং ম্যানেজার নিহত হয়েছেন। আরো তিনজন সদস্য এবং ঐ গায়কের স্ত্রী এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।

ঐ ব্যান্ডের এক নবীন সদস্য জ্যাক তাঁর ইনস্টাগ্রাম পোস্টে লিখেছেন যে, স্টেজের অংশবিশেষ আঁকড়ে ধরে স্রোতের হাত থেকে বেঁচেছেন তিনি।

“শেষ কয়েকটি মুহূর্তে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো”, বলে জ্যাক তাঁর পোস্টে লেখেন বলে জানায় সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।

সংবাদ সংস্থা এপি জানায়, ব্যান্ডটি তাঁদের একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, “স্রোত ফিরে যাওয়ার সময় আমাদের দলে অনেক সদস্যই পানিতে ধরে থাকার মতো অবলম্বন খুঁজে পাননি।”

‘বেঞ্চ আঁকড়ে ধরে ছিলাম’
বানতেন প্রদেশের সিনাঙ্কা উপজেলার একজন দোকান মালিক রুডি হেরদিয়ানসিয়াহ বলেন ‘সমুদ্র থেকে প্রকট এক শব্দ আসার’ আগ পর্যন্ত শনিবারে সমুদ্র শান্তই ছিল।

পানির উঁচু দেয়াল সমুদ্রতীরে তাঁর দোকানে আঘাত করলে ঢেউয়ের টানে ভেসে যান তিনি।

এসময় অন্তত তিনবার অজ্ঞান হয়ে যান বলে মনে করতে পারেন তিনি।

“আল্লাহর কাছে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা যে তিনি আমাকে বাঁচিয়েছেন”, বলেন রুডি।

মি. হেরদিয়ানসিয়াহ বলেন তিনি সুনামির সতর্কতা বার্তা শোনেননি; কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে একবার সুনামি প্রস্তুতি মহড়ায় অংশ নিয়েছিলেন।

“ঐ মহড়ায় অংশ নেয়ার কারণে আমি সচেতন ছিলাম। আমি কোনো কিছু ধরার চেষ্টা করছিলাম যা আমার জীবন বাঁচাতে পারে। শেষপর্যন্ত একটি বেঞ্চ আঁকড়ে ধরে ছিলাম।”

‘আমি ভেবেছিলাম মারা যাবো’
১৬ বছর বয়সী আযকি কুর্নিয়াওয়ান জানান, কারিতা সৈকতের একটি জনপ্রিয় রিসোর্ট পাত্রা কমফোর্ট হোটেলে আরো ৩০ জন শিক্ষার্থীর সাথে একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিচ্ছিলেন তিনি।

সেসময় হঠাৎ হোটেলের লবিতে থাকা লোকজন ‘সমুদ্রের পানি বাড়ছে’ বলে তীব্র চিৎকার শুরু করে।

সংবাদ সংস্থা এপি’কে তিনি জানান, কী হচ্ছিল তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না, কারণ কোনো ভূমিকম্প অনুভব করেন নি তিনি।

দ্রুতবেগে দৌড়ে পার্কিং লটে পৌঁছান আযকি। উদ্দেশ্য ছিল নিজের মোটর বাইকটি নিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে যাওয়া, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন সবকিছু ততক্ষণে পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে।

“হঠাৎ করে প্রায় এক মিটার উঁচু এক ঢেউ আঘাত করে আমাকে।”

“সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় ৩০ মিটার দূরে থাকা একটি বেড়ার দিকে ভেসে যাই আমি। আমি যখন ঐ বেড়া শক্ত করে ধরে রেখে স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, তখন বারবার মনে হচ্ছিল যে, হয়তো আজই আমার মৃত্যু হবে।”

‘জঙ্গলের দিকে দৌড়ায় সাধারণ মানুষ’
আসেপ পেরাংকাট নামের এক ব্যক্তি সংবাদ সংস্থা এএফপি’কে জানায়, শহরের ওপর দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ যাওয়ার সময় জাভা’র কারিতা দ্বীপে পরিবার নিয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন তিনি।

“গাড়িগুলোকে প্রায় ১০মিটার দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় ঢেউ; একই অবস্থা হয় বড় কন্টেইনারগুলোরও।”

তিনি বলেন, “সমুদ্রের খুব কাছে অবস্থিত স্থাপনাগুলো তছনছ হয়ে গিয়েছে। গাছ এবং বৈদ্যুতিক খাম্বাগুলো সব ধ্বংস হয়ে গেছে। বাসিন্দাদের প্রায় সবাই জঙ্গলের দিকে দৌড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়।”

জাভা’র পানডেগলাং অঞ্চলের বাসিন্দা আলিফ মেট্রো টিভি’কে জানায় যে নিখোঁজ থাকা অনেক ব্যক্তির স্বজনরা এখনো তাঁদের আত্মীয়দের খুঁজছেন।

‘ঢেউ ছিল দু’টি’
ক্রাকাতাউ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ছবি তোলার জন্য সৈকতেই ছিলাম আমি।

সেদিন সন্ধ্যায় আগ্নেয়গিরি থেকে বেশ কয়েকদফা অগ্ন্যুৎপাত হলেও ঠিক সুনামির আগে দিয়ে আগ্নেয়গিরি ছিল একদম শান্ত।

অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎই বিশাল এক ঢেউ আসতে দেখি এবং দৌড়াতে শুরু করি।

প্রথম ঢেউটা অতটা শক্তিশালী ছিল না। আমি দৌড়ে হোটেলে চলে আসি আমার পরিবারের কাছে।

হোটেল থেকে আমার স্ত্রী-পুত্রকে সাথে নিয়ে যখন বের হই তখন দ্বিতীয় ঢেউটি আঘাত করে। এটি ছিল আরো অনেক ভয়াবহ আকারের।

হোটেলের অন্যান্য মানুষের সাথে সাথে আমরাও দৌড়ে পাশের উঁচু জঙ্গলে আশ্রয় নেই। এখনও আমরা সেখানেই আছি।

‘সব ধ্বংস হয়ে গেছে’
জাভা’র আনইয়েরে সমুদ্রসৈকতে একটি দোকান চালান রাণী; যেটি সুনামিতে তছনছ হয়ে গেছে।

“সব শেষ হয়ে গেছে; আমাদের কাছে টাকাও নেই যে আমরা এগুলো নতুন করে বানাবো।”

বছরের এই সময়টা পর্যটনের জন্য ভাল সময় হিসেবে বিবেচিত হয় এবং ঐ এলাকার মানুষের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস পর্যটনই।

পূর্ববর্তি সংবাদইন্দোনেশিয়ায় ভয়াবহ সুনামিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে
পরবর্তি সংবাদকথা থাকলেও আজ দেশে ফিরছেন না এরশাদ